হিল ভয়েস, ২ ডিসেম্বর ২০২৫, বান্দরবান: পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’র ২৭তম বর্ষপূতিতে উদযাপন কমিটি’র উদ্যোগে ২ ডিসেম্বর বান্দরবান রাজার মাঠে সকাল ১০ টায় এক গণসমাবেশ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য কে এস মং মারমা। প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য সাধুরাম ত্রিপুরা মিল্টন, বিশেষ অতিথি হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক সালিম রেজা নিউটন, পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মেঞোচিং মারমা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও ছাত্র প্রতিনিধি পিসিপি’র বান্দরবান জেলা শাখার উশৈহ্লা মারমা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের বান্দরবান জেলা কমিটির সভাপতি উলিসিং মারমা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে হিল উইমেন্স ফেডারেশন, বান্দরবান জেলা শাখা কমিটির সভাপতি উলিসিং মারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পাহাড়ী বা আদিবাসী মানুষের মৌলিক অধিকারসহ বাস্তবায়নের জোর দাবি জানান। এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার হারা মানুষের পক্ষের আন্দোলনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, বান্দরবান জেলা শাখা, সহ-সভাপতি, উশৈহ্লা মারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি জাতীয় স্বার্থে সম্পাদিত হয়েছে। আদো ২৭ বছরের পরও এ পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গাভাবে বাস্তবায়ন হয়নি দুঃখ, ক্ষোভ প্রকাশ করে। পার্বত্যবাসী নির্যাতন, নিপীড়ন, সেনাশাসনসহ প্রতিনিয়ত মিথ্যা মামলা ও গুমের শিকার হচ্ছে। এই ঐতিহাসিক চুক্তি বাস্তবায়নের বর্তমানে অর্ন্তরবর্তীকালীন সরকারকে চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবি জানান।
মেঞোচিং বলেন, আজ থেকে ২৭বছর আগে ১৯৯৭সালে ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি একটি ঐতিহাসিক দলিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ, পার্বত্য মন্ত্রণালয়, উন্নয়ন বোর্ড এই প্রতিষ্ঠান গুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ফসল। কিন্তু চুক্তির মূল বিষয়গুলো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়ে গেছে। এযাবৎকালে কোনো সরকার চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে কোনো সদিচ্ছা প্রকাশ করেনি।
তিনি আরো বলেন সরকার পার্বত্যবাসীদের সাথে প্রতারণা করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে মিথ্যা মামলা, গুম, খুন নারী ধর্ষণের মত ঘটনা ঘটে চলেছে যার কারণ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনে জনগণের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয় তাই জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি এই বক্তব্যটি মারমা ভাষায় প্রদান করেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সালিম রেজা নিউটন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়িত না হওয়ায় চুক্তির ২৭বছর পরও পাহাড়িদের জীবনে শান্তি ফিরে আসেনি। এই চুক্তি বাংলাদেশের জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি ঐতিহাসিক আইন। কিছু স্বার্থান্বেষী মহল চুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করার পায়তারা চালায়।
তিনি আরো বলেন যে পার্বত্য চট্টগ্রামে এরশাদ সরকারের সময় থেকেই সমতলের বাঙ্গালীদের পাহাড়ের সেটেল করানো শুরু হয় যার জন্য পাহাড়িরা ভূমি হারায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে স্থায়ি সমাধানের জন্য চুক্তি বাস্তবায়ন জরুরি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য সাধুরাম ত্রিপুরা মিল্টন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি শুধু পার্বত্য অধিবাসীদের অর্জন নয় এটা বাংলাদেশ রাষ্ট্রেরও গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। এই চুক্তি স্বাক্ষরের পেছনে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা রয়েছে। বহু আলোচনা ও পর্যালোচনার পর রাষ্ট্রের সাথে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। কিন্তু বিগত সরকারের আমলে নানা ষড়যন্ত্রের ফলে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।
তিনি আরও বলেন, আজকে চুক্তির ২৭ বছর পরও চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ে এখনও উন্নয়নের সুবাতাস বয়ে আসেনি। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলনে অধিকতরভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। জনসংহতি সমিতি সবসমই অধিকার হারা মানুষের পাশে সবসময় থাকবে বলে আশ্বস্ত করেন।
গণসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে কে এস মং মারমা বলেন, ১৯৯৭ সালে ২রা ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল যেখানে জুম পাহাড়ে মানুষর অধিকারের কথা লেখা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখ প্রকাশ করে তিনি এত বছর হয়ে গেলেও এই চুক্তির সুফল পাওয়া হয়নি। কারণ, শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক নয়। তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি একক দলের নয়। এটি সবার। এখানে স্থায়ী বাঙ্গালী ও জুম্ম সবার অধিকার সনদ এটি। পাহাড়ে ভূমি সমস্যা, অবৈধ সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার না হওয়া এবং সেটেলার সমস্যার সমাধান না হওয়া অবধি জুম্ম জনগণকে আন্দোলনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির এই নেতা।
সমাবেশের সভাপতি সুমন মারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ে ক্ষোভ বাড়ছে। বাড়ছে সমস্যা। তিনি আরও যোগ করে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি একক কোন জনসংতি সমিতির না। এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৪টি ভিন্ন ভাষাভাষি জুম্ম জাতির এবং স্থায়ী বাঙালীর অধিকার সনদ। কাজেই ২৭ বছর অতিক্রান্ত মানুষের শান্তি ফিরছে না। সভাপতির বক্তব্যে সুমন মারমা আরও বলেন, আজ আমরা এক দশকের কাছাকাছি সময়ের পর বান্দরবানে কর্মসূচি পালন করছি তন্মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৭ বছর পূর্তি হতে চলেছে। এই চুক্তি বাস্তবায়ন ব্যতীত আমাদের স্থায়ী শান্তি মিলবে না।
অনুষ্ঠানে উবাসিং মারমা’র সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন চুক্তি বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটির সদস্য মংনু মারমা।
গণসমাবেশের পর রাজার মাঠ থেকে র্যালী বের হয়ে পুনরায় মাঠে এসে সমাপ্তি ঘটে।