হিল ভয়েস, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ঢাকা: ঢাকায় এনসিটিবির সামনে ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’র উপর ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’ ব্যানারে মুসলিম সেটেলার ও মৌলবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক পরিকল্পিত হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ করেছে দেশের বিভিন্ন সংগঠন। নিন্দা ও প্রতিবাদীকারী এসব সংগঠনের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদ, মানুষের জন্য ফাইন্ডেশন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, বাংলাদেশ খ্রীষ্টান এসোসিয়েশন, জাতীয় নাগরিক কমিটি, বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন (বাগাছাস), বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, কাপেং ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা ষ্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার ফোরাম।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদ বলেছে যে, আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা নিন্দনীয় ও দুর্ভাগ্যজনক। ঢাকার পাঠ্যপুস্তক ভবনের সামনে বিক্ষোভরত আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উপর হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলা হয়, নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চিত্রকর্ম বা গ্রাফিতি বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে দেশের যে কোনো নাগরিকের বিক্ষোভের অধিকার প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক অধিকার এবং তা গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা সংরক্ষনের সাথে সংগতিপূর্ন। এহেন চেতনা সংরক্ষনের দাবিতে গড়ে ওঠা শান্তিপূর্ন বিক্ষোভের উপর হামলা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয় ও দুর্ভাগ্যজনক এবং তা বিক্ষোভকারীদের ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপের শামিল, যা বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করবে। বিবৃতিতে হামলায় আহতদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানানো হয়েছে।
পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দসংবলিত গ্রাফিতি বাদ দেয়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভকারী আদিবাসী শিক্ষার্থী-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)। বুধবার (১৫ জানুয়ারি) এক বিবৃতিতে সংগঠনটি তাদের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানায়। এ ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়ে এমজেএফ-এর নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ‘আমরা আদিবাসীদের ন্যায্য দাবির প্রতি সমর্থন জানাচ্ছি এবং একই সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি এই ন্যাক্কারজনক হামলায় জড়িতদের গ্রেপ্তার ও বিচারের জোর দাবি জানাচ্ছি।’
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম আদিবাসী ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশে ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’-এর সদস্যদের সহিংস আক্রমণের নিন্দা জানিয়েছে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামও এনসিটিবি কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তকে দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করে, যা কিছু উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১২ জানুয়ারী ২০২৫ তারিখে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং কর্তৃপক্ষের সাথে কোনও আলোচনা ছাড়াই নবম-দশম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দটি অপসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছে, এই ধরণের বৈষম্যমূলক ও অপমানজনক সিদ্ধান্তের তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ প্রকাশ করে এবং এই আক্রমণে জড়িতদের শাস্তি দাবি করেছে।
ঢাকার মতিঝিলে পাঠ্যপুস্তক ভবনের সামনে বিক্ষোভরত আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উপর নিষ্ঠুর হামলার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ খ্রীষ্টান এসোসিয়েশন। এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মিঃ নির্মল রোজারিও ও মহাসচিব মিঃ হেমন্ত আই. কোড়াইয়া একযুক্ত বিবৃতিতে এই প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন। সাম্প্রতিক নবম-দশম শ্রেনীর পাঠ্যপুস্তক থেকে আদিবাসী শব্দযুক্ত জুলাই-আগষ্ট গণ-অভ্যুত্থানের চিত্রকর্ম বা গ্রাফিতি বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে দেশের যে কোন নাগরিকের বিক্ষোভের অধিকার প্রকৃত পক্ষে গণতান্ত্রিক অধিকার এবং তা গণঅভ্যুত্থানের চেতনা সংরক্ষণের সাথে সংগতিপূর্ণ। এই হেন চেতনা সংরক্ষণের দাবিতে গড়ে ওঠা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের উপর হামলা নিঃসন্দেহে দূর্ভাগ্যজনক ও নিন্দনীয়। এ বিষয়ে তদন্তপূর্বক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানিয়েছেন নেতৃবৃন্দ। একই সাথে তাঁরা হামলায় আহতদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে তাদের সুস্থ্যতা কামনা করেছেন।
বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন (বাগাছাস) আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উপর সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদ ও বিচার দাবি চেয়ে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর দেয়া প্রতিবাদলিপিতে বলেছে যে, “আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে জানাতে চাই যে আজ ঢাকার মতিঝিলে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উপর পরিকল্পিত সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়েছে। এই হামলায় রড, লাঠি ও স্ট্যাম্প দিয়ে নির্বিচারে আঘাত হেনে আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রীদের আহত করা হয়েছে। আজ এনসিটিবি ভবনের সামনে নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দসংবলিত গ্রাফিতি অপসারণের প্রতিবাদে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে আদিবাসী শিক্ষার্থীরা এই হামলার শিকার হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ‘স্টুডেন্ট ফর সোভারিনিটি’ নামে একটি উগ্রবাদী সংগঠনের সদস্যরা পরিকল্পিতভাবে জাতীয় পতাকা বাঁধা ক্রিকেট স্ট্যাম্প ও লাঠি নিয়ে এই হামলা চালিয়েছে। এই হামলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নির্বাহী কমিটির সদস্য রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা সহ ১৪ জন আদিবাসী ছাত্রনেতা, সাধারণ শিক্ষার্থী, নারী এবং সাংবাদিকও আহত হয়েছেন।
এনসিটিবির সামনে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উপর সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা ও বিচার দাবি করেছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি মাহির শাহরিয়ার রেজা এবং সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন শুভ এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, পাঠ্যপুস্তক থেকে আদিবাসী শব্দ সম্বলিত গ্রাফিতি এবং আদিবাসী শব্দের স্থলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শব্দ ব্যবহারের প্রতিবাদে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)’র সামনে আজ (১৫ জানুয়ারি, ২০২৫) আদিবাসী শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে হামলা করেছে স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি নামক সংগঠন। এতে বেশ কয়েকজন আদিবাসী শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়েছেন। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উপর সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানায়। একইসাথে সন্ত্রাসী হামলাকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন।
কাপেং ফাউন্ডেশন ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’ ব্যানারে সেটেলার বাঙালি ও মৌলবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক আদিবাসী ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের উপরসহিংস আক্রমণের নিন্দা জানিয়েছে।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদ বলেছে যে, আজ (১৫ জানুয়ারি) বুধবার দুপুরে মতিঝিলে পাঠ্যপুস্তকের প্রচ্ছদের “আদিবাসী” শব্দ সম্বলিত গ্রাফিতি বাতিলের প্রতিবাদ এবং গ্রাফিতিটি বহালের দাবিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ঘেরাও কর্মসূচির মিছিলে “স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়” নামক সাম্প্রদায়িক সংগঠন কর্তৃক ক্রিকেট স্ট্যাম্প ও লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালানো হয়। আদিবাসীদের বাদ রেখে ও নিশ্চিহ্ন করে বৈষম্যহীন অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব নয়। অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়তে পাঠ্যপুস্তকে “আদিবাসী” শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বহাল, পাঠ্যপুস্তকে আদিবাসীদের সংগ্রামের যথাযথ ইতিহাস, আত্মপরিচয় সম্পর্কিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত, এবং আদিবাসী শিক্ষার্থীদের মিছিলে হামলায় জড়িত সকলকে দ্রুত আইনের আওতায় এনে শাস্তির দাবি জানিয়ে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ।
বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা ষ্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার ফোরাম বলেছে যে, আজ (১৫ জানুয়ারি) ঢাকাস্থ এনসিটিবি ভবনের সামনে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের একটি শান্তিপূর্ণ মিছিল এবং প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল নবম-দশম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে “আদিবাসী” শব্দটি পুনর্বহাল করা। কিন্তু, অত্যন্ত দুঃখজনক হলো, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারী আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায়। এটি স্পষ্ট যে, আদিবাসী জনগণের সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা বিষয়ক দাবি পূরণের অধিকার তাদের মৌলিক অধিকার এবং তাদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে হামলা চালিয়ে তাদের এই অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে দমিয়ে রাখা যাবে না। হামলার ঘটনা আমাদের দেশের বহুত্ববাদী সমাজের মূল মূল্যবোধের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক এবং এটি আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি এক গভীর আঘাত।