রবি ত্রিপুরা
হিল ভয়েস, ৯ ডিসেম্বর ২০২৪: পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে ভুলিয়ে দেয়ার জন্য চলছে চতুর্মুখী ষড়যন্ত্র। এক পক্ষ চাচ্ছে চুক্তি যতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তাতেই চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শেষ করে দিয়ে চুক্তিকে বিকলাঙ্গ করে দিতে। আরেক পক্ষ চাচ্ছে চুক্তিকে অপূর্ণাঙ্গ ও আপোষ চুক্তি লেবেল দিয়ে চুক্তিকে পুরোপুরি বাদ দিতে। এই দু’টি পক্ষের ষড়যন্ত্রে আপাত দৃষ্টিতে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও কার্যত তাদের লক্ষ্য একই সূত্রে গাঁথা। আর তাদের লক্ষ্য হলো চুক্তিকে জনগণ থেকে চিরতরে বিস্মৃত হতে দিয়ে নিজেদের কায়েমী স্বার্থ হাসিল করা।
এক পক্ষের মধ্যে রয়েছে সরকার, সেনাবাহিনী, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী, মৌলবাদী গোষ্ঠী। এদের মধ্যে অগ্রভাগে রয়েছে সরকার ও সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী সরকারেরই অঙ্গ হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় তারা সরকারের চেয়ে অধিকতর কর্তৃত্বশালী। তাদের চরিত্র মূলত প্রবঞ্চনা ও প্রতারণামূলক। সেনাবাহিনীর সম্মতি সাপেক্ষে ১৯৯৭ সালে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার চুক্তি স্বাক্ষর করলেও সেনাবাহিনী কখনোই চুক্তিতে স্বীকৃত অধিকার জুম্ম জনগণকে দিতে চায়নি। অন্যদিকে সরকার পক্ষও চুক্তিটি স্বাক্ষরের পর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার গোড়াতেই প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে।
আওয়ামীলীগ ছিল বরাবরই একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল। ফলত শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ কখনোই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনতান্ত্রিক অধিকারকে স্বীকার করেনি। বলাবাহুল্য, ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় তৎকালীন গণপরিষদের সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের স্বতন্ত্র পরিচয় ও কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে তুলে ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য বিশেষ শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির জন্য জোরালো দাবি তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান জুম্ম জনগণের সেই দাবির বিপরীতে কয়েক লক্ষ মুসলিম বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশের হুমকি দিয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ সরকার বাস্তবায়ন করেছিলেন।
শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন পরবর্তী আওয়ামীলীগও সেই উগ্র জাতীয়তাবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে তা ভাবার কোন অবকাশ নেই। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার, অর্থনৈতিক ও ভূমি অধিকার, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার স্বীকার করে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করলেও শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকারের তলে তলে ছিল প্রতারণার ফন্দি। শেখ হাসিনা সরকার ঠিকই চুক্তিতে সেসব অধিকার স্বীকার করে নিয়েছিল বটে, কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষর করলেও শাসনতান্ত্রিক অধিকার, অর্থনৈতিক ও ভূমি অধিকার, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সংক্রান্ত চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো বাস্তবায়নের বাইরে রাখবে। তাই চুক্তি স্বাক্ষরের পর যতই দিন যেতে থাকে ততই শেখ হাসিনা সরকারের সেই ছল-ছাতুরি প্রকাশ পেতে থাকে এবং বুলিতে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্ম নিরপেক্ষতার খোলস ভেঙ্গে পড়তে থাকে।
ফলে শেখ হাসিনা সরকার চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ বাস্তবায়নের পর বাকী দুই-তৃতীয়াংশসহ চুক্তির মৌলিক ইস্যুগুলো বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। চুক্তির অবশিষ্টাংশ বাস্তবায়ন না করার লক্ষ্যে শেখ হাসিনা সরকার একতরফাভাবে প্রথমে ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে বলে অপপ্রচার করে এবং সর্বশেষ প্রচার করে যে, ৭২টি ধারার মধ্যে ৬৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের এই অপপ্রচারের মূল টার্গেট হচ্ছে চুক্তির অবাস্তবায়িত দুই-তৃতীয়াংশ ধারাসহ চুক্তির মৌলিক ইস্যুগুলো জনগণের মন থেকে ভুলিয়ে দেয়া। মূল কথা হচ্ছে শাসনতান্ত্রিক অধিকার, অর্থনৈতিক ও ভূমি অধিকার, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সংক্রান্ত চুক্তির মৌলিক ইস্যু বাস্তবায়ন না করে চুক্তিকে বিকলাঙ্গ করে দেয়া।
সেনাবাহিনী রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যতম অঙ্গ হলেও অগ্রভাগে থেকে সরকারের চেয়ে অধিক জোরালোভাবে চুক্তি বিরোধী ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে থাকে। জনসভা আয়োজন করে, হেডম্যান-কার্বারী-জনপ্রতিনিধিদের সম্মেলন ডেকে, র্যালী-সেমিনারে অংশগ্রহণ করে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী বক্তব্য ও মতামত দিতে থাকেন সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। কর্মরত অবস্থায়ও অনেক সেনা কর্মকর্তা সরকারের স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ফিচার লিখে প্রচার করতে থাকে। সেনাবাহিনী চুক্তির বিরুদ্ধে অপপ্রচারের উদ্দেশ্যে শান্তকরণ প্রকল্পের অধীনে অনেক উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক সাংবাদিকদেরকে লোকেল সংবাদপত্র প্রকাশ ও অনলাইন নিউজপোর্টাল চালানোর জন্য অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে। ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ’ গঠন করে দিয়ে মুসলিম সেটেলারদের সংগঠিত করে পার্বত্য চুক্তির বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে থাকে। জুম্মদের মধ্য থেকে সুবিধাবাদী ও দালালদের নিয়ে একের পর এক সশস্ত্র গ্রুপ গঠন করে দিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে চলমান আন্দোলনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে থাকে। কতিপয় সেটেলারকে দিয়ে পার্বত্য চুক্তির বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার উদ্যোগ নিতে থাকে।
এই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পক্ষ– সরকার, সেনাবাহিনী, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী, মৌলবাদী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র, যারা প্রতিনিয়ত ষড়যন্ত্র করে আসছে চুক্তিকে চিরতরে ভুলিয়ে দেয়ার জন্য।
অপর পক্ষে রয়েছে অতি বিপ্লবী ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফের অভিভাবক কতিপয় বাম রাজনৈতিক দল, দেশে-বিদেশে বসবাসকারী কতিপয় স্বঘোষিত মানবাধিকার কর্মী ও পোষাকি দেশপ্রেমিক। গোড়া থেকেই ইউপিডিএফ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য চুক্তির বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে। তারা চুক্তি স্বাক্ষরকারী তথা চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনরত জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকদের উপর হামলা, আক্রমণ, অপহরণ, হত্যা করে চলেছে।
পার্বত্য চুক্তিকে ভন্ডুল করার জন্য ইউপিডিএফ চুক্তিকে কখনো অসম্পূর্ণ চুক্তি, কখনো আপোষ চুক্তি, কখনো মুলা চুক্তি, মৃত চুক্তি, ‘বহ জিইয়ে’ চুক্তি ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করে আসছে। সম্প্রতি ইউপিডিএফের মাইকেল চাকমা ও অংগ্য মারমা পার্বত্য চুক্তিকে ‘অপূর্ণাঙ্গ’ চুক্তি হিসেবে অভিহিত করে নতুন চুক্তি করতে হবে বলে মামার বাড়ির আবদার করেছে। বলা যায় ইউপিডিএফও এখন দ্বিতীয় চুক্তির মুলা বিক্রি করতে উদগ্রীব হয়েছে।
বস্তুত চুক্তির বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে নানা ধরনের অভিধায় অভিহিত করলেও আবার চুক্তির সুবিধা নিতেও উঠে পড়ে লেগে থাকতে দেখা যায় ইউপিডিএফ’কে। এবারে অন্তর্বর্ন্তী সরকার কর্তৃক তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ পুনর্গঠনের সময় তাদের সমর্থিত লোকদের নিয়োগ পেতে ইউপিডিএফ’কে আদাজল খেতে দেখা গেছে। সম্প্রতি আবার পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ পুনর্গঠনের দাবি তুলে ধরতে দেখা গেছে। ফাঁকে আঞ্চলিক পরিষদের গদিতে বসার সুযোগ পাওয়া যায় কিনা সেই টার্গেট নিয়ে ইউপিডিএফ এমন দাবি উত্থাপন করছে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। আমি পুঁটি মাছ খাই না, তবে পুঁটি মাছের ঝোল খাই– এর মতো অবস্থা ইউপিডিএফের।
বিদেশে অবস্থানরত ইউপিডিএফ সমর্থিত এক স্বঘোষিত মানবাধিকার কর্মী সম্প্রতি প্রচারে লিপ্ত হয়েছে যে, চুক্তিটি নাকি বাতিল হয়ে গেছে। তার ভাষ্য, ২০১০ সালে হাই কোর্ট পার্বত্য চুক্তিটি বাতিল করেছে। হাই কোর্টের রায় মান্য করা ছাড়া সরকারের কিছুই করার থাকে না। তাই চুক্তিটি বাতিল হয়ে গেছে। এমনকি তিনি এও বলেছেন, হাই কোর্টের রায়ে যে চুক্তিটি বাতিল হয়ে গেছে– একথাটি নাকি কেউ বলেও না। বলাবাহুল্য যে, হাই কোর্টের উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে আপীল আবেদন করা হয়েছে এবং উক্ত আপীল আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আপীল বিভাগ হাই কোর্টের উক্ত রায়কে স্থগিত করেছে।
ইউপিডিএফের চুক্তি বিরোধী এসব অপচেষ্টা কিংবা চুক্তিকে হেয় করে নানা অভিধায় অভিহিত করার মূল লক্ষ্যই হলো পার্বত্য চুক্তিকে জনমন থেকে ভুলিয়ে দেয়া। এর মূল কথা হচ্ছে চুক্তিকে চিরতরে ধ্বংস করে দেয়া। এটা নিঃসন্দেহে ইউপিডিএফের একটা আত্মঘাতী কাজ। চুক্তি মোতাবেক আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে এটা জুম্ম জনগণেরই অধিকার অর্জন। কিন্তু এর বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে ইউপিডিএফ। ভূমি কমিশনের মাধ্যমে জুম্মরা তাদের বেহাত হওয়া জায়গা-জমি ফেরত পেলে এটা জুম্মদেরই লাভ। কিন্তু ইউপিডিএফ চুক্তি বিরোধিতা করে তা ভন্ডুল করে দিতে চায়। বস্তুত ইউপিডিএফ নিজেও শাসকগোষ্ঠী থেকে কোন কিছু আদায় করতে পারবে না, অপরদিকে জনসংহতি সমিতি যা আদায় করেছে তার বাস্তবায়নেও তারা বাধাগ্রস্ত করবেই– এটাই হচ্ছে ইউপিডিএফের নানা হঠকারী কাজের একটি অন্যতম উদাহরণ।