১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বর্তমান অবস্থা: ১ম পর্ব

হিল ভয়েস, ২০ নভেম্বর ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক:

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পটভূমি

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি রাজনৈতিক ও জাতীয় সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সত্তর দশকের প্রারম্ভে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে জুম্ম জনগণ প্রথমে গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন করে, পরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সকল পথ রুদ্ধ হলে জুম্ম জনগণ সশস্ত্র আন্দোলনে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হয়।

সশস্ত্র আন্দোলনে অবতীর্ণ হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সংলাপের পথ খোলা রাখে। তারই আলোকে আশি দশকের প্রারম্ভে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সরকারের সাথে আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু এক সামরিক অভ্যুত্থানে তাঁর মৃত্যুর ফলে সেই উদ্যোগ থেমে যায়।

এরপর প্রেসিডেন্ট হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের লক্ষ্যে বৈঠকের উদ্যোগ নেয়া হয়। এক পর্যায়ে ১৯৮৫ সালের অক্টোবরে এরশাদ সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকে উভয় পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে জাতীয় ও রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে পরিচিহ্নিত করে এবং রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানে ঐক্যমত্য হয়।

তারই ধারাবাহিকতায় জেনারেল এরশাদ সরকারের সাথে ৬ বার, পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের সাথে ১৩ (তের) বার এবং সর্বশেষ শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে ৭ বার অর্থাৎ মোট ২৬ বার আনুষ্ঠানিক বৈঠকের ধারাবহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা পার্বত্য শান্তিচুক্তি নামে সমধিক পরিচিতি লাভ করে।

এই চুক্তিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে স্বাক্ষর করেন জাতীয় সংসদ কর্তৃক গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের পক্ষে স্বাক্ষর করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা।

উল্লেখ্য যে, জনসংহতি সমিতি প্রথমে আইন পরিষদ সম্বলিত প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের ৫ দফা দাবিনামা পেশ করে। কিন্তু দেশের শাসনব্যবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন সম্বলিত ৫ দফা দাবিনামা সংশোধন করে আঞ্চলিক পরিষ সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ৫ দফা দাবিনামা পেশ করা হয়।

এছাড়া জনসংহতি সমিতি পার্বত্য চট্টগ্রামের নাম ‘জুম্মল্যান্ড’ এবং উপজাতির পরিবর্তে ‘জুম্ম’ বা ‘পাহাড়ি’ হিসেবে আখ্যায়িত করার দাবিনামা পেশ করে। কিন্তু সরকারের অনমনীয় মনোভাবের কারণে এই দাবিনামা নিয়ে সংলাপ ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ফলে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের স্বার্থে উপজাতি শব্দটি বলবৎ রেখে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদন করতে জনসংহতি সমিতি সম্মত হয়।

অন্যদিকে বাঙালি মুসলিম সেটেলারদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে নেয়ার দাবি করা হয়। প্রত্যুত্তরে সরকারের প্রতিনিধিদল বলেন যে, সরকার নীতিগতভাবে সেটেলারদের সরিয়ে নিতে রাজী রয়েছে। তবে চুক্তিতে তা লেখা সম্ভব হবে না। চুক্তিতে লেখা না হলেও চুক্তিতে এমন ধারা সন্নিবেশ করা হবে, যাতে সেটেলাররা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে যেতে বাধ্য হবে। তারই আলোকে চুক্তিতে নিম্নোক্ত ধারাসমূহ সন্নিবেশ করা হয়-

(ক) ‘অউপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দার সংজ্ঞা’ নির্ধারণ করা হয়, এতে বলা হয়েছে যে, “যিনি উপজাতীয় নহেন এবং যাহার পার্বত্য জেলায় বৈধ জায়গা জমি আছে এবং যিনি পার্বত্য জেলায় সুনির্ষ্টি ঠিকানায় সাধারণতঃ বসবাস করেন তাহাকে বুঝাইবে”। এই সংজ্ঞা অনুসারে সেটেলাররা স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে গণ্য নহে।

(খ) কেবলমাত্র তিন সার্কেল চীফ কর্তৃক স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদানের বিধান করা হয়।

(গ) অন্য জেলা থেকে এসে কিংবা স্থায়ী বাসিন্দা নয় এমন কেউ যাতে পার্বত্য জেলায় জায়গা-জমি বন্দোবস্তী ও ক্রয় করতে না পারে তার বিধান করা হয়।

(ঘ) ভূমি কমিশনের মাধ্যমে সেটেলার কর্তৃক অবৈধভাবে দখলকৃত ভূমি জুম্মদের ফেরত দান করার বিধান করা হয়।

(ঙ) পার্বত্য চট্টগ্রামের ভোটার তালিকা কেবলমাত্র স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে প্রস্তুত করার বিধান করা হয়।

(চ) পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকরিতে উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ করার বিধান করা হয়।

(ছ) স্থায়ী বাসিন্দাদের রেকর্ড সংরক্ষণ করতে ‘জন্ম-মৃত্যু ও অন্যান্য পরিসংখ্যান সংরক্ষণ’ বিষয়টি তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন করা হয়।

এছাড়া সেটেলার বাঙালিরে রেশন বন্ধ করে দেয়া, সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম ভেঙ্গে দেয়া, উপযুক্ত পুনর্বাসন প্যাকেজ ঘোষণা করে তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পুনর্বাসন করা ইত্যাদি অলিখিত চুক্তি বা সমঝোতা ছিল।

বলাবাহুল্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের আপামর পাহাড়ি-বাঙালী স্থায়ী অধিবাসীদের সমর্থনের পাশাপাশি দেশের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সকল রাজনৈতিক দল, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আইনজীবী, নারী ও আদিবাসী অধিকার কর্মী, ছাত্র, যুব ও নাগরিক সমাজ পূর্ণ ও সক্রিয় সমর্থন প্রদান করেন।

তবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জাতীয় পার্টি ও জামাতে ইসলামী প্রভৃতি দেশের চরম দক্ষিণপন্থী জাতীয় রাজনৈতিক দলসমূহ এবং দেশের উগ্র জাতীয়তাবাদী, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে না হতেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে বিরোধিতা করে প্রসিত বিকাশ খীসা ও রবি শংকর চাকমার নেতৃত্বে পাহাড়ি গণপরিষদ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের একটি অংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরোধিতা করে।

অন্যদিকে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন মানবতাবাদী ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পার্বত্য চুক্তির প্রতি সমর্থন প্রদান করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার ১১টি দেশের ২০ জন প্রতিনিধি এক যুক্ত বিবৃতি প্রদান করেন। এই চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউনেস্কোর হোপে-ফেলিক্স বৈহনি শান্তি পদকে পুরষ্কৃত হন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে ৪ টি খন্ড রয়েছে। প্রথম খন্ড ‘ক’ সাাধারণ-এ ৪টি ধারা রয়েছে।

দ্বিতীয় খন্ড ‘খ’ অনুযায়ী পার্বত্য জেলা পরিষদ-এ ৩৫টি ধারা রয়েছে।

তৃতীয় খন্ড ‘গ’ পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ-এ ১৪টি ধারা রয়েছে।

চতুর্থ খন্ড ‘ঘ’ সাধারণ ক্ষমা, পুনর্বাসন ও অন্যান্য বিধানাবলীতে ১৯টি ধারা সন্নিবেশিত হয়।

More From Author

+ There are no comments

Add yours