হিল ভয়েস, ২৫ মার্চ ২০২৫, বিশেষ প্রতিবেদন: ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যকার ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী ও সেটেলার বাঙালিদের কর্তৃক পাহাড়িদের উপর কমপক্ষে ১৩টি গণহত্যা চালানো হয়।
বাংলাদেশ সরকার এই গণহত্যাগুলোর একটিরও বিচার এখনও পর্যন্ত করেনি। এমনই এক নৃসংশ গণহত্যা সংঘটিত হয় ১৯৮০ সালের ২৫ মার্চের আজকের এই দিনে যা সেনাবাহিনী ও সেটেলার বাঙালি কর্তৃক সংগঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম গণহত্যা হিসেবে গণ্য করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন কর্তৃক ১৯৯১ সালে প্রকাশিত ‘জীবন আমাদের নয়’ প্রতিবেদন অনুযায়ী তৎকালীন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বেতবুনিয়া থানার অর্ন্তগত কলমপতি ইউনিয়নের কাউখালী বাজার, মুখ পোয়া, পোয়া পাড়া, তোংপাড়া এবং হেডম্যান পাড়ায় এই হত্যাযজ্ঞ ঘটানো হয় এবং এ ঘটনায় কমপক্ষে ৩০০ পাহাড়ি মারা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলকে ধ্বংস এবং জুম্ম জনগণকে জাতিগত নির্মূলীকরণের লক্ষ্যেই সেনাবাহিনী ও সেটেলার বাঙালিরা পরিকল্পিতভাবে বর্বরোচিত এই গণহত্যা ঘটিয়েছিল।
সেনাবাহিনী কর্তৃক নৃশংস গণহত্যার সূত্রপাত:
অধুনা রাঙ্গামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার কলমপতি আর্মি জোনের প্রধান এক ধর্মীয় সভার নামে কলমপতি ইউনিয়নের পাহাড়ি নেতাদের জড়ো করান। ১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ সকাল বেলায় ঘোষণা দেয়া হয় পোয়াপাড়া বৌদ্ধ মন্দিরের সংস্কার কাজে আর্মিরা সহায়তা করবে আর এই সংস্কার কাজের জন্য সাধারণ পাহাড়িদের ডাকা হয়। সাধারণ পাহাড়িরা এতে সাড়া দিয়ে মিটিংয়ে উপস্থিত হয় এবং এরপর আর্মিরা তাদের এক লাইনে দাঁড়াতে বলা বলে। লাইনে দাঁড়ানোমাত্র সেনাসদস্যরা উপস্থিত পাহাড়িদের উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে সেনাবাহিনীর গুলিতে সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় কাউখালী বাজার চৌধুরী কুমুদ বিকাশ তালুকদার, স্থানীয় স্কুল কমিটির সেক্রেটারি শরদিহর চাকমাসহ শতাধিক ব্যক্তি। গুরুতর আহত হন ইন্দু কুমার চাকমা, পিটিয়া চাকমাসহ ১২ জনের অধিক। এদের রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একই দিন পোয়াপাড়া হত্যাকান্ড শেষে প্রায় ৩০ জন পাহাড়ী নারীকে জোরপূর্বক কলমপতি আর্মি ছাউনিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ধ্যায় শিশু ও বৃদ্ধাদের ছেড়ে দেয়া হলেও তরুণীদের ছেড়ে দেয়া হয়নি, যাদের হদিস আর পাওয়া যায় নি।
পাহাড়িদের উপর সেটেলার বাঙলিদের হামলা:
সেনাসদস্যরা উপস্থিত শতাধিক পাহাড়িদেরকে হত্যা করে ক্ষান্ত হয়নি। তারা সেটেলার বাঙালিদের সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ি অধ্যুষিত কাউখালী মুখ পাড়া, পোয়াপাড়া, কাউখালী বাজার, তোংপাড়া এবং হেডম্যান পাড়া আক্রমণ করে। দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেটেলার বাঙালিরা সমস্ত বাড়িঘর তছনছ ও লুটপাট চালায় এবং পুড়িয়ে দেয়। প্রাক্তন সংসদ সদস্য চাইথোয়াই রোয়াজার বাড়িও লুট করা হয়। এছাড়াও মুখপাড়া কিয়াং, তোংপাড়া আনন্দ মোহন বৌদ্ধ মন্দির, পোয়াপাড়া মন্দিরেরও ধ্বংস সাধন করে। কিয়াংগুলোর স্বর্ণ, রৌপ্য, পিতলের বৌদ্ধমূর্তি, আসবাবপত্রসহ মূল্যবান সামগ্রী লুট করা হয়। হাতিরপাড়া ও কাউখালির দুইটি বৌদ্ধ মন্দির পুড়িয়েও দেয় সেটেলাররা। সেটেলাররা সামনে যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে। সেটেলার বাঙালিদের নৃশংস আক্রমণে কমপক্ষে দুইশত পাহাড়ি মারা যায়। সেটেলার বাঙালিদের হামলার মুখে পাহাড়ির দৌড়ে পালিয়ে গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নেয় এবং পরবর্তীতে এক হাজারের অধিক পাহাড়িকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। গুরুদাস চাকমা নামে একজন বেঁচে যাওয়া পাহাড়ি গ্রামবাসী একটি গণকবর দেখিয়ে দেন যেখানে পঞ্চাশ থেকে ষাট জন পাহাড়িকে কবর দেয়া হয়েছে। পাহাড়িদের রেখে যাওয়া জায়গাগুলোতে বর্তমানে সেটলার বাঙালিরা বেদখল করে বসতি স্থাপন করেছে, বৌদ্ধ মন্দিরের জায়গায় মসজিদ বানিয়েছে।
গণহত্যার পরবর্তী ঘটনা:
১৯৮০ সালের ১ এপ্রিল তৎকালীন জাসদের সংসদ সদস্য উপেন্দ্র লাল চাকমা ঢাকাস্থ জাসদের দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে কলমপতি হত্যাকান্ডের কথা প্রথমে প্রকাশ করেন। এরপর পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনার জন্য ৫ (পাঁচ) সদস্যের একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয় এবং সেখানে এমপি উপেন্দ্র লাল চাকমাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
সংসদীয় কমিটির বিপরীতে স্বাধীনভাবে হত্যাকান্ডটি তদন্তের জন্য জাসদের এমপি শাহজাহান সিরাজ, উপেন্দ্র লাল চাকমা এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক রাশেদ খান মেননসহ তিন সদস্যবিশিষ্ট এক সত্য অনুসন্ধানকারী দল গঠন করা হয়। দলটি নিজস্ব উদ্যোগে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। তাঁদের পরিদর্শনের সংবাদ পেয়ে প্রায় ৫০০ জন ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ি কয়েক মাইল হেঁটে চেলাছড়ায় তদন্ত টিমের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং তাদের দুর্ভোগের কথা জানায়। প্লেকার্ড ও পোস্টারের মাধ্যমে তারা সমতল থেকে অবৈধ আগমনকারী বাঙালিদের হামলায় হত্যাকান্ডে দায়ী ব্যক্তিদের বিচার, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ বন্ধের উদ্দেশ্যে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর রক্ষা, ধর্মীয় নিয়মানুযায়ী মৃতদের দাহ, পাহাড়িদের জন্য আত্ননিয়ন্ত্রণাধিকার এবং সেটেলারদের ফিরিয়ে নেয়ার দাবি জানায়।
সত্য অনুসন্ধানকারী দলের বক্তব্য:
১৯৮০ সালের ২১ তারিখে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে সত্য অনুসন্ধানী দলটি ঘটনার বিবরণ দেন। তাদের বক্তব্য অনুসারে, “ঘটনাস্থল বপরিদর্শনের পর, আমরা ২৫ মার্চ ১৯৮০ তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রামের বেতবুনিয়া পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন কলমপতি ইউনিয়নস্থ কাউখালি বাজারের আর্মির এক ইউনিট কর্তৃক সংঘটিত হত্যাকান্ড ও নৃশংসতার প্রমাণ পেয়েছি। সদ্য আগত সেটলাররাও হত্যাকান্ড ও লুটতরাজে অংশ নেয়। এমনকি ঘটনার ১ মাস পরও গোটা এলাকায় ভয়ের রাজত্ব বিরাজ করছে। স্থানীয় প্রশাসন ও পাহাড়ি নেতৃবৃন্দের শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও উচ্ছেদের শিকার হওয়া গরীব পাহাড়িরা নিজেদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া গ্রামে ফিরে যেতে অপারগতা প্রকাশ করে। কারণ হয়রানিমূলক গ্রেপ্তার, যখন তখন মানুষ হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, সেটলারদের হুমকি প্রদান এসব চলছে।”
তারা আরো বলেন, “একই সাথে আমরা সেটেলারদের বাসকৃত বাড়িগুলোকে খুব ভালো অবস্থায় দেখেছি। এগুলো পাহাড়িদের জমিতে তৈরি করা হয়েছিল। এই সেটেলারদের আনা হয়েছিল ভিন্ন জেলা থেকে সাপ্তাহিক রেশন ও আশ্রয়ের প্রলোভনে। একজন স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের জানিয়েছেন যে ২,৬৩৭ পরিবারকে বাড়ি নির্মাণের জন্য জমি দেয়া হয়েছে এবং ৩০০ পরিবারকে চাষের জমি দেয়া হয়েছে। প্রতি পরিবারকে সপ্তাহে ১২ সের গম প্রদান করা হয়। কিন্তু যখন সরকার কি সিদ্ধান্তের কারণে এখানে সেটেলারদের নিয়ে আসা হয়েছে বলে জিজ্ঞেস করা হয় তখন স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যান। তারা আমাদের বলেন যে সেটেলারদের ক্রমাগত আগমন বন্ধ হয়েছে। কিন্তু এ সময়ে ইতিমধ্যে ২০ হাজার সেটেলার পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছে।”
সবশেষে তাঁরা বলেন, “এটি আমাদের কাছে সুস্পষ্ট যে কলমপতির ঘটনা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি সুনির্দিষ্ট একটি পরিকল্পনা ও পন্থায় সংঘটিত করা হয়েছে।”
সংবাদ সম্মেলনে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি যেসকল সুপারিশ করেছিল:
১। কলমপতি ইউনিয়নে ২৫ মার্চ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও ঘাতকদের শাস্তি;
২। ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তাসহ পুনর্বাসন;
৩। ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনঃর্নিমাণ, মন্দির ধ্বংস সাধনের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান ও ধর্মীয় অনূভুতিতে আঘাত দানের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা;
৪। সেটেলার বাঙালিদের আগমন বন্ধ করা;
৫। যেসব সেটেলার ইতোমধ্যে এখানে বসতি গড়েছে তাদের অবিলম্বে ফিরিয়ে নেয়া;
৬। বাজারগুলোতে মালামাল আনা-নেয়ার ব্যাপারে বাধা প্রত্যাহার;
বাংলাদেশ সরকার সত্য অনুসন্ধান দলের সুপারিশ গ্রহণ করেনি এবং কোন ধরনের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য প্রদান করেনি। সংসদীয় কমিটি নামেমাত্র গঠন করা হয়েছিল। কোন ধরনের তদন্ত রিপোর্ট এখনও প্রকাশিত হয়নি। বরং বিভিন্নভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই গণহত্যার হোতাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তী গণহত্যাগুলো সংঘটিত হওয়ার পথকে প্রশস্ত করে দেয়। রাষ্ট্রযন্ত্র এসব গণহত্যা ভূলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও পাহাড়ের নিপীড়িত জুম্ম জনগণ কখনও গণহত্যার কথা ভুলেনি এবং গণহত্যার শহীদদের আত্মত্যাগের কথা ভুলে যাবে না। পাহাড়ের নতুন প্রজম্ম শহীদদের আত্মত্যাগকে শিরোধার্য করে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অধিকতর সামিল হবে এবং নতুন সূর্যোদয়ের আনার জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করার শপথ নিবে। শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না।