পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য: আন্তর্জাতিক নারী দিবসে কেএসমং

হিল ভয়েস, ৯ মার্চ ২০২৫, বান্দরবান: গতকাল ৮ মার্চ “নারী সমাজের অধিকার, মর্যাদা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করি, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে অধিকতর ভূমিকা রাখি” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সকাল ১০ ঘটিকার সময় বান্দরবান রয়েল হোটেল হলরুমে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন কমিটি উদ্যোগে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়।

উক্ত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কেএসমং মারমা, সদস্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুমন মারমা, সদস্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী অংচমং মারমা, বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী লেলুং খুমী, নারী হেডম্যান সানুচিং মারমা, নারী প্রতিনিধি রেংএময় বম প্রমুখ।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব উলিসিং মারমার সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক মেঞোচিং মারমা । আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন কমিটির সদস্য মেসাইনু মারমা। আলোচনা সভার শুরুতে উত্তরীয় পরিয়ে অতিথিদের বরণ করে নেয়া হয়।

প্রধান অতিথি বক্তব্যে কেএসমং মারমা বলেন, পাহাড়িদের জন্য এই দিবসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমাদের সমাজ ব্যবস্থা সামন্ত সমাজ ব্যবস্থা, সামন্তীয়য় উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল আর এই সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের এবং পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমাদের সমাজে পশ্চাৎপদ ও সামন্তীয় চিন্তা, ধ্যান ধারণার কারণে নারী নেতৃত্ব এখনো সেভাবে গড়ে উঠেনি।

তিনি আরো বলেন আজকে জেলা পরিষদ থেকে শুরু করে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সবকিছুই চুক্তির ফসল। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের আন্দোলনেও নারীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই পরিবর্তনের পরেই শাসকগোষ্ঠী নারীদের উপর বেশি আঘাত করেছে। আর এই আঘাত রাজনৈতিক যেমনটা পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঁচ লক্ষাধিক সেটেলার পুনর্বাসন করেছিল। ৭১ এর পরিবর্তনের সময় যেমন আমরা পশ্চাৎপদ এবং নারীদের সুবিচার, অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানেও পাইনি ২৪শের গণঅভ্যুত্থান ও সেই পথে হাঁটছে।

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে জনবান্ধব ও আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দল না থাকায় সারাদেশে অস্থিরতা বিরাজমান।অধিকারের কথা বললে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বললেই রাষ্ট্র দ্রোহিতার ট্যাগ দেওয়া হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের যে সমস্ত জাতিগোষ্ঠী আছে তাদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং আন্দোলন জোরদার করতে হবে।

আলোচনা সভায় সুমন মারমা বলেন, সমাজকে পরিবর্তন করতে গেলে নারী এবং পুরুষ উভয়কেই আমাদের প্রয়োজন। এখানে পুরুষ এবং নারীকে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নাই। পার্বত্য চট্টগ্রামে সত্তর দশক এমনকি পাকিস্তান পিরিয়ডে যেমন এই অঞ্চলের মানুষের উপর নিপীড়ন নির্যাতন করেছিলো স্বাধীনতার পরও সেই অত্যাচার চালিয়েছে, সেখানে বিশেষ করে নারীরা বেশী শিকার হয়েছিলো এমনকি আজকের সময়ে দাড়িয়ে সেই ব্যবস্থা চলমান রয়েছে গোটা আদিবাসী সমাজের উপর।

তিনি আরো, বলেন শেখ মুজিবুর রহমান আমল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সব সরকার আমাদের অধিকারের পক্ষে ছিল না এবং নেই। সামন্তীয় সমাজ ব্যবস্থায় নারীদেরকে অবমূল্যায়ন করা হয়, উপেক্ষা করা হয় কিন্তু সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে নারী-পুরুষের সমান ভূমিকা থাকা বাঞ্ছনীয়।

তিনি আরো বলেন, আজকে বাবা-মায়েরা সন্তানের রাজনীতি বিমুখ রাখতে চায়। কিন্তু এই সময়ে এসে সন্তানকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করা খুবই জরুরি। পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে নারী-পুরুষ সবাইকে সামিল হতে হবে।

অংচমং মারমা বলেন, মানব সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে অধিকার ওতোপ্রোতভাবে জরিত তারপরেই নারী অধিকার প্রশ্ন আসে। আমাদের সমাজে যতদিন পর্যন্ত ধর্ষক নিপীড়কদের বসবাস থাকবে, ততদিন নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। নারীদের অধিকারের পাশাপাশি নিরাপত্তা প্রয়োজন। নিরাপত্তা প্রদানের ক্ষেত্রে পুরুষদের বেশি ভূমিকা রাখা উচিত। ধর্ষক, নিপীড়কদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া উচিত। নারী অধিকার শুধু কাগজে-কলমে না রেখে বাস্তবে রূপ দেওয়া প্রয়োজন।

লেলুং খুমী বলেন, যেকোনো দিবস পালনের ক্ষেত্রে একটা তাৎপর্য এবং গুরুত্ব বহন করে। নতুন প্রজন্মকে উৎসাহ, প্রেরণা জোগায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী রয়েছে তাদের মধ্যে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা দরকার। যারা অধিকতর পিছিয়ে রয়েছে তাদেরকে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ছাড় দেওয়ার মানসিকতা রাখতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে আমাদের সবাইকে যে যার অবস্থান থেকে আন্দোলন করে যেতে হবে এবং সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত।

এছাড়াও উক্ত আলোচনা সভায় রেংএময় বম, সানুচিং মারমা প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

শেষ পর্যায়ে সভাপতি মেঞোচিং মারমার সভাপতি বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আলোচনা সভাটি সমাপ্ত হয়।

More From Author