হিল ভয়েস, ১ জানুয়ারি ২০২৫, বিশেষ প্রতিবেদক: ২০২৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের নাজুক সামগ্রিক পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরঞ্চ সার্বিক পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। ২০২৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সেনা-মদদপুষ্ট সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী, মুসলিম সেটেলার ও ভূমিদস্যুদের দ্বারা ২০০টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এসব ঘটনায় ৬,০৫৫ জন জুম্ম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে। এতে ২১ জনকে হত্যা এবং ১১৯টি ঘরবাড়ি ও দোকান অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়েছে। এছাড়া বহিরাগত কোম্পানী, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সেটেলার কর্তৃক ২,৩১৪ একর ভূমি বেদখল করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সহ তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমার স্বাক্ষরিত সমিতির প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য দেয়া হয়েছে।
নিম্নে জনসংহতি সমিতির প্রতিবেদনটি হুবহু দেয়া হলো।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর ২০২৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন
২০২৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের নাজুক সামগ্রিক পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরঞ্চ সার্বিক পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। ২০২৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি সাধিত হয়নি। উপরন্তু পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম অধিকতর জোরদার হয়েছে। ২০২৪ সালে সবচেয়ে নৃশংস ও লোমহর্ষক ঘটনা হলো সেপ্টেম্বরে জুম্ম জনগণের উপর নৃশংস সাম্প্রদায়িক হামলা, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হওয়া এবং ডিসেম্বরে লামায় ত্রিপুরাদের ১৭টি বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া। ড. মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে না হতেই এই নৃশংস সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়। পূর্বের সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোর মতো উক্ত সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের কাউকেই আইনের আওতায় আনা হয়নি এবং উক্ত ঘটনার যথাযথ বিচার নিশ্চিত করা হয়নি।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনের ফলে ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকারের পতন ঘটে এবং এরপর ৮ আগষ্ট ড. মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। গণ-অভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট ছিল বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার মূলোৎপাটনের লক্ষ্যে রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কার। সেই রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী এবং জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী রাষ্ট্রীয় নীতির কোন পরিবর্তন ঘটেনি। ফলে পূর্বের সরকারগুলোর মতো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও জুম্ম জনগণের উপন দমন-পীড়ন, ভূমি বেদখল ও উচ্ছেদ, সাম্প্রদায়িক হামলা ও অগ্নিসংযোগ, অনুপ্রবেশ, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনরত জুম্ম জনগণকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘অবৈধ অস্ত্রধারী’ হিসেবে তকমা দিয়ে ক্রিমিনালাইজ করা, জুম্ম নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ইত্যাদি মানবতা বিরোধী কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ চরম অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে।
২০২৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সেনা-মদদপুষ্ট সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী, মুসলিম বাঙালি সেটেলার ও ভূমিদস্যুদের দ্বারা ২০০টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এসব ঘটনায় ৬,০৫৫ জন জুম্ম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে। এতে ২১ জনকে হত্যা এবং ১১৯টি বাড়ি ও দোকান অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়েছে। এছাড়া বহিরাগত কোম্পানী, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সেটেলার কর্তৃক ২,৩১৪ একর ভূমি বেদখল করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন:
শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে ৩০ এপ্রিল ২০২৪ জাতীয় সংসদ ভবনে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির ৯ম সভা অনুষ্ঠিত হওয়া ছাড়া ২০২৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। উক্ত সভায় অন্যান্যের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের বিধিমালা প্রণয়ন এবং ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিষয়টি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা, পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট বিষয় হস্তান্তর সংক্রান্ত একটি কমিটি গঠন, প্রত্যাহৃত সেনা ক্যাম্পের জায়গায় এপিবিএন মোতায়েনের সিদ্ধান্ত বাতিল করা, বান্দরবানে কেএনএফের তৎপরতা ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু এসব বিষয় বাস্তবায়নের কোন অগ্রগতি ঘটেনি।
ড. মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সাড়ে চার মাসের অধিক সময় অতিবাহিত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। পক্ষান্তরে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন লঙ্ঘন করে পরিষদগুলোর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদেরকে সাময়িক কালের জন্য পরিষদগুলোর প্রশাসক হিসেবে অবৈধভাবে নিয়োগ দেয়া হয়। অন্যদিকে অন্তর্বর্তীকালীন তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ পুনর্গঠনের সময় বহিরাগত সেটেলারদেরকে অন্তর্বর্তী পরিষদের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়, যা ছিল পার্বত্য চুক্তির সরাসরি বরখেলাপ।
বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির স্বাক্ষরের পর ২৭ বছর অতিক্রান্ত হলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সহ দুই-তৃতীয়াংশ ধারা অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান তো অর্জিত হয়ইনি, বরঞ্চ রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক আদিবাসী জুম্ম জনগণের উপর বৈষম্য ও বঞ্চনার স্টিমরোলার অধিকতর জোরদার হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে ব্যাপক সামরিকায়ণ করে ফ্যাসীবাদী কায়দায় দমন-পীড়নের মাধ্যমে সমাধানের নীতি বলবৎ রয়েছে।
সাম্প্রদায়িক হামলা, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকান্ড:
গত আগষ্ট মাসে দেশের ক্ষমতার পালা বদলের পরও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, মন্দির ভাঙচুর, ঘরবাড়ি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট, নৃশংস হত্যাকান্ড, ধর-পাকড় ইত্যাদি অব্যাহত রয়েছে। পক্ষান্তরে তথাকথিত বৈষম্য বিরোধী বাঙালি ছাত্র আন্দোলন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের ব্যানারে মুসলিম সেটেলার এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে লেলিয়ে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা জোরদার করা হয়েছে। অন্যদিকে বান্দরবানের থানচি থেকে আটককৃত ইসলামী জঙ্গী সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র ৯ জন সদস্যকে গত নভেম্বরে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের উপর অন্যতম সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয় গত ১৮-২০ সেপ্টেম্বর দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি সদর ও রাঙ্গামাটি সদরে এবং ১ অক্টোবর খাগড়াছড়ি সদরে। প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর ছত্রছায়ায় মুসলিম সেটেলার কর্তৃক সংঘটিত এসব হামলায় ধন রঞ্জন চাকমা (৫২), জুনান চাকমা (২০), রুবেল ত্রিপুরা (৩০) ও অনিক কুমার চাকমা (১৮) নামে ৪ জন জুম্মকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় এবং শতাধিক জুম্ম আহত হয়। জুম্মদের শতাধিক ঘরবাড়ি, দোকান ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করা হয়। অগ্নিসংযোগের পূর্বে এসব ঘরবাড়ি ও দোকান লুটপাট করা হয়। এছাড়া মৈত্রী বিহার ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে হামলা চালিয়ে ১০টি গাড়ি ভস্মীভূত করা হয় এবং অফিসের গ্রাউন্ড ফ্লোর জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর পৃষ্টপোষকতায় সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের সাম্প্রদায়িক হামলাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে ২১টি সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করা এবং সে লক্ষ্যে জুম্মদের অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা, জুম্মদের ভূমি জবরদখল করা, তাদের চিরায়ত জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদ করা। পূর্বের সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোর মতো উক্ত সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের কাউকেই আইনের আওতায় আনা হয়নি। নিহত অনিক কুমার চাকমার পিতা আদর সেন চাকমা কর্তৃক কোতোয়ালী থানায় দায়েরকৃত হত্যা মামলা এবং আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক দায়েরকৃত অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর মামলায় নামমাত্র ৩/৪ জনকে গ্রেফতার গ্রেফতার করা হলেও ঘটনায় জড়িত মূলহোতারা থাকে ধরাছোয়ার বাইরে।
প্রশাসনের তরফ থেকে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন)-কে প্রধান করে একটি ৭ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও আজ অবধি উক্ত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। অন্যদিকে জনসংহতি সমিতিসহ বিভিন্ন মহল থেকে উক্ত ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করা হলেও সরকারের তরফ থেকে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এ ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি বলবৎ থাকায় পার্বত্য চট্টগ্রামে ধারাবাহিকভাবে সাম্প্রদায়িক হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা সংঘটিত হয়ে আসছে।
সেনা অভিযান, ঘরবাড়ি তল্লাসী, জেল-জুলুম, হত্যা:
২০২৪ সালে নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ১১৯টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে কমপক্ষে ৫,০০০ জন বমসহ ৫,৬৫৫ জন, কমপক্ষে ১,০০০ বম পরিবারসহ ১,৩২১ পরিবার ও ৪৭টি বম গ্রামসহ ৯৪টি গ্রামের লোক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে। তার মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ১৬ জন বমসহ ২০ জনকে, গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলায় জড়িত করা হয়েছে ১৪৩ জনকে, সাময়িক আটক করা হয়েছে ২৮ জনকে, জুম ও বাগান-বাগিচা চাষে বাধা ও ক্ষতি করা হয়েছে ৪২ পরিবারকে, সীমান্ত সংযোগ সড়কে ক্ষতি করা হয়েছে ২৪২ পরিবারকে এবং পারিবারিক তথ্য ও ছবি প্রদানে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ২০টি গ্রামকে।
এসব ঘটনার মধ্যে অন্যতম ঘটনা হচ্ছে কেএনএফ ও ইসলামী জঙ্গী বিরোধী অপারেশনের অজুহাতে পার্বত্য চুক্তিকে লঙ্ঘন করে বান্দরবান জেলার রোয়ংছড়ি, রুমা ও থানচি উপজেলায় সেনাবাহিনীর ১৬টি ও বিজিবির ১টি নতুন অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা। জুলাইয়ে সেনাবাহিনীর নিষেধাজ্ঞার কারণে বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার আদিবাসী বম জনগোষ্ঠীর কয়েক লক্ষ টাকার বিক্রিত ও বিক্রয়যোগ্য পাকা আনারস ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। মে মাসে বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতোমং মারমা তৎসময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্তের গুলিতে হত্যার শিকার হন।
মার্চে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন ব্রিগেডের অধীন ২৬ ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন ব্যাটেলিয়ন কর্তৃক রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থলী-বিলাইছড়ি-জুরাছড়ি সীমান্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণের সময় জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ির সীমান্তবর্তী গাছবাগান পাড়া ও থুম পাড়া নামে দুইটি জুম্ম গ্রামের ২৩ পরিবার জুম্ম উচ্ছেদ ও ১৭ পরিবারকে জুম চাষে বাধা প্রদান করা হয়েছে। পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের মূল উদ্দেশ্যেই সেনাবাহিনী উক্ত দু’টি গ্রাম উচ্ছেদের উদ্যোগ নিয়েছে।
‘ভাগ করো শাসন করো’ ঔপনিবেশিক নীতির ভিত্তিতে সরকারের বিশেষ মহলের মাধ্যমে জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্ছৃঙ্খল, সুবিধাবাদী ও উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিদের নিয়ে একের পর এক সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ গঠন করে দিয়ে এবং তাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ্যে সশস্ত্রভাবে মোতায়েন করে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে চলমান আন্দোলনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে চলেছে। ২০২৪ সালে সেনা-সৃষ্ট এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর মধ্যে মগ পার্টি, বম পার্টি ও ইউপিডিএফ (প্রসিত) কর্তৃক ৪৪টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে ১৭৪ জন ও ৩৬টি গ্রামের অধিবাসী মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার মধ্যে অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, মারধর, হত্যা, গুলিতে আহত, তল্লাসী, হত্যার হুমকি, গবাদিপশু ও মুরগী ছিনতাই, টাকা ও মোবাইল ছিনতাই, চাঁদা দাবি ইত্যাদি ঘটনা ছিল।
সেনা-সৃষ্ট সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ কর্তৃক সংঘটিত সন্ত্রাসী ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো গত ২ ও ৩ এপ্রিল কেএনএফ কর্তৃক রুমা ও থানচিতে ব্যাংক এবং রুমা থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট করা। উপরন্তু উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথবাহিনী কেএনএফের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের দোহাই দিয়ে নারী, শিশু, গর্ভবতী নারীসহ নিরস্ত্র নিরীহ বম গ্রামবাসীদেরকে ধর-পাকড়, শারিরীক নির্যাতন, গ্রেফতার ও জেলে প্রেরণ, কেএনএফ তকমা দিয়ে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এযাবত গুলি করে হত্যা করা হয় একজন শিশুসহ বম জনগোষ্ঠীর ১৬ জনকে এবং গ্রেফতার করা হয় গর্ভবতী নারী ও শিশুসহ ১১১ জন নিরীহ বম গ্রামবাসীকে (কয়েকজন ত্রিপুরাসহ)।
আগস্টে রাঙ্গামাটি শহরে ইউপিডিএফ (প্রসিত) সশস্ত্র হামলা চালায়। এতে কমপক্ষে ১৮ জন আহত ও ২ জন ছাত্রীকে অপহরণ করা হয়। পরে জনগণের চাপে পড়ে অমানুষিক মারধরের পর উক্ত ছাত্রীদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ডিসেম্বরে বাঘাইছড়ির মাজালঙে চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ কর্তৃক ৪ জন ত্রিপুরা গ্রামবাসীকে হুমকি ও বেদম মারধর করা হয়। অন্যদিকে পানছড়ি উপজেলার লোগাং ইউনিয়নের হাতিমারা গ্রামে একটি বিয়ে অনুষ্ঠানে ইউপিডিএফ হঠাৎ হানা দিয়ে ৩ নিরীহ জুম্মকে অপহরণ, ৬-৭ ব্যক্তিকে বেদম মারধর এবং ৫০-৬০ জনের মোবাইল ফোন ছিনতাই করে।
অপরদিকে আগষ্ট মাসে সেনা-মদদপুষ্ট মগ পার্টি’র সন্ত্রাসী কর্তৃক রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থলী উপজেলার বাঙ্গালহালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আদুমং মারমা (৫০) অপহরণের শিকার হন এবং পরে ৫০ লক্ষ টাকার মুক্তিপণ দিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এ ঘটনায় প্রশাসন তরফ থেকে মগ পার্টি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
ভূমি বেদখল, উচ্ছেদ ও অনুপ্রবেশ:
২০২৪ সালে মুসলিম সেটেলার ও ভূমিদস্যু কর্তৃক ২৫টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এতে ২১০ জন জুম্ম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে, ১১৯টি বাড়ি, দোকান ও বুদ্ধ মন্দিরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়েছে এবং ২,৩১৪ একর ভূমি বেদখল করা হয়েছে। আলিকদমে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিম্নে দেয়া গেল-
অক্টোবরে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোকজন নতুন করে বান্দরবান জেলার আলিকদম উপজেলার জঙ্গল ও নদীপথে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করেছে। গত প্রায় এক মাস ধরে অর্থের বিনিময়ে স্থানীয় কিছু দালালের সহযোগিতায় রোহিঙ্গারা আলিকদমে প্রবেশ করছে। অপরদিকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে মুসলিম সেটেলাররা ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিকে ‘মৃত ঘোষণা’ বা ‘অকার্যকর’ করার ষড়যন্ত্র করেছিল।
বান্দরবান জেলার লামার সরই ইউনিয়নে আওয়ামীলীগের সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম কর্তৃক ক্ষমতা অপব্যবহার করে তার স্ত্রী ও আত্মীয়-স্বজনের নামে স্থানীয় জুম্ম ও বাঙালি জনগণের মালিকানাধীন ও ভোগদখলীয় শত শত একর ভূমি বেদখল করা হয়। বর্তমানে তাজুল ইসলাম পলাতক থাকলেও, তার লোকজন ঐ এলাকায় নিয়মিত সশস্ত্রভাবে পাহারা দিচ্ছে এবং স্থানীয় জুম্ম-বাঙালি জনগণকে তাদের ভূমিতে চলাচল ও কাজ করতে বাধা দিচ্ছে। গত ২০ নভেম্বর তাজুল ইসলামের দুর্বৃত্তরা সরই ইউনিয়নের টংগঝিরি এলাকায় স্থানীয় জুম্ম-বাঙালি গ্রামবাসীদের উপর হামলা চালায়। এসব ঘটনার বিরুদ্ধে প্রশাসনের তরফ থেকে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ভূমি বেদখলের উদ্দেশ্যে ভূমি বেদখলকারী কর্তৃক ২৫ ডিসেম্বর বড় দিনের রাতে বান্দরবানে লামার সরই ইউনিয়নের ত্রিপুরাদের ১৭টি পরিবারের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
বান্দরবানের সুয়ালক ও লামার ডুলুছড়িতে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী ও মেয়ের নামে রয়েছে শত একর জমি। এসব জমিতে একসময় অসহায় পরিবারের বসবাস থাকলেও ছলে-বলে-কৌশলে নামমাত্র মূল্যে তাদের জমি বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়। অন্যদিকে লক্ষীছড়ি উপজেলার ২১৭নং জারুলছড়ি মৌজায় সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পের নামে হেডম্যানের স্বাক্ষর সহ প্রত্যয়নপত্র জাল করে CDTO-CRCCII-CCECC-ERECBL CONSORTIUM নামক একটি বহিরাগত কোম্পানি কর্তৃক ১,৭০০ একর ভূমি বেদখলের চেষ্টা করা হচ্ছে। এভাবেই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রশাসনের ছত্রছায়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বেদখল ও স্বভূমি থেকে জুম্মদেরকে উচ্ছেদ করে চলেছে।
যৌন হয়রানি, সহিংসতা, ধর্ষণ ও হত্যা:
২০২৪ সালে মুসলিম সেটেলার কর্তৃক জুম্ম নারী ও শিশুর উপর ১২টি সহিংসতার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে ১৬ জন জুম্ম নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছে। এসব ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও পুলিশেন দুর্বল অভিযোগ গঠন ও ভূমিকার কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা গ্রেপ্তারের কয়েক দিন পরে জামিনে জেল থেকে বের হয়ে যায়। ফলে এ যাবৎ জুম্ম নারী ও শিশুর উপর সংঘটিত কোনো ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়নি। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে জুম্ম নারী ও কন্যাশিশুর উপর অব্যাহতভাবে লোমহর্ষক সহিংসতার ঘটনা সংঘটিত হয়ে আসছে।
গত ২৩ এপ্রিল ২০২৪ রাঙ্গামাটির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট ফাতেমা বেগম মুক্তা বহুল আলোচিত কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি অবশেষে খারিজের আদেশ দিয়েছেন। পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে অপহৃত কল্পনার কোনো হদিশ প্রদান ও অপহরণকারীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের ব্যর্থতা নিয়ে এবং প্রতিবেদনটির উপর বাদীর নারাজি আবেদন নামঞ্জুর করেই আদালত এই মামলাটি অবসানের আদেশ দেন। প্রায় দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে মামলাটি চলার পরও রাঙ্গামাটির প্রশাসন ও বিচার বিভাগ কর্তৃক অপহৃত কল্পনার হদিশ দিতে না পারা এবং অভিযুক্ত চিহ্নিত সেনাবাহিনীর লেঃ ফেরদৌস এবং ভিডিপি সদস্য নূরুল হক ও সালেহ আহমদকে গ্রেপ্তার করে যথাযথ বিচার করার ব্যর্থতা পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান বিচারহীনতার এক চরম দৃষ্টান্ত বৈ কিছু নয়।