বাঘাইছড়িতে জনসংহতি সমিতির ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গণসমাবেশ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

হিল ভয়েস, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটি জেলাধীন বাঘাইছড়ি উপজেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গণসমাবেশ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

আজ শনিবার ১৫ ফেব্রুয়ারি বাঘাইছড়ির উগলছড়ি মুখ(বটতলা) মাঠে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন কমিটির উদ্যোগে উক্ত গণসমাবেশ ও আলোচনা সভাটি অনুষ্ঠিত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বাঘাইছড়ি থানা কমিটির সভাপতি পুলক জ্যোতি চাকমার সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনসংহতি সমিতির প্রত্যাগত সদস্য এবং ৩০ নং সারোয়াতুলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ভূপতিরঞ্জন চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির বাঘাইছড়ি থানা কমিটির সভাপতি লক্ষীমালা চাকমা, বাঘাইছড়ি শিজক কলেজের অধ্যক্ষ সুভাষ দত্ত চাকমা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ভদ্রসেন চাকমা, পিসিপির বাঘাইছড়ি থানা শাখার সভাপতি চিবরন চাকমা, বাঘাইছড়ি যুব সমিতির সভাপতি পিয়েল চাকমা, বাঘাইছড়ির দুই ইউনিয়নের (খেদারমারা ও বাঘাইছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ) চেয়ারম্যান এবং কার্বারি প্রতিনিধি অরুণ কান্তি চাকমা।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জনসংহতি সমিতির প্রত্যাগত সদস্য এবং ৩০ নং সারোয়াতুলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ভূপতিরঞ্জন চাকমা জনসংহতি সমিতির সুদীর্ঘ ৫৩ বছরের সংগ্রামের ইতিহাস স্মরণ করে বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে মহান পার্টি কখনো বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠী এবং কখনো স্বজাতির অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা নানান শ্রেণির ক্ষমতালোভী, সুবিধাবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী দ্বারা সীমাহীন ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আসছে। কিন্তু তারপরও পার্টিকে তারা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। জনসংহতি সমিতি আজও পাহাড়ের ভিন্ন ভাষাভাষী ১৪টি জুম্ম জাতি গোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন যে বাস্তবতা দেখা দেয়, সে বাস্তবতায় সংগ্রাম করে যাচ্ছে।

শিজক কলেজের অধ্যক্ষ সুভাষ দত্ত চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কখনো শুধুমাত্র জুম্মদের অধিকারের বিষয়ে কথা বলেনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এদেশের গরীব, মেহনতি মানুষের স্বার্থে কথা বলে আসছে, অধিকারহারা মানুষের কথা বলে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংসদের জীবনের ইতিহাস পড়লে আমরা তার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাই।

তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জুম্ম জনগণের পরীক্ষিত একটি রাজনৈতিক সংগঠন। জনসংহতি সমিতির ৫৩ বছরের যে পথচলার ইতিহাস, তার যে কার্যক্রম এখন যদি আমরা মূল্যায়ন করি তাহলে নির্দ্বিধায় বলতে পারি সে সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একটি সফল পার্টি।

তিনি আরও বলেন, এদেশের কিছু কিছু মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আন্দোলনকে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, বাংলাদেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা করার ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। কিন্তু আমি তাদের উদ্দেশ্য করে বলতে চাই, জনসংহতি সমিতির আন্দোলন কখনো, কোনদিন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ছিলো না। সে কোনদিন আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম একটা আলাদা রাষ্ট্র হোক সেটা বলেনি। সে বলেছে, আমাদের অধিকারের কথা। পার্বত্য চট্টগ্রামের যেসকল অধিকারকামী মানুষ আছে তারা যে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, তাদের অস্তিত্ব যে ধ্বংসের মুখে সে কথাই জনসংহতি সমিতি বার বার রাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরেছে। এবং রাষ্ট্র যখন তার কোনো কথাই কর্ণপাত করেনি তখনই জনসংহতি সমিতি বাংলাদেশ সরকারের সাথে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হয়েছে।

সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ভদ্রসেন চাকমা বলেন, আন্দোলন করা একজন নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবিক অধিকার। আন্দোলন করা মানবতাবিরোধী নয়, কাউকে ক্ষতি করা নয়, রাষ্ট্র বিরোধী নয়, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র নয়, সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র নয়। দেশের যোগ্য নাগরিক, ন্যায্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে, টিকে থাকতে, দেশের অপরাপর নাগরিকদের সাথে সমান অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে, নাগরিক অধিকার ভোগ করতে যে আন্দোলন, সেই আন্দোলন কখনো একটি দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন হতে পারে না।

তিনি বলেন, মুক্তির আন্দোলন ৫-১০ বছরে, ২০-৩০ বছরে অর্জিত হয় এমন কোনো গ্যারান্টি নাই। শতবর্ষী আন্দোলন রয়েছে, শত বছরের উর্ধ্বের আন্দোলন আছে। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিকামী জুম্ম জনগণকে অবশ্যই জনসংহতি সমিতিকে এবং তাঁর নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বাসী, আস্থাশীল হতে হবে।

তিনি জুম্ম তারুণ্যের প্রতি আহ্বান রেখে বলেন, তারুণ্যের অমিত সাহস, তাদের মেধা এবং সৃষ্টিশীলতা দিয়ে এম এন লারমার বিকল্প এম এন লারমা, বিকল্প বিপ্লবী, বিকল্প নেতা, বিকল্প আদর্শবান নেতৃত্ব হিসেবে তৈরি হতে হবে। তাই তারুণ্যকে এখন থেকে নিজেদের সেভাবেই গড়ে তুলতে হবে।

তিনি আরও বলেন, জনসংহতি সমিতির আন্দোলন যদি সফল হয়, বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বাঙালি জনগোষ্ঠীরও সুবিধা, লাভ। কারণ গোটা বাংলাদেশের ১০ শতাংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম যদি অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকে তাহলে বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম এদেশের বোঝা হয়ে থাকবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ কখনো একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এগোতে পারবে না।

চিবরন চাকমা বলেন, সেই ২০১৭ সাল হতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বৃহত্তর আন্দোলনে সামিল হয়ে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে বর্তমান জুম্ম তরুণ ও যুব সমাজকে আহ্বান করে আসছে। জুম্ম ছাত্র ও যুব সমাজ অবশ্যই এই বিষয়টি আরও গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, আজকে জুম্ম তরুণ সমাজের বিরাট একটি অংশকে দায়সারা ভাব নিয়ে নিজেদের জীবন অতিবাহিত করতে দেখা যায়। জুম্ম জাতির প্রতি তাদের যে একটা দায়িত্ববোধ-কর্তব্যবোধ থাকার কথা, আমরা দেখি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটা অনুপস্থিত। এভাবেই চলতে থাকলে আমাদের অস্তিত্ব আরও হুমকির মুখে পড়বে।

জুম্ম তরুণ ও যুব সমাজকে অবশ্যই জুম্ম জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে এগিয়ে আসতে হবে। আরও আন্দোলন-সংগ্রামমুখী হতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন তথা জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব, সেটা তাদের বুঝে নিতে হবে। এবং পালন করতে হবে।

গণসমাবেশ ও আলোচনা সভায় সঞ্চালনায় ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বাঘাইছড়ি থানা কমিটির ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক বিপর্শী চাকমা এবং স্বাগত বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বাঘাইছড়ি থানা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মন্টু বিকাশ চাকমা।

More From Author