ভূতেশ তালুকদার
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আজ ২৭ বছর। দীর্ঘ ২৭ বছরেও পার্বত্য চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। এ নিয়ে পাহাড়িদের মধ্যে তীব্রক্ষোভ বিরাজ করছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী আওয়ামী লীগ সরকার টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্রদের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ফলে ৫ আগস্ট আওয়ামীলীগ সরকারের পতন ঘটে। এরপর ড. মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসলেও আদিবাসী জুম্ম জাতির উপর যে বৈষম্য সেই বৈষম্য অব্যাহত রয়ে গেছে এবং পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে আদিবাসী জুম্ম জাতির মানবাধিকার, মর্যাদা ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই বলে প্রতীয়মান হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, গত ২৭ বছরে চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সৃষ্টি হয়েছিল; তিন পার্বত্য জেলার জেলা পরিষদ শক্তিশালী করা; পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন; শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, পর্যটন, সমবায়, মৎস্য, সমাজকল্যাণসহ ৩০টি বিভাগ বা বিষয় তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর; নতুন রাস্তা ও সেতু নির্মাণের মাধ্যমে প্রত্যন্ত এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন; সার্কেল চিফ বা হেডম্যান বা কারবারিদের ভাতা বৃদ্ধি; ঢাকার বেইলি রোডে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স নির্মাণ; তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে প্রতিবছর শিক্ষাবৃত্তি প্রদান; কৃষকদের উন্নয়নে মিশ্র ফলের বাগান সৃজন; পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন; ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্কফোর্স গঠন; রাঙামাটি মেডিক্যাল কলেজ এবং রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল; প্রত্যন্ত অঞ্চলে সৌরবিদ্যুৎ সুবিধা সম্প্রসারণ, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন সম্প্রসারণ ও সাবস্টেশন স্থাপন ইত্যাদি বাস্তবায়িত হয়েছে।
এসব কিছু কিছু বিষয় বাস্তবায়িত হয়েছে বটেই, কিন্তু পার্বত্য চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো সম্পূর্ণরূপে অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। ফলে অর্জিত হয়নি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান। নিশ্চিত হয়নি পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা। এত বছরেও পার্বত্য চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোর মধ্যে:
১. পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন গঠিত হলেও তা এখনো অকার্যকর অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। বিশেষ করে ভূমি কমিশনের বিধিমালা প্রণীত না হওয়ায় ভূমি কমিশন ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির বিচারিক কাজ শুরু করতে পারেনি। ভূমি কমিশন মিটিং করতে চাইলে সেটেলাররা বাধা সৃষ্টি করে থাকে।
২. তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব লোক বসিয়ে দিয়ে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ অগণতান্ত্রিকভাবে পরিচালনা করছে এবং এসব পরিষদ দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছে। সরকার পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইন কার্যকর করছে না। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি।
৩. গঠিত হয়নি পার্বত্য জেলা পুলিশ বাহিনী, যা আদিবাসী জুম্মদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে গঠন করার কথা ছিল।
৪. জুম্মরা তাদের বেহাত হওয়া জমি ফেরত পাননি। ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থীদের দুই-তৃতীয়াংশ পরিবার জমি ও বাস্তভিটা ফেরত পায়নি। পুনর্বাসন করা হয়নি অভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের।
৫. পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম (উপজাতীয়) অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যসহ জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব সংরক্ষণ নিশ্চিত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সঙ্গে সংগতি বিধানকল্পে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য আইনগুলো সংশোধন করা হয়নি।
৬. পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভোটার তালিকা প্রণীত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙালি স্থায়ী অধিবাসীদের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত হয়নি।
৭. তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ ইত্যাদি বিষয়গুলো এখনো তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের হাতে হস্তান্তর করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন কার্যকর করা হয়নি।
ফলে পার্বত্য চুক্তির পর বিগত দীর্ঘ ২৭ বছরেও পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি ফেরেনি। আসেনি সমস্যার রাজনৈতিকভাবে স্থায়ী সমাধান। বন্ধ হয়নি রক্তপাত ও হানাহানি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের মাধ্যমে পার্বত্যাঞ্চলের বেসামরিকীকরণ করার কথা ছিল। কিন্তু ৫ শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্পের মধ্যে মাত্র ১০১টি ক্যাম্প প্রত্যাহার হলেও এখনো ৪ শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রামে বলবৎ রয়েছে। এছাড়া ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক সেনাশাসনের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর হাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনভার ন্যস্ত করা হয়েছে।
উপনিবেশিক কায়দায় ‘ভাগ করো শাসন করো’ নীতির ভিত্তিতে সেনাবাহিনী জুম্মদের মধ্যে একের পর এক সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ সৃষ্টি করে চলেছে। তাদেরকে চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়ত সংঘটিত হচ্ছে খুন-খারাবি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অপকর্ম।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সেনাবাহিনী ও সেটেলার বাঙালির অন্যায় ও অপতৎপরতার কারণে পার্বত্য চুক্তির দীর্ঘ ২৭ বছরেও পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি ফেরেনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে অবৈধভাবে পুনর্বাসনকারী মুসলিম সেটলার ভিত্তিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ। সংগঠনটি সেনাবাহিনীর সাহায্য সহযোগিতায় বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র ও পার্বত্য চুক্তি বিরোধী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী ও মুসলিম সেটলাররা ভূমি বেদখলসহ চুক্তি বিরোধী বিভিন্ন ধরনের অপতৎপতায় জড়িত রয়েছে।
জনসংহতি সমিতির সহসভাপতি ঊষাতন তালুকদার বলেন, আমরা এত বছর ধরে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা নেই। আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরও কোনো সদিচ্ছা নেই। পার্বত্য চুক্তিটি বাস্তবায়ন করার বিষয়ে কোনো প্রকার সদিচ্ছা নেই এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৭তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আজ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিসহ তিন পার্বত্য জেলায় সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে আনন্দ শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, গণসমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। রাঙামাটিতে জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে গণসমাবেশ ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানের স্বার্থে তথা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকারকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় যে কোনো পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ি থাকবে।