পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন, সেনাশাসন প্রত্যাহার, ভূমি অধিকারের দাবিতে জেনেভায় বিক্ষোভ ও স্মারকলিপি প্রদান

হিল ভয়েস, ১ মার্চ ২০২৫, আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইউরোপের ৬টি মানবাধিকার সংস্থা La Voix des Jummas, La Fondation Danielle Mitterrand, Survival International, ICRA International, Netherlands Centre for Indigenous Peoples (NCIV), International Work Group for Indigenous Affairs কর্তৃক পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন, সেনাশাসন প্রত্যাহার, ভূমি অধিকারের দাবিতে জেনেভায় বিক্ষোভ সমাবেশ আয়োজন ও স্মরকলিপি প্রদান করা হয়েছে।

গত শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘের সামনে ‘ব্রোকেন চেয়ার’ প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের রাষ্ট্রদূত তারেক মোঃ আরিফুল ইসলামের মাধ্যমে এই স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। সেই সাথে গত বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে জুম্মদের উপর সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলাকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও স্বচ্ছ বিচারিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর বিষয়ে জাতিসংঘের নেতৃত্বে নিরপেক্ষ তদন্ত চালানোর দাবি করেছে উক্ত ৬টি সংস্থা।

উক্ত স্মারকলিপিতে বলা হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জুম্ম সম্প্রদায়ের প্রতি সহিংসতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এশিয়া ইন্ডিজেনাস পিপলস প্যাক্ট (এআইপিপি), ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্ক গ্রুপ ফর ইন্ডিজেনাস অ্যাফেয়ার্স (ইবগিয়া) এবং সিএইচটি কমিশনের যৌথ বিবৃতিতে (৮ ই অক্টোবর ২০২৪) উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে খাগড়াছড়িতে এক বাঙালি ব্যক্তির হত্যাকাণ্ডের পরদিন ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে জুম্ম জনগোষ্ঠীর ওপর ব্যাপক সহিংসতা শুরু হয়।

এই ঘটনা কোনো যথাযথ তদন্ত ছাড়াই জুম্ম সম্প্রদায়ের ওপর দোষারোপ করে বাঙালি সেটেলার সংগঠনগুলোকে সংঘাতে উসকানি দেওয়ার সুযোগ দেয়। স্থানীয় পুলিশ প্রধানও একই ধরনের বক্তব্য দেন, যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। ওইদিন সন্ধ্যায় দীঘিনালায় জুম্ম আদিবাসীদের বাড়িঘরে ভয়াবহ আক্রমণ চালানো হয়, যার ফলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে এবং পালাতে না পারায় এক জুম্ম ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে।

এ ঘটনার প্রতিবাদে খাগড়াছড়িতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের আয়োজন করলে ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ রাত ৯টার দিকে সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করে এবং সামরিক বাহিনী কর্তৃক নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানো হয়। এই নৃশংস দমন-পীড়নের ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তত তিনজন নিহত এবং অসংখ্য আহত হয়। পরের দিন ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ রাঙ্গামাটিতে জুম্ম যুবকদের বিক্ষোভেও বাঙালি সেটেলারদের দ্বারা হামলার শিকার হতে হয়।

বিশেষভাবে উদ্বেগজনক হলো, এসব ঘটনার সময় নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা, ঘটনাস্থলে সামরিক বাহিনী উপস্থিত থাকলেও তারা সশস্ত্র সেটলারদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এটি সরকারের প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করে, যেখানে ২৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে আপনার সরকার দেশের সকল নাগরিক, বিশেষ করে আদিবাসী জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

১ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে খাগড়াছড়িতে আরও সহিংসতার সূত্রপাত ঘটে, যেখানে খাগড়াছড়ি সরকারি কারিগরি স্কুল ও কলেজের শিক্ষক সোহেল রানার মৃত্যুর পর বাঙালি সেটলাররা আদিবাসী সম্প্রদায় ও তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালায়। স্থানীয় প্রশাসন বিকেল ৩টার মধ্যে অবৈধ সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও রাত ৭:৩০টা পর্যন্ত জুম্মদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সেটেলারদের হামলা অব্যাহত থাকে এবং নিরাপত্তা বাহিনী এসব অপরাধ প্রতিরোধে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়।

২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে ইন্টারন্যাশনাল সিএইচটি কমিশন জানায়, বান্দরবান জেলার খ্রিস্টান ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ১৭টি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এসব ঘটনা স্পষ্ট করে যে, আদিবাসী সম্প্রদায়ের জমি দখল এবং তাদের ওপর নির্যাতন সুপরিকল্পিত এবং ধারাবাহিকভাবে চলছে।

২০২৫ সালের প্রথম দিকেও জুম্ম সম্প্রদায়ের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক রয়ে গেছে। ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে ঢাকার মতিঝিলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-এর সামনে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদরত আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ওপর ‘স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি’ নামক সেটেলারদের সংগঠনের সদস্যদের দ্বারা হামলা চালানো হয়। এই হামলায় অন্তত ১৯ জন শিক্ষার্থী আহত হয়, যাদের মধ্যে ১০ জন গুরুতর আহত আদিবাসীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়।

২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে বান্দরবানের লামা উপজেলায় ভূমি সুরক্ষা আন্দোলনের নেতা রিংরং ম্রোকে সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করে। স্থানীয়দের দাবি, এই গ্রেফতার একটি বেসরকারি কোম্পানির মিথ্যা মামলার ভিত্তিতে করা হয়েছে, যা ৪০০ একর আদিবাসী জমি দখলের বিরুদ্ধে তার সক্রিয় ভূমিকার কারণে হয়েছে।

এই পরিস্থিতি সরকারের প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করছে, যেখানে ২৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে অন্তর্বর্তী সরকার সকল নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছিল।

জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ৬টি সংগঠন সরকারের কাছে নিম্নলিখিত দাবি জানায়:

১. ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান।
২. হামলাকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও স্বচ্ছ বিচারিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং পার্বত্য এলাকায় চলমান বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ করা।
৩. মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর বিষয়ে জাতিসংঘের নেতৃত্বে নিরপেক্ষ তদন্ত চালানো এবং এসব ঘটনায় সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা মূল্যায়ন করা।
৪. ‘অপারেশন উত্তরণ’ বন্ধ করা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সামরিক ক্যাম্প ছাড়া অন্যান্য অস্থায়ী সামরিক ক্যাম্প প্রত্যাহার করে বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে পূর্ণ ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া।
৫. জুম্ম জনগণের কাছ থেকে জোরপূর্বক দখল করা জমি ফেরত দেওয়া এবং পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী ভূমি কমিশনের মাধ্যমে সকল জমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা।
৬. ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।

More From Author