পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কেন জরুরী

মঙ্গল কুমার চাকমা

পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা হচ্ছে একটি রাজনৈতিক ও জাতীয় সমস্যা। বস্তুত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই দেশের শাসকগোষ্ঠীর উগ্র জাত্যাভিমানী ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ফসল হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের এই সমস্যা। এই সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আজ ২৭ বছর অতিক্রান্ত হলেও চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় এখনো অর্জিত হয়নি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার কাক্সিক্ষত রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান। পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে সরকার অগণতান্ত্রিক ও ঔপনিবেশিক কায়দায় জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব বিলুপ্তি ও দমন-পীড়নের নীতি গ্রহণ করে চলেছে। ফলে পার্বত্যাঞ্চলের পরিস্থিতি দিন দিন সংঘাতপূর্ণ ও সহিংস হয়ে উঠছে। এই চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও জাতীয় সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের, পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও বৈষম্য অবসানের, সর্বোপরি পার্বত্যাঞ্চলের শান্তি ও উন্নয়নের যে অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, সেই ঐতিহাসিক সুযোগ দিন দিন ধুলিস্যাৎ হতে বসেছে।

১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাঁচটি রাজনৈতিক সরকার এবং দুইটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে কোন সরকারই রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসেনি। গত জুলাই-আগষ্টে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে ৫ই আগষ্ট শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকারের পতন ঘটে। এরপর ৮ই আগষ্ট ড. মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর আজ চার মাস অতিক্রান্ত হলেও সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের এখনো কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির স্বাক্ষরের পর ২৭ বছর অতিক্রান্ত হলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সহ দুই-তৃতীয়াংশ ধারা অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে।

পার্বত্যবাসী আশা করেছিল যে, চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও হানাহানি বন্ধ হবে। পার্বত্য সমস্যার শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের ক্ষেত্রে বিশ্বে এ চুক্তি একটি অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে অর্জিত হবে পারস্পরিক আস্থা, সহযোগিতা আর সহনশীলতা। জুম্ম জনগণ আর বিনাবিচারে জেল-জুলুম, নিপীড়ন-নির্যাতন, অবৈধ গ্রেফতার, খুন, হয়রানি, সহিংসতার শিকার হবে না। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের নাগরিকদের মতো পার্বত্যবাসীও নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা পাবে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় জুম্ম জনগণ তথা পার্বত্যবাসী এখনো লাভ করেনি সেই গণতান্ত্রিক শাসন ও অত্যাচার-উৎপীড়নমুক্ত নিরাপদ জীবন। পার্বত্য জনপদে ফিরে আসেনি শান্তি ও স্বস্তি। বরঞ্চ পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি চুক্তি-পূর্ব অবস্থার মতো দিন দিন সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি-উত্তর সময়ে একের পর এক সরকার সম্পূর্ণভাবে পার্বত্য চুক্তির উল্টোপথে তথা চুক্তি-পূর্ব অবস্থার মতো পার্বত্য সমস্যাকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে সমাধানের আগ্রাসী ও বলপ্রয়োগের পথে হাঁটছে। তারই অংশ হিসেবে সরকারগুলো পূর্ববর্তী স্বৈরশাসকদের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন দমন-পীড়ন করে আসছে। অন্যদিকে পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, বিচারব্যবস্থা, উন্নয়ন কার্যক্রমসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল বিষয় ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর ক্ষমতাবলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে, যা পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক শাসন তথা আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনে অন্যতম বাধা হিসেবে কাজ করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম হিসেবে ক্রিমিনালাইজ করার জন্য সরকারের প্রভাবশালী বিশেষ মহল নানা ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে আন্দোলনরত অধিকারকর্মী ও জনগণকে সুপরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদেরকে অবৈধ গ্রেফতার, বিচার-বহির্ভুত হত্যা, অস্ত্র গুঁজে দিয়ে আটক, মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে প্রেরণ, মারধর, হয়রানি ইত্যাদি ফ্যাসীবাদী কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।

সরকারগুলো কেবল এধরনের চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রমের মধ্যেই ক্ষান্ত থাকেনি, ‘ভাগ করো শাসন করো’ ঔপনিবেশিক নীতির ভিত্তিতে সরকারের বিশেষ মহলের মাধ্যমে জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্ছৃঙ্খল, সুবিধাবাদী ও উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিদের নিয়ে একের পর সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ গঠন করে দিয়ে এবং তাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ্যে সশস্ত্রভাবে মোতায়েন করে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তথা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে চলমান আন্দোলনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে চলেছে।

বস্তুত সরকারের মদদে এভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিশেষ মহল একদিকে এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে লালন-পালন ও মদদ দিয়ে এলাকায় ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছে, অপরদিকে সন্ত্রাসী দমনের নামে জুম্ম জনগণের উপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামীলীগসহ জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোতে যুক্ত জুম্মদের সুবিধাবাদী, ক্ষমতালিপ্সু ও তাঁবেদার লোকদেরকে মদদ দিয়ে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও উত্তেজনা নিরসনের পরিবর্তে নিজেদের কায়েমী স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য পূর্ববর্তী সরকারগুলো কর্তৃক পরিকল্পিতভাবে পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে উস্কে দিয়ে বর্তমানে সাম্প্রদায়িক বিভেদমূলক প্ররোচনা আরো জোরদার করা হয়েছে। চুক্তি-উত্তর সময়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিশেষ মহল ও ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর পৃষ্টপোষকতায় সেটেলার বাঙালি কর্তৃক গত ১৮, ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বরে এবং ১ অক্টোবরে দীঘিনালা-খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটিতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলা ও অগ্নিসংযোগসহ জুম্ম জনগণের উপর এপর্যন্ত ২১টি সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। অধিকন্তু সেটেলার বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ নামক একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠনে সংগঠিত করে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী কার্যক্রম, ভূমি বেদখল, রোহিঙ্গাসহ বহিরাগত অনুপ্রবেশ ও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তিকরণ, সাম্প্রদায়িক হামলা ইত্যাদি তৎপরতায় লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে।

বস্তুত পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে সরকার সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্র কাজে লাগিয়ে সর্বাত্মকভাবে জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের নীলনক্সা বাস্তবায়ন করে চলেছে। তারই অংশ হিসেবে উন্নয়ন কার্যক্রমকেও জাতিগত নির্মূলীকরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে জুম্মদেরকে তাদের চিরায়ত জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদকরণ, অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়া, এলাকার জীব-বৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। জুম্ম জনগণের সংস্কৃতি-বিধ্বংসী ও পরিবেশ-পরিপন্থী এসব উন্নয়ন কার্যক্রমের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রিজার্ভ ফরেষ্ট ঘোষণা, অস্থানীয়দের নিকট জুম্মদের প্রথাগত জুম ভূমি ও মৌজা ভূমি ইজারা দেয়া, জুম্মদের প্রথাগত ভূমি বেদখল করে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, জুম্মদের বাগান-বাগিচা ও ঘরবাড়ি ধ্বংস করে সীমান্ত সড়ক, সংযোগ সড়ক ও রাস্তা-ঘাট নির্মাণ, নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন ও সম্প্রসারণ, পার্বত্য চট্টগ্রামে গ্যাস-তেল অনুসন্ধান ইত্যাদি অন্যতম।

জুম্ম জনগণ আশা করেছিল যে, পার্বত্য চুক্তির মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের স্মরণাতীত কালের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য সংরক্ষিত হবে। জুম্ম জনগণের জাতীয় পরিচিতি, সংস্কৃতি, ভাষা, প্রথা, রীতিনীতি ইত্যাদি বিকাশ ও সংরক্ষিত হবে। তার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বহু জাতি, বহু সংস্কৃতি ও বহু ভাষার বৈচিত্র্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আরো শক্তিশালী ও সুদৃঢ় হবে। কিন্তু পার্বত্য চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন না করে বরঞ্চ শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক পার্বত্য চুক্তিকে অব্যাহতভাবে পদদলিত ও খর্ব করার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য তথা জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব আজ বিলুপ্ত হতে বসেছে। পার্বত্য চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে সংবিধানে ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি’ মর্মে জাত্যভিমানী অভিধা সন্নিবেশ করার ফলে জুম্ম জনগণসহ দেশের ৫১টির অধিক আদিবাসী জাতির জাতীয় পরিচিতি ও অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো দেশের এক-দশমাংশ এলাকাকে অগণতান্ত্রিক শাসনের অধীনে রেখে দেশে কখনোই গণতান্ত্রিক শাসন বিকশিত হতে পারে না। সুখী-সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ কখনোই গড়ে তোলা সম্ভব হতে পারে না, যদি পার্বত্য অধিবাসীদেরকে প্রতিনিয়ত ফ্যাসীবাদী দমন-পীড়নের মধ্যে রাখা হয়। বস্তুত পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতীয় সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের, দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও বিভেদ অবসানের, সর্বোপরি পার্বত্যাঞ্চলের শান্তি ও উন্নয়নের যে রাজনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, সেই ঐতিহাসিক সুযোগকে ধুলিস্যাতকরণের মধ্য দিয়ে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কখনোই শুভ ফল বয়ে আনতে পারে না। তাই পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে সময়সূচি-ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা (রোডম্যাপ) ঘোষণা করে ড. ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এগিয়ে আসবে– এটাই পার্বত্যবাসী আশা করে।

More From Author