হিল ভয়েস, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, চবি: আজ ১৬ জানুয়ারি আদিবাসী ছাত্র-জনতার এনসিটিবি ভবন ঘেরাও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি নামক উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে এবং অবিলম্বে দোষীদের গ্রেফতারপূর্বক যথাযথ বিচারের দাবিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আদিবাসী শিক্ষার্থীবৃন্দের উদ্যোগে এক প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আজ সকাল ১১ ঘটিকায় শুরু হয়।
চবির শিক্ষার্থী জাল্লাং এনরিকো মারাকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষার্থী ভুবন চাকমা এবং সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য রাখেন চবি শিক্ষার্থী সানুবাই মারমা।
অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ(পিসিপি) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি অন্তর চাকমা, ত্রিপুরা স্টুডেন্ট ফোরাম(টিএসএফ), চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি পাভেল ত্রিপুরা, রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক পহেলা চাকমা, চবির শিক্ষার্থী ভুবন চাকমা, বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার ফোরাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক সুখীজয় তঞ্চঙ্গ্যা, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, চবি সংসদের শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক মোহাম্মদ সোহেল রানা, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্ট কাউন্সিল(বিএমএসসি), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক সাথুঅং মারমা, চবির শিক্ষার্থী ফুংপ্রে ম্রো, মাছেন হ্লা রাখাইন, ধনরঞ্জন ত্রিপুরা প্রমুখ।
অন্তর চাকমা বলেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ফুটিয়ে তুলতে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করতে আদিবাসী সম্বলিত গ্রাফিতি বইয়ে যোগ করা হয়েছিলো। গ্রাফিতি বাতিল করে প্রশাসন দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে । আদিবাসীদের উপর হামলা পরিকল্পিত ছিলো। প্রশাসনের সম্মূখে আদিবাসীদের উপর হামলা ন্যাক্কারজনক। হামলার সাথে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার হলেও মূল হোতারা ধরাছোয়ার বাইরে রয়েছে। তাদের সকলকে বিচারের আওতায় আনতে হবে এবং সংবিধান সংস্কারের যে সুপারিশ করা হয়েছে সেখানে আদিবাসীদের যুক্ত করতে হবে। আদিবাসীদের অধিকারকে অবহেলা করা হলে সংগ্রাম আরও দীর্ঘতম ও কঠোর হবে ।
পাভেল ত্রিপুরা বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক পরিবেশের প্রত্যাশা করেছিলাম। গত ১৫ জানুয়ারি আদিবাসীদের উপর যে জঙ্গী কায়দায় হামলা করা হয়েছে সেই স্টুডেন্ট ফর সোভারেন্টি সংগঠনকে সন্ত্রাসী বলা হয় না কেন? আদিবাসী জনগণ সবসময় একতাবদ্ধ ছিল। হামলা, দমন-পীড়ন করে আদিবাসীদের থামানো যাবেনা ।
পহেলা চাকমা বলেন, রাষ্ট্র আমাদের পরিচয় নির্ধারন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই আমাদের বারবার পরিচয়ের দাবিতে দাঁড়াতে হয়। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সেটেলাররা পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধভাবে বসতি স্থাপন করেছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফলে সেটেলাররা বারবার হামলা করার উৎসাহ পায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত এই ধরনের হামলা সংঘটিত হয়। আমরা যখন অধিকারের কথা বলি তখনি সন্ত্রাসী ত্যাগ দেওয়া হয়। দেশের সকল সচেতন গণতান্ত্রিক চেতনাশীল নাগরিকদের এ বিষয়ে আওয়াজ তুলতে হবে।
ভুবন চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জাতিগত সংখ্যালঘুরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে থেকেই নিপীড়ন, বঞ্চণার শিকার হয়ে আসছে। অধিকার চাইতে গিয়ে তারা আমাদের সন্ত্রাসী বিচ্ছিন্নতাবাদী বলেছে, কিন্তু আমরা কোনদিনই বিচ্ছিন্ন হতে চাইনি। আমরা যদি বিচ্ছিন্ন হতে চাইতাম তাহলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতাম না। অতিদ্রুত আমাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি জানাচ্ছি।
সুখীজয় তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, উগ্র মৌলবাদী সেটেলার কর্তৃক ঢাকায় আদিবাসী জনতার সমাবেশে আদিবাসী অধিকার কর্মীদের উপর হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। আদিবাসী শব্দ সম্বলিত গ্রাফিতির বিরুদ্ধে যারা কথা বলে মিথ্যাচার করে তারা আসলে জুলাই অভ্যুত্থান ও অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন বাংলাদেশের চেতনাকে ধারণ করেনা। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এসেও আজ আমাদের ভূমি অধিকারের দাবি, আমাদের অস্তিত্বের দাবি নিয়ে কথা বলতে হয়। এনসিটিবি কর্তৃক আদিবাসী শব্দ পূণর্বহাল করার দাবি জানাই।
মোহাম্মদ সোহেল রানা বলেন, বাংলাদেশে বাঙালির পাশাপাশি যেসকল আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করছে, তারা আজ অধিকারহীন, নিপীড়িত-নির্যাতিত। জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে আমরা যে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি সেখানে আদিবাসীদের যথাযথ অন্তর্ভুক্তি দেখতে পাচ্ছিনা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আদিবাসীদের নায্য অধিকার সুরক্ষা করার দাবি জানাই।
সাথুঅং মারমা বলেন, আদিবাসী শব্দ সম্বলিত গ্রাফিতি একটি গনতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনাকে ধারণ করে কিন্তু একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর উগ্র জাত্যভিমানী মনোভাব বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনে অন্তরায়। স্বাধীনতার এত বছর পরও আজ রাষ্ট্রের কাছে আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতির জন্য আদিবাসী জনগণকে লড়তে হচ্ছে। ঢাকায় আদিবাসী ছাত্র জনতার শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে প্রশাসনের উপস্থিতিতে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কর্তৃক হামলার তীব্র নিন্দা জানাই।
মাছেন হ্লা রাখাইন বলেন, আদিবাসী জনগণ সবসময় এই রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত হতে চাই, আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়। জুলাই আন্দোলন পরবর্তী আদিবাসী জনগণ আশা করেছিলো নতুন বাংলাদেশে তাদের অধিকার সংরক্ষিত হবে। কিন্তু আমরা সেটা পাইনি। রাষ্ট্র বরাবরই আদিবাসী জনগণের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ করেছে এখনো করছে।
ফুংপ্রে ম্রো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে উগ্র সাম্প্রদায়িক মনোভাব পোষণকারী সেটেলারদের আপত্তিতে পাঠ্যপুস্তক বই থেকে আদিবাসী শব্দ বাতিলের জন্য তীব্র নিন্দা জানাই। জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় তা এখানে পুরোপুরি ব্যর্থ। নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্য পুস্তক বই থেকে বাতিল করা আদিবাসী প্রচ্ছদ পূর্ণবহাল রাখার দাবি জানাই।
ধন রঞ্জন ত্রিপুরা বলেন, আদিবাসীদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে উগ্র মৌলবাদীদের ন্যাক্কারজনক হামলা আদিবাসীদের নিয়ে সরকার তথা রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিকে ইঙ্গিত করে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্তি চায়, কিন্তু এই সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠী তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে তৎপর। এছাড়াও তিনি আদিবাসী ছাত্র জনতার ওপর হামলাকারীদের দ্রুত বিচারের দাবি ব্যক্ত করেন।
সভাপতির বক্তব্যে ভুবন চাকমা বলেন, আমরা জুলাই আন্দোলন পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে আদিবাসী ও বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম। যেখানে আদিবাসীদের অধিকার ও আত্মপরিচয় স্বীকৃত হবে। কিন্তু এই রাষ্ট্র আদিবাসী জনগণের ওপর আরও শোষণ-নিপীড়ন চাপিয়ে দিয়েছে।
আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানাই এবং ঢাকায় আদিবাসী ছাত্র জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর নৃশংস হামলার সুষ্ঠু বিচার ও অপরাধীদের শাস্তির দাবি জানাই।
সভাপতি বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশটি শেষ হয়। সমাবেশ পরবর্তীতে একটি মিছিলের আয়োজন করা হয়। মিছিলটি শহীদ মিনার হতে কলার ঝুপড়ি দিয়ে প্রশাসনিক ভবন হয়ে আবার শহীদ মিনারে এসে সমাপ্ত হয়।