হিল ভয়েস, ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, চট্টগ্রাম: আজ ২৪ জানুয়ারি ২০২৫ খ্রি: চট্টগ্রামস্থ পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভা ও ১৯তম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়।
চট্টগ্রাম নগরের বন্দরস্থ ব্যারিষ্টার সুলতান আহমেদ চৌধুরী কলেজের কাঁচাবাজার মাঠ প্রাঙ্গণে আয়োজিত অনুষ্ঠানের সকালের পর্বে কাউন্সিল অধিবেশন এবং দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
বিকালের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, ইপিজেড থানা শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক, রোকন উদ্দিন চৌধুরী মাহমুদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, চট্টগ্রামের সহ-সাধারণ সম্পাদক মোঃ নূরুচ্ছাফা ভূঁইয়া, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, কক্সবাজার জেলার সভাপতি, মংথেলা রাখাইন, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি হ্লামিউ মারমা। এছাড়াও আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরাম, বন্দর থানার সাবেক সভাপতি অরবিন্দু চাকমা, পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরাম, কেন্দ্রীয় কমিটির নারী বিষয়ক সম্পাদক সোনাবী চাকমা প্রমুখ।
পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক জগৎ জ্যোতি চাকমার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিদায়ী কমিটির সভাপতি ডিসান তঞ্চঙ্গ্যা এবং সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাংগঠনিক সম্পাদক সন্তোষ কুমার চাকমা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঊষাতন তালুকদার বলেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় নানা নাগরিক দুর্ভোগ ও অরাজকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও আওয়ামী সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি বন্ধ করে রেখেছিল, যার ফলে পাহাড়েও বিগত দশকে নানা অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়নই পাহাড়ে শান্তি ফেরানোর একমাত্র পথ। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আহ্বান থাকবে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের পথে না হেঁটে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে যেন পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগনের অধিকার নিশ্চিত করে।
রোকন উদ্দিন চৌধুরী মাহমুদ বলেন, রাষ্ট্রসংস্কারের রুপরেখায় বাংলাদেশের প্রতিটি জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি জনগোষ্ঠী রংধনুর এক একটি রং এর সমান। আমরা চাই নতুন বাংলাদেশে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠা করতে।
নূরুচ্ছাফা ভূঁইয়া বলেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও শ্রমিকদের মজুরি খুবই সীমিত৷ একটা দেশের সরকার যেখানে শ্রমিকদের কষ্টার্জিত মজুরি দিতে ব্যর্থ হয় সেখানে বৈষম্য থেকেই যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাহাড়ের অনেক মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে সরকার পরিবর্তন হলেও আদিবাসীদের অধিকার সংবিধানে এখনো লেখা হয়নি। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মানে আদিবাসীদের অধিকার দিতে হবে।
মংথেলা রাখাইন বলেন, আজকে পাহাড়ের পাশাপাশি সমতলেও আদিবাসীদের ভূমি বেদখল চলমান। বিগত সময়গুলোতে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলো পাহাড় ও সমতলে আদিবাসীদের উপর হামলা চালিয়েছে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলেও হামলা হচ্ছে। পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের শান্তিতে রাখতে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
হ্লামিউ মারমা বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু বিগত কয়েক দিন আগে দেখেছি ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’ নামে এক উগ্রবাদী, মৌলবাদী সংগঠন আন্দোলনরত আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে। প্রশাসন এপর্যন্ত দুই জনকে গ্রেফতার করলেও পর্দার অন্তরালে যারা রয়েছে তাদেরকে বিচারের আওতায় এখনো আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তীতে সংবিধানে আদিবাসীদের সঠিক ও যথাযথ অন্তর্ভুক্তি হয়নি। ৭০ এর দশকে পাহাড়ের জুম্ম জনগন যেমন তার অস্তিত্ব মুছে দেওয়ার চেষ্টা রুখে দিয়েছিল ঠিক তেমনি আবারও যদি আমাদের পরিচয় মুছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় বাংলাদেশের আদিবাসী জনগন তা রুখে দিবে।
অরবিন্দু চাকমা বলেন, পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরাম আজ একুশটি বছর অতিক্রম করেছে। নানাবিধ প্রতিকূলতা পার করে পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরাম শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়নের আন্দোলনে ভূমিকা পালন করে এসেছে। শ্রমিক ও মেহনতী মানুষের অধিকার বাস্তবায়নে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
সোনাবী চাকমা বলেন, পাহাড় থেকে শহরে আসা আমাদের ভাইবোনেরা তাদের কষ্টার্জিত অর্থ ভোগ করতে পারে না। শহরাঞ্চলে আদিবাসী শ্রমিক সমাজ নানা অনিরাপত্তা ও জীবন সংকটের মধ্য দিয়ে চলাফেরা করে। বাসায় পৌঁছানোর আগেই অনেক সময় তারা ছিনতাইয়ের শিকার হয়। এদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক্ষেত্রে আরো সচেষ্ট হওয়ার আহ্বান করছি।
স্বাগত বক্তব্যে সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরাম বিগত একুশ বছর ধরে বিরামহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিগত ১৫ বছরে আওয়ামীলীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না করার মাধ্যমে পাহাড়ের প্রতিটি মানুষকে তার কাঙ্ক্ষিত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। বর্তমান সরকারকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগনের অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি সকল মেহনতী শ্রমজীবী মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানাই।
সভাপতির বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আয়োজিত আলোচনা সভার সমাপ্তি ঘটে। আলোচনা সভা পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বন্দরস্থ আদিবাসী শিল্পীবৃন্দের অংশগ্রহণে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
আয়োজিত অনুষ্ঠানের সকালের পর্বে পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিল সভায় জগৎ জ্যোতি চাকমাকে সভাপতি, সন্তোষ কুমার চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক ও সুজল চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করে ২৩ সদস্য বিশিষ্ট ফোরামের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়।
নবনির্বাচিত কমিটিকে শপথ বাক্য পাঠ করান পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য শরৎ জ্যোতি চাকমা।