হিল ভয়েস, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, চবি: গতকাল মঙ্গলবার ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ খ্রি; “ভাষার বৈচিত্র্যে গড়ি ঐক্যের পথ, আদিবাসী সংস্কৃতি রক্ষা হোক আমাদের শপথ” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক সংগঠন রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ৫ম বারের মতো ‘আদিবাসী সংস্কৃতি ও ভাষা বৈচিত্র্য উৎসব – ২০২৫’ আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন এবং উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কাঞ্চন চাকমা। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন চবি ছাত্র-ছাত্রী পরামর্শ ও নির্দেশনার পরিচালক প্রফেসর ড. মো. আনোয়ার হোসেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রভাষক শাংথুই প্রু, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের প্রভাষক (ইংরেজি) নৈরঞ্জনা চাকমা।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সুমন চাকমা।
আয়োজিত অনুষ্ঠানটি চবি উন্মুক্ত মঞ্চে গতকাল দুপুর ২:৩০ ঘটিকায় শুরু হয়। অনুষ্ঠানের আলোচনা সভায় রঁদেভূ’র সাধারণ সম্পাদক নুখ্যাইমং মারমার সঞ্চালনায় সভাপতিত্ব করেন সভাপতি রবি বিকাশ চাকমা। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন রঁদেভূ’র সাংগঠনিক সম্পাদক সুসান্না টুডু।
প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশে বৃহত্তর সংস্কৃতির আগ্রাসন ছোট ছোট সংস্কৃতিগুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। কালক্রমে বাংলার বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ও দেশের নানা প্রান্তে থাকা নানা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষায় যেমন বাহ্যিক ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটেছে ঠিক তেমনি বাংলার লোকজ ঐতিহ্যে বাহ্যিক সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আদিবাসীদের ভাষা-সংস্কৃতি আরও বেশি প্রান্তিকতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। একটি জাতিগোষ্ঠী যদি টিকে থাকতে চাই তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিতে হবে।
প্রফেসর ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, পৃথিবীতে প্রায় ৭ হাজার ভাষা রয়েছে। আদিবাসীদের ভাষাগুলো দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। ভাষার জ্ঞান পৃথিবীকে সমৃদ্ধ আর বৈচিত্র্যময় করে তুলে কিন্তু ভাষাগুলো চর্চার অভাবে বা পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এ ভাষাগুলো হারিয়ে যায়, পৃথিবী থেকে একটি ভাষা হারিয়ে গেলে একটি জ্ঞানের ভান্ডার হারিয়ে যায়। পৃথিবীর সকল জাতির মধ্যে একটি জ্ঞানের ভান্ডার রয়েছে তা হচ্ছে ভাষা, সেই জ্ঞানের ভান্ডার রক্ষা করা আর গড়ে তুলার কাজ করে যেতে হবে।
প্রফেসর ড. কাঞ্চন চাকমা বলেন, আমাদের যে বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষাসমূহ প্রায় বিলুপ্তির পথে আছে তা সঠিকভাবে চর্চার প্রয়োজন রয়েছে। এজন্য সচেতন মহলকে এগিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরী। আদিবাসীদের ভাষা সম্পর্কে গবেষণা করা আর সংরক্ষণ করার বিকল্প নেই। সরকারের এই বিষয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসা জরুরী।
শাংথুই প্রু বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা মুক্তজ্ঞান চর্চার পরিবেশে আদিবাসী ভাষা-সংস্কৃতিকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারা গর্বের বিষয়। আমরা যেগুলো ব্যক্তি উদ্যোগে করতে পারছি না সেগুলো রঁদেভূ তার বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে করে যাচ্ছে। আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভাষা-সংস্কৃতি খুবই প্রান্তিকতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। এজন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভাষা-সংস্কৃতির অধিকতর চর্চা, প্রচার ও প্রসার প্রয়োজন।
সুমন চাকমা বলেন, আদিবাসী জনগোষ্ঠী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তার ভাষার মাধ্যমে নিজের প্রথাগত জ্ঞান, সংস্কৃতি ও ইতিহাস টিকিয়ে রেখেছে। আমাদের অস্তিত্ব টিকে আছে আমাদের ভাষার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টি লগ্ন থেকে আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতির উপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে বৃহৎ নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে জারি রেখে আমদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে থেলে দেওয়া হচ্ছে। আদিবাসীদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে সচেতন সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে এবং ভাষা বৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।
সভাপতির বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আলোচনা সভার সমাপ্তি ঘটে। আলোচনা সভা পরবর্তীতে একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয়। রঁদেভূ’র সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অতনু সিংহ ও আবৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক লিলি চাকমা সঞ্চালনায় সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করেন রঁদেভূ’র সদস্যবৃন্দ, চবি বিএমএসসির সাংস্কৃতিক কমিটির সদস্যবৃন্দ, টিএসএফের সদস্যবৃন্দ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিবাসী শিক্ষার্থীরা।