হিল ভয়েস, ২১ নভেম্বর ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক:
উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
পার্বত্য চুক্তির ‘ক’ খন্ডের ১নং ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির এ বিধান সুনিশ্চিতকরণে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি, পাহাড়ি অধিবাসীদের ভূমি অধিকার সংরক্ষণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিশেষ শাসনকাঠামো স্থাপন, প্রত্যাগত শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন, অউপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দার সংজ্ঞা নির্ধারণ, স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন প্রভৃতি বিধানাবলী অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির দাবীর প্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক চীফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদল্লাহ জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধিদলকে বারংবার জানান যে, প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়েছেন উনিশশো আশি দশকে পুনর্বাসিত সেটেলারদেরকে সমতল অঞ্চলে পুনর্বাসন দেয়া হবে। তবে বিশেষ কারণে তা চুক্তিতে উল্লেখ করা যাবে না। সেই সূত্রে ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ তারিখে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পর জনসংহতি সমিতির সভাপতির নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলের নিকট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেন।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ২৩ক উপ-অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের উপজাতি, জাতিসত্তা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশ ও সংরক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে বলে সরকার কর্তৃক যে বক্তব্য পেশ করা হয় তা যথাযথ নয়। উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণকল্পে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য-
সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল বিভিন্ন ভাষা-ভাষী উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল মর্মে সংবিধিবদ্ধ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা,
সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদের ৪ উপ-অনুচ্ছেদে “নারী বা শিশুদের অনুকুলে কিংবা নাগরিকদের অনগ্রসর অংশের” শব্দসমূহের অব্যবহিত পরে ‘বা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনগ্রসর পাহাড়ীদের’ শব্দসমূহ সংযোজন করা, এবং
উনিশশো আশি দশকে পুনর্বাসিত সেটেলারদেরকে সমতল জেলাগুলোতে পুনর্বাসন দেওয়ার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা।
উক্ত বিধান অনুযায়ী জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব সমুন্নত রাখা ও পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ কোন আইনী ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
পক্ষান্তরে ‘উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যকে ক্ষুণ্ণ করার লক্ষ্যে সেটেলার বাঙালিদের পুনর্বাসন; সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ; অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত পরিণত করার জন্য পার্বত্য চুক্তির পর জুম্মদের উপর ২১টি সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিতকরণ; বহিরাগতদের পার্বত্য চট্টগ্রামের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণ; ডেপুটি কমিশনার কর্তৃক স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদান; চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান; ভূমি বেদখল; বহিরাগতদের নিকট ভূমি বন্দোবস্তী ও ইজারা প্রদান; জুম্ম জনগণকে সংখ্যালঘু করার লক্ষ্যে নতুন করে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ ঘটানো; তথাকথিত ‘সমঅধিকার আন্দোলন’ ও ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি’ গঠনের মাধ্যমে সেটেলার বাঙালিদের সংগঠিত করে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং পার্বত্য চুক্তির বিরুদ্ধে উস্কে দেয়া, ভূমি জরিপের মাধ্যমে সেটেলার কর্তৃক জবরদখলকৃত ভূমি বৈধতা প্রদানের পাঁয়তারা ইত্যাদি কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চলছে।
উল্লেখ্য যে, মায়ানমার থেকে আগত শত শত রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থী প্রশাসনের পরোক্ষ অথবা প্রত্যক্ষ সহায়তায় বান্দরবান জেলায় নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা, আলিকদম ও সদর উপজেলায় স্থায়ী বসতি স্থাপন করছে। তারা ভোটার তালিকাভুক্ত হচ্ছে এবং স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র নিয়ে নানা সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে চলেছে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার সময়ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে লঙ্ঘন করে বহিরাগতদের অন্তর্ভুক্ত করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে আসছে।
বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির স্বাক্ষরের পর বিগত ২৭ বছরেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সহ দুই-তৃতীয়াংশ ধারা অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে।
+ There are no comments
Add yours