আমরা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের জন্য মৃত্যুকে জয় করতে প্রস্তুত : জুয়েল চাকমা

হিল ভয়েস, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, রাঙ্গামাটি: আজ মঙ্গলবার ১৮ই ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে “চুক্তি বিরোধী সকল প্রকার ষড়যন্ত্র প্রতিহত করুন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে বৃহত্তর আন্দোলনে জুম্ম ছাত্র সমাজ অধিকতর সামিল হোন” আহ্বানে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ রাঙ্গামাটি জেলা শাখার ২৬তম বার্ষিক শাখা সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়।

রাঙ্গামাটি জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত বার্ষিক শাখা সম্মেলন ও কাউন্সিলে পিসিপি রাঙ্গামাটি জেলা শাখার বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক টিকেল চাকমার সঞ্চালনায় এবং বিদায়ী সভাপতি জিকো চাকমার সভাপতিত্বে উক্ত সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির ছাত্র বিষয়ক সহ-সম্পাদক জুয়েল চাকমা, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুমিত্র চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নিপন ত্রিপুরা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সভাপতি চারুলতা তঞ্চঙ্গ্যা। এছাড়াও আলোচনা সভায় ৩০০ জনাধিক ছাত্র-ছাত্রী অংশগ্রহণ করে।

আলোচনা সভার শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আত্মবলিদানকারী বীরদের স্মরণে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নিরবতা পালন করা হয়।

সভায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন পিসিপি রাঙ্গামাটি জেলা শাখার বিদায়ী অর্থ সম্পাদক মিলন চাকমা।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে জুয়েল চাকমা বলেন, ছাত্র ও যুব সমাজ হলো আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ও প্রাণ। সেই ছাত্র সমাজ জেএসএসের নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামে সামিল হয়ে শাসকগোষ্ঠীর বুকে কাঁপন ধরিয়েছিল। ভবিষ্যতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলন তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জুম্ম ছাত্র সমাজ সামিল হবে কিনা এসময়ে এসে সেটা মীমাংসা হওয়া দরকার। আমাদের মধ্যকার আত্মমুখীনতা, দোদুল্যমানতা, সুবিধাবাদী চরিত্রের দূর হওয়া দরকার। শাসকগোষ্ঠীকে ভয় পেলে চলবে না। শাসকগোষ্ঠীর যা আছে আমাদেরও তাই আছে। বরং আমাদের যা আছে শাসকগোষ্ঠীর তা নেই। তা হলো আমরা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের জন্য মৃত্যুর ভয়কে জয় করতে প্রস্তুত। সুতরাং, বিভিন্ন মহল ও শাসকগোষ্ঠীর পাতানো ষড়যন্ত্র ও বিভ্রান্তি থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখে চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলনে ছাত্র সমাজকে অধিকতর সামিল হতে হবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে যুবনেতা সুমিত্র চাকমা বলেন, যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন বিজাতীয় শাসন-শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকা জুম্ম জনগণ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রাম পথ বেছে নেয়। দীর্ঘ সশস্ত্র সংগ্রামের প্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু ২৭ বছর বিগত হলেও চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি। রাষ্ট্রের উগ্র জাত্যভিমানী মনোভাব জুম্মদের অধিকার স্বীকার করতে চায় না। তার বিপরীতে ছাত্র নেতৃত্ব, যুব নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয়হীনতা জাতীয় ঐক্য জোরালো করতে পারছে না। এসব সীমাবদ্ধতা থেকে বেড়িয়ে এসে সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব শক্তিশালী ও গতিশীল করতে হবে। তাহলেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলন জোরালো হবে।

ছাত্রনেতা নিপন ত্রিপুরা বলেন, সমাজ বিকাশের ধারায় মানুষ তখনই লড়াই করে যখন কেউ তার অধিকার হরণ করে অথবা তার বিকাশের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক শোষণ বঞ্চনা নিপীড়ন হয়েছে। যার প্রতিক্রিয়ায় বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু সে আন্দোলন ছিল খন্ড খন্ড। সে আন্দোলনে রাজনৈতিক চরিত্র ছিলো না, ছিলো না আন্দোলন সংঘটিত করার জন্য নীতি আদর্শ সম্পন্ন নেতৃত্ব ও লক্ষ্যে উদ্দেশ্য। যার জন্য অধিকারের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করার ক্ষেত্রে চিন্তা গড়ে উঠেনি। ফলে বারে বারে জুম্ম জনগণের বুকে নিপীড়ন নেমে এসেছে। কিন্তু মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে জুম্ম জাতীয়তাবাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে জুম্ম জনগণকে একত্রিত করে পরিচালিত আন্দোলন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্যে পূর্ণতা অর্জন করে। স্বাক্ষরিত চুক্তি ২৭ বছরেও বাস্তবায়িত না হওয়ায় আন্দোলনের নতুন এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

শাসক আসে, শাসক যায় তবুও চুক্তি বাস্তবায়িত হয় না। জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে না। বাংলাদেশেও সত্যিকারের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল চেতনাবোধ সম্পন্ন সরকারও গড়ে উঠছে না। ফলে এই চুক্তি বাস্তবায়নের আশায় না থেকে নিজেদের শক্তিতে বলীয়ান হয়েই লড়াই পরিচালনা করতে হবে। বাইরের কেউ এসে চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন এগিয়ে দেবে না।

চারুলতা তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের শাসন কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। এই অঞ্চলের জুম্ম জনগণকে সংবিধানে স্থান না দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের অস্তিত্ব নিধন করার হীন উদ্দেশ্য বাস্তবায়ব্ন করছে।যার দরুন পার্বত্য চট্টগ্রাম এক অনিশ্চিত বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়েছে জুম্মদের অস্তিত্ব হারিয়ে যেতে চলেছে। তরুণ প্রজন্মকে এই কঠিন বাস্তবতাকে অনুধাবন করে চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলনে যোগ দিতে হবে।

সম্মেলনের দ্বিতীয় পর্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য সুমন মারমা। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পিসিপির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রুমেন চাকমা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুবিনা চাকমা৷

আলোচনা সভায় রাঙ্গামাটির জেলা আওতাধীন বিভিন্ন শাখার নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলনে সামিল হওয়ার অঙ্গীকার জানিয়ে প্রতিনিধি বক্তব্যে রাখেন।

আলোচনা শেষে সুমন চাকমাকে সভাপতি, ম্যাগলিন চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক এবং সুনীতি বিকাশ চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত করে ২৭ সদস্য বিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, রাঙ্গামাটি জেলা শাখার কমিটি গঠন করা হয়। নবগঠিত কমিটির শপথ বাক্য পাঠ করান পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সাধারণ সম্পাদক জগদীশ চাকমা।

More From Author