হিল ভয়েস, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ঢাকা: ৯ম ও ১০ম শ্রেণীর বাংলা ব্যাকরণ বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে “আদিবাসী” শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাতিলের এনসিটিবি’র সিদ্ধান্ত বৈষম্যপূর্ণ ও অপমানকর বলে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম।
আজ বুধবার (১৫ জানুয়ারি) ডা. গজেন্দ্র নাথ মাহাতো, সহ সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এবং হিরন মিত্র চাকমা, তথ্য প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এর যৌথ স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এই ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানায় সংগঠনটি।
বিবৃতিতে বলা হয়, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ৯ম ও ১০ম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে “আদিবাসী” শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাতিলের সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছে এবং এমনতর বৈষম্যপূর্ণ ও অপমানকর সিদ্ধান্তে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
কিছু সংখ্যক উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর দাবির প্রেক্ষিতে এনসিটিবি রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও কর্তৃপক্ষের সাথে কোনরূপ আলাপ না করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ দু:খজনক বলে মনে করে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম। এমন হঠকারি সিদ্ধান্ত দেশের সাম্য, গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় বড় অন্তরায়।
প্রসঙ্গত, ১২ জানুয়ারি ২০২৫ খ্রি: “স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি” নামধারী একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী সংগঠনের কিছু সদস্য পাঠ্যপুস্তকের প্রচ্ছদ থেকে “আদিবাসী” শব্দ বাতিলের দাবিতে এনসিটিবির ভবন ঘেরাও করে এবং প্রশাসনের বাধা উপেক্ষা করে ভবনে প্রবেশ করেন। ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীদের মারমুখী অবস্থানের প্রেক্ষিতে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ কোন যাচাই-বাছাই না করে দাবি মেনে নেয় এবং ঐদিন রাতেই পাঠ্যপুস্তকের অনলাইন ভার্সন থেকে আদিবাসী শব্দ প্রত্যাহার করে নেয়। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) এ ধরনের অযৌক্তিক সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
বাংলাদেশে ৫০ টির অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী স্মরণাতীত কাল থেকে নিজস্ব ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি-কালচার ও ঐহিহ্যকে সমুন্নত রেখে বসবাস করে আসছে। আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানি স্বীকৃতির দাবি দীর্ঘদিনের হলেও আদিবাসীদের এ আত্মপরিচয়কে উগ্র সাম্প্রদায়িক, উগ্র বাঙালি জাত্যাভিমান ও উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক বারংবার অস্বীকৃতি ও পদদলিত করা হয়েছে।
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কর্তৃক ১৯৫৭ সালে আদিবাসী ও ট্রাইবেল জনগণের জন্য ১০৭ নং কনভেনশনে এবং ১৯৮৯ সালের ১৬৯ নং কনভেনশনে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, ভূমি ও ধর্মীয় অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়। আদিবাসী জনগণের আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি, তাদের কৃষ্টি-কালচার, ভাষা-সংস্কৃতিসহ অন্যান্য অধিকার যথাযথভাবে পরিপূরণের লক্ষে ২০০০ সালে জাতিসংঘের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিষদের অধীনে ‘আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম’ গঠিত হয়।
কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এসেও এদেশের আদিবাসীরা তাদের আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি পায়নি। বিগত ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের আদিবাসীদেরকে “উপজাতি, জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়” নামে অভিহিত করেছিল, যা আদিবাসীদের জন্য অপমানজনক ও কষ্টের।
জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান পররবর্তী একটি বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ বির্নিমানের লক্ষে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোতে বিভিন্ন সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শান্তিতে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে।
প্রথমদিকে সরকার আদিবাসীদের প্রতি উদারতা দেখালেও উগ্র ধর্ম্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িক উসকানির কারণে সরকার “আদিবাসী” ইস্যু নিয়ে নিরব অবস্থানে রয়েছে। অথচ আদিবাসীরা আশা করেছিল, নতুন বাংলাদেশে যে সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে সে সরকার আদিবাসীদের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে আদিবাসীদের সঠিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে জানার মধ্য দিয়ে আদিবাসীদের আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি মিলবে এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন পলিসি ম্যাকানিজমে আদিবাসীদের অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্বের নিশ্চিত করা হবে।
জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের সময় যেমনি মুলধারার হাজারো মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ ছিল, তেমনি আদিবাসীরাও এ অভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন এবং অভ্যুত্থান উত্তর সময়েও সক্রিয় রয়েছেন। তথাপি জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বইয়ের নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা ২য় পত্রের প্রচ্ছদ থেকে “আদিবাসী” শব্দ সম্বলিত গ্রাফিতি মুছে ফেলার মধ্য দিয়ে আদিবাসীদের আত্মমর্যাদা ও আত্মপরিচয়কে আরেকবার অপমানিত করা হলো বলে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম মনে করে।
বাংলাদেশ একটি বহু ভাষার, বহু সংস্কৃতির ও বহু বৈচিত্র্যের দেশ। এই বৈচিত্র্যতাকে সম্মান করতে হবে। সে কারণে জুলাই-আগস্ট পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ বির্নিমানের ক্ষেত্রে সকল জাতিসমূহের প্রতিনিধিত্বের যেমনি প্রয়োজন রয়েছে তেমনি তাদের মৌলিক অধিকারকে স্বীকৃতিও জরুরী। দেশের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে দেশ পরিপূর্ণভাবে এগিয়ে যেতে পারে না।
সুতরাং সংবিধানের দোহাই দিয়ে পাঠ্যপুস্তকে “আদিবাসী” শব্দ সম্বলিত গ্রাফিতি বাতিল করা মানে জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার পরিপন্থী এবং উগ্র সম্প্রদায়িক, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও মৌলবাদীর গোষ্ঠীর কাছে আপোষের সামিল। কাজেই, আসম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে চাইলে আদিবাসীদের আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতিসহ নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে “আদিবাসী” শব্দ সম্বলিত গ্রাফিতি পুণর্বহাল এবং আদিবাসীদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সঠিকভাবে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা এবং আদিবাসীদের মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতিসহ আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষে যথাযথ প্রদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকট জোর দাবি জানিয়েছে।