১০ নভেম্বর স্মরণে: সাম্প্রতিককালে ঐক্য ও বিভেদ নিয়ে কিছু কথা (শেষ অংশ)

বাচ্চু চাকমা

শাসকশ্রেণি আমাদের মধ্যেকার “ভাগ কর, দুর্বল কর, তারপর শাসন কর” এই নীতির উপর ভিত্তি করে জানান দেয় আমি সকল দুর্বল জাতি সবাইকে শাসন শোষণ করতে জন্মলাভ করেছি। সেদিন হতে সে ধরে নেয় যে, শাসন-শোষণ করাটাই তার জন্মসিদ্ধ। কিন্তু এই শাসকেরা জানে না অত্যাচারীরা চিরদিনই ভীরু হয়। অত্যাচারীর একদিন নয় একদিন পতন হবে, বস্তুর লয় বা ধ্বংসের অনিবার্য পরিণতি সেই অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীকে ভোগ করতে হবে। প্রতিটি শাসকই তো চক্রব্যুহ রচনা করেন। শাসকশ্রেণির এই চক্রব্যুহ ভাঙা এতোই সহজ নয়, মহাভারতের সেই দীর্ঘ কাহিনীতেও স্বয়ং কৃষ্ণের নির্দেশনায় একমাত্র পান্ড্পুত্র অর্জুনই চক্রব্যুহ ভাঙতে সক্ষম হয়েছে। শাসকশ্রেণির এই ব্যুহচক্রের ভেতর যারা ঢুকেছে তারা সেখান হতে বেরিয়ে আসতে পারেনি, ফলে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত কেন? ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি কেন করতে যাবো? এই জাতীয় সস্তা শ্লোগানে জনগণের সমর্থন আদায় করে নিয়ে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। শাসকগোষ্ঠীর সৃষ্ট ইউপিডিএফ ও অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীলদের শ্রেণিচরিত্রও ঠিক তাই এবং তাদের সাথে সুর মেলায় কিছু তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিত একদল মানুষ। যারা মানবতার নামে মুখে ফেনা তুলেন, কিন্তু কার্যকরের ক্ষেত্রে দোদুল্যমান, সুবিধাবাদিতার মুখোশ পরে ভদ্র সেজেগুজে চুপসে বনে যান। এই দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত বিচার-বিশ্লেষণের ভিত্তিতে যথোপযুক্ত পন্থা পদ্ধতির মাধ্যমেই সমাধানের পথ খুঁজে নিতে অনেকেই জীবন যৌবন দিয়ে চলেছেন। যেমনি যথাযথভাবে সমাধান করতে চেয়েছিলেন প্রয়াতনেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এবং বর্তমান নেতা সন্তু লারমার এখনো চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেননি। কিন্তু যারা প্রতিক্রিয়াশীল, বিভেদপন্থী ও সুবিধাবাদী তারাই সন্তু লারমার সেই যথোপযুক্ত বাস্তব সম্মত প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য সবসময় ষড়যন্ত্র করেন।

আরও উল্লেখ্য যে, রাজনীতিগতভাবে জুম্মরা অনেকে বলেন আমরা নাকি চার ভাগ, আবার অনেককেই বলতে শুনি ৭ ভাগে বিভক্ত! যেমন; পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, সংস্কারপন্থী দল, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-গণতান্ত্রিক, আওয়ামী লীগ রাজনীতির সাথে যুক্ত জুম্মলীগ, বিএনপি’র রাজনীতির সাথে যুক্ত জুম্মদল, জাতীয় পার্টি রাজনীতির সাথে যুক্ত জুম্ম এভাবে বহু বিভক্তি ও ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের কথা উপস্থাপন করার চেষ্টা করে। প্রকৃতপক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ মাত্র দুই ভাগে বিভক্ত; শাসক বনাম শোষিত। শাসকশ্রেণির পক্ষে ইউপিডিএফ, সংস্কারপন্থী দল, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দল, জুম্মলীগ, জুম্মদল, জাতীয় পার্টি ও সমাজের কিছু সুবিধাবাদী লোকজন। এরা সবাই হল শাসকশ্রেণির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত, সেজন্য তারা চেহারার দিক থেকে জুম্ম হলেও মন ও চেতনার দিক থেকে প্রকৃত জুম্ম হতে পারেনি। কারণ জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব সংরক্ষণের বিপরীতে ওরা শাসকশ্রেণির গুণগান করে এবং জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে চিরতরে ধ্বংস করতে সব সময় সোচ্চার থাকেন।

আর বিপরীতে সমগ্র জুম্ম জনগণ যারা অধিকার নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে বেঁচে থাকতে চায় তারাই হল আসল শোষিতশ্রেণি জুম্ম জনগণ। সেই জুম্ম জনগণের সামগ্রিক অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে জনসংহতি সমিতি তার জন্মলগ্ন থেকেই জুম্ম জনগণের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তাহলে সেই তথাকথিত ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের নামে যে বিভক্তির কথা যারা বলেন, এবার তাদের নিশ্চয় পরিষ্কার হতে পারে যে, জুম্ম জনগণের আন্দোলন বা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংহতি সমিতির আন্দোলন কোনোদিনই ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত নয়, ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব নয়, ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি নয়-এটা হলো নীতি ও আদর্শগত দ্বন্দ্ব এবং আদর্শের লড়াই ছাড়া কিছুই নয়। আরও পরিষ্কার করতে চাই আমাদের লড়াই হল শাসক আর শোষিতের লড়াই, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যেকার লড়াই। চূড়ান্ত পর্যায়ে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে যারা সংগ্রাম করেন তাদেরই জয়ী হয়।

বিভিন্ন দেশের আভ্যন্তরীণ চলমান লড়াইয়ের সময় তাদের মধ্যেকার কি বিভক্তি, বৈষম্য আর দ্বন্দ্ব ছিলো না? নিশ্চয়ই ছিলো এবং সেই দ্বন্দ্বকে কিভাবে নিয়েছিল, কিভাবে সমাধান করেছিলো, শোষিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের পক্ষে লড়াই করা সেই সংগঠন। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে দাঁড়িয়ে অধিকার আদায়ের আন্দোলনের বাস্তব ঘটনাগুলো একটি একটি করে কি মনে পড়বে, স্মরণে আসবে কি সেই সময় যে সময় আমেরিকার বুকেও তাদের মধ্যেকার আভ্যন্তরীণ যুদ্ধ হয়েছিল। আমেরিকার দক্ষিণের জনগণ দাস প্রথার বিলোপ এবং দাসদের সমঅধিকারের বিষয়টি কিছুতেই মানতে রাজি ছিল না। আর সে কারণে এ বিষয়ে বারবার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল দাস প্রথার বিলোপ দক্ষিণের জনগণের অধিকারের ওপর অযথা হস্তক্ষেপ এবং দক্ষিণের অর্থনীতি দুর্বল করার জন্য উত্তরের রাজ্যগুলোর চক্রান্ত করছে। আর এজন্যই দক্ষিণের রাজ্যগুলো আভ্যন্তরীণ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৮৬১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণের এই ১১টি রাজ্য একত্র হয়ে ঠিক করলো, তারা এই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। নতুন এক যুক্তপ্রদেশ বা কনফেডারেট স্টেটস অফ আমেরিকা গঠন করবে। বিপরীতে দক্ষিণের রাজ্যগুলোর এই হাঁকডাকের জবাবে উত্তরের রাজ্যগুলোও নির্দ্বিধায় জানালো, কোনোমতেই এই যুক্তরাষ্ট্রকে ভাঙা চলবে না। এভাবে আমেরিকার আব্রাহাম লিংকনের নেতৃত্বে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের মাধ্যমে দাস প্রথার বিলুপ্তি ঘটান।

চীনের আন্দোলনের সময় তো অনেক দল ছিলো, রাশিয়ায় অনেক বিভক্তি ছিলো কিন্তু সেখানকার জনগণ বা নিপীড়িত মানুষেরা সত্যিকার রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে ছিলেন বিধায় চীনে মাওসেতুং এর নেতৃত্বে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে অনেক সংগঠনের জন্ম হতেই পারে! কিন্তু নিপীড়িত জুম্ম জনগণের একটা সংগঠনকে আগলিয়ে শক্ত করে ধরে রাখতে হবে। যে সংগঠনের মৃত্যু নেই, তাঁর মানে হল আদর্শের মৃত্যু হয় না। কোনো আদর্শের মৃত্যু নেই? নিশ্চয়ই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার আদর্শের মৃত্যু নেই, সেই এম এন লারমার আদর্শেই আদর্শিত রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিরও কোনোদিন মৃত্যু হতে পারে না। জেএসএস আর ব্রাকেটে এম এন লারমার নামকে কালিমালিপ্ত করার চক্রান্তের কোনো শেষ নেই। যারা এম এন লারমার আদর্শকে শাসকশ্রেণির কাছে বিকিয়ে দেয় নিজেদের স্বার্থে তারাই তো জাতিদ্রোহী জুম্ম রাজাকার। অস্ত্রের মুখে নিপীড়িত জুম্ম জনগণকে জিম্মি করে বুঝাতে চাও কি তুমি অত্যাচারীর পক্ষে? হ্যাঁ, এসব দলগুলো যে অত্যাচারী, প্রতিক্রিয়াশীল, সুবিধাবাদী ও বিভেদপন্থী তা সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

উল্লেখ্য যে, চীনা যুদ্ধ হল চীনের জাতীয়তাবাদী পার্টি বা কুওমিনতাং দল এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে অনুষ্ঠিত চীনের এক আভ্যন্তরীণ যুদ্ধ। ১৯২৭ সালের এপ্রিল মাসে উত্তরের অভিযানের মধ্যেই এই যুদ্ধের সূচনা হয়। এই যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে ছিল পাশ্চাত্য বিশ্বের সমর্থনপুষ্ট চীনের জাতীয়তাবাদী দল কুওমিনতাং এবং সোভিয়েত সমর্থনপুষ্ট চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে এক মতাদর্শগত সংগ্রাম। গণপ্রজাতান্ত্রিক চীনে সাধারণত এই যুদ্ধ “মুক্তিযুদ্ধ” হিসেবে অভিহিত হয়েছিল। নিরবচ্ছিন্নভাবে এই যুদ্ধ অব্যাহত থাকে দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ পর্যন্ত। এক পর্যায়ে চীনের জাতীয়তাবাদী দল, কুওমিনতাং এবং কমিউনিস্ট পার্টি ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠন করে যুক্তফ্রন্ট। এই যুক্তফ্রন্ট নীতি আসলে একটা সুবিধাবাদী কৌশল মাত্র। আমরা জানি ১৯৪৫ সালে জাপানের পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। এরপরই ১৯৪৬ সালে চীনে পুনরায় পূর্ণমাত্রায় গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হয়। চার বছর পরে চীন প্রত্যক্ষ করে এক বিশাল রাজনৈতিক উত্তেজনার অবসান, যখন নবগঠিত গণপ্রজাতান্ত্রিক চীন সম্পূর্ণভাবে চিনের মূল ভূখ-কে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে এবং প্রজাতান্ত্রিক চীনের নিয়ন্ত্রণ কেবলমাত্র তাইওয়ান, পেংঘু, কিনমেন, মাৎসু এবং অন্যান্য সংলগ্ন দ্বীপসমূহে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। যেহেতু এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দু’পক্ষের মধ্যে কোনো যুদ্ধবিরতি অথবা কোন শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি সেহেতু এই যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ইতি নিয়ে বিতর্ক রয়ে গিয়েছিল। এই যুদ্ধকেও তো কোনোদিন চীনা জাতি ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত হিসেবে আখ্যায়িত করেনি।

পৃথিবীর বুকে রাশিয়ার যুদ্ধটি ১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবর তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রাশিয়ান সা¤্রাজ্য পতনের পর সংঘটিত হয়। যুদ্ধটি মূলত ‘বলশেভিক রেড আর্মি’ এবং ‘হোয়াইট আর্মি’র মধ্যে সংঘটিত হলেও বহু বিদেশি আর্মি এ যুদ্ধে রেড আর্মির বিপক্ষে অংশগ্রহণ করেছিল। দক্ষিণ রাশিয়ার ইউক্রেনে রেড অ্যালেকসান্ডার কোলচ্যাকের নেতৃত্বে হোয়াইট আর্মিদের পরাজিত হয়। এ ছাড়াও ১৯১৯ সালে সাইবেরিয়াতে রেড আর্মিরা হোয়াইট আর্মিদের পরাজিত করে। পরবর্তীতে অনেক স্বাধীনতাকামী আন্দোলনকারী দল এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তাদের মধ্যে ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং পোল্যান্ড মিলে সোভিয়েত স্টেট করেছিল। আর অন্যরা আগের রাশিয়ান সা¤্রাজ্যের ধ্যান-ধারণা নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পক্ষেই ছিল। ভয়াবহতম এ যুদ্ধটি ১৯১৭ থেকে শুরু করে ১৯২১ সাল পর্যন্ত চলছিল। এ যুদ্ধে আনুমানিক ৯০ লাখ লোক প্রাণ হারান। এই যুদ্ধটিও ছিল মূলত শাসক বনাম শোষিত শ্রেণির মধ্যেকার যুদ্ধ। এই যুদ্ধকেও তো কোনোদিন রাশিয়ার জনসাধারণ ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত হিসেবে মনে করেনি।

মহাভারতের মধ্যেও নানা বিভক্তি, বৈষম্য, সংঘাত ও সংঘর্ষ তাদের একই পরিবারের ভেতরে ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছিল। যার কারণে অর্জুনের তাতশ্রী মহামহিম ভীস্ম আর ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্র ও দুর্য্যধনরা অর্জুনের ভাই, পা-ুপুত্র অর্জুন দুশ্চিন্তায় পড়েছে তাদের ভাইদের কিভাবে হত্যা করবে? যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে পান্ডুপুত্র অর্জুন এসব চিন্তা করতে করতে দুর্বল হয়ে পড়ল। কিন্তু যুদ্ধের অনিবার্য পরিণতি হতে কারোর পক্ষে এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়। সেকারণে শ্রী কৃঞ্চ পা-ুপুত্র অর্জুনকে স্বয়ং তাঁর কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে দিলেন বস্তু উৎপত্তি সম্পর্কে, ন্যায় আর অন্যায় পার্থক্য বিচার-বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিলেন যুদ্ধই অনিবার্য। সুতরাং দুর্বলতা ত্যাগ করে যুদ্ধ করতে থাকো, লাভ-ক্ষতি হিসাব না করে যদি যুদ্ধ কর তাহলে ন্যায়ের পক্ষে জয় সুনিশ্চিত হবে। সেই মহাভারতের যুদ্ধকেও ভাইয়ে-ভাইয়ের মধ্যে সংঘাত হিসেবে আখ্যা দেওয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল, কিন্তু বাসুদেব শ্রী কৃষ্ণ পা-ুপুত্র অর্জুনকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিলেন যে, এই যুদ্ধ ভাইয়ে ভাইয়ে সংঘাত নয়, এটা ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যেকার লড়াই।

ঠিক তেমনিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের তথাকথিত ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের জিগির তুলেই ন্যায়ের পক্ষে লড়াই সংগ্রামকে বাধাগ্রস্ত করে শাসকশ্রেণীর নীলনকশা বাস্তবায়ন করেন যারা, তাদেরকে বুঝিয়ে দিতে চাই যে জেএসএস ও অন্যান্য দলগুলোর মধ্যেকার সংঘাত ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত নয়-এটা নীতি ও আদর্শের লড়াই। ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যেকার লড়াই যা প্রয়াতনেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও বর্তমান নেতা সন্তু লারমা এই দুই ভাইয়ের সুদক্ষ নেতৃত্বে এই লড়াই পাকিস্তান আমলের শেষে ও অধুনা বাংলাদেশ আমলের প্রথমার্ধে শুরু হয়েছিল সেই ধারাবাহিকতা এখনও চলমান রয়েছে। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান সংঘাতকে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের লেবাস দিয়ে ন্যায়ের পক্ষে লড়াই সংগ্রামকে চিরতরে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র ছাড়া তেমন কিছুই হতে পারে না।

পার্বত্য চট্টগ্রামে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে বানচাল করতে বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠীর অসংখ্য সহযোগী রয়েছে। তারা নিশ্চিতভাবে চাইবে জুম্ম জাতীয় ঐক্য ও সংহতিকে ভেঙ্গে দিয়ে সংগ্রামী শক্তিকে দুর্বল করতে। এসব করার জন্য শাসকগোষ্ঠী বরাবরই সর্বপ্রকার পন্থা, পদ্ধতি এবং যত কুটকৌশল ও ষড়যন্ত্র আছে তা প্রয়োগ করবে। আজ বিভেদপন্থী চক্র যখন দুর্বল হচ্ছে, তখন জুম্ম জনগণকে ভয় দেখিয়ে, কতিপয় স্থানীয়ভাবে দায়িত্বরত সেনা কর্মকর্তাকে ঘুষ দিয়ে এবং বিভিন্ন গ্রুপের সাথে দহরম-মহরম করে সংঘাত ও বিভেদের বীজ বপন করে যাচ্ছে। ঐক্য বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ইউপিডিএফ-এর কর্মসূচি চোখে পড়ার মত ছিল। সম্ভবত: ২ বছর আগেও ইউপিডিএফ-এর কর্মসূচি ছিল ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বা ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব ও মারামারি বলে ফলাওভাবে প্রচার করা। এবিষয়ে জনগণকে সম্পৃক্ত করে জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করার হীন ষড়যন্ত্র চালিয়েছিল। অতি সস্তায় স্লোগানগুলো নিয়ে এসে লক্ষ জুম্ম জনগনের মুক্ত বাজারে ছেড়ে দিয়ে মুনাফা লাভের ব্যর্থ প্রয়াস করেছে ইউপিডিএফ। গত ৫ আগষ্ট ২০২৪ বাংলাদেশে অবিশ্বাস্যভাবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর জামাত ইসলাম, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী দলগুলোর উত্থান নজিরবিহীন বলা যায়। এসব সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী দলগুলো হঠাৎ করে সব জায়গায় নড়েচড়ে বসতে থাকে। সারা বাংলাদেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার উদ্দেশ্যে মৌলবাদী দলগুলো বরাবরই তাদের কার্যক্রম সক্রিয় রেখেছে। আগষ্ট অভ্যূত্থানের ঢেউ লেগেছে ৯০ দশকের শেষান্তে পাহাড়ের বুকে বিভেদ ও অনৈক্যের মধ্য দিয়ে গজা উঠা নয়া যুগের নয়া পার্টি নামধারী সন্ত্রাসী সংগঠন ইউপিডিএফ।

সংঘাত ও বিভেদের মধ্য দিয়ে যেখানে ইউপিডিএফ-এর জন্ম হয়, সেখানে এগত্তর বা ঐক্যের ফুলঝুড়ি তাদের মানায় না। ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত ও ঐক্য ঐক্য বলে মুখে ফেনা তুলে জুম্ম জনগণকে বোকা বানানোর চেষ্টা করে আসছে বারবার। শুরুতে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পাহাড়ী গণপরিষদ ভেঙ্গে বিভেদের বীজ বপন করেছে ইউপিডিএফ। জুম্ম জনগণের মধ্যে বিভেদের দেয়াল তৈরি করে নির্লজ্জভাবে ঐক্যের স্লোগান নিয়ে পার্বত্যবাসীর কাছে হাজির হন তারা। সংঘাতের বাস্তবতা কে তৈরি করেছে? জুম্ম জাতীয় ঐক্য ভেঙ্গে বিভেদ কে তৈরি করেছে? পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধীতা নামে যদি ১৯৯৮ সালে ইউপিডিএফ সৃষ্টি না হতো তাহলে পাহাড়ে কোন সংঘাত হতো না। যদি ১৯৯৮ সালে ইউপিডিএফ সৃষ্টি হতো না তাহলে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এতদূর পিছিয়ে যেতো না। পার্বত্য চুক্তি পরবর্তীতে জুম্ম জাতির যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সে সম্ভাবনাগুলো আমরা হারিয়ে ফেলেছি।

ইউপিডিএফ সৃষ্টি হওয়ার কারণে শাসকগোষ্ঠীর নীলনক্সা বাস্তবায়নের ষড়যন্ত্রের রাস্তা সহজ ও লাভবান হয়েছে। আমাদের জুম্ম জনগণের সবদিকে সম্ভাবনাসমূহ সঙ্কুচিত হয়েছে এবং চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনের জোয়ার স্তিমিত হয়েছে। ইউপিডিএফ নিজেরাই বিভেদ ও সংঘাত সৃষ্টি করে আবার জনসংহতি সমিতির উপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে ভাল মানুষ সাজার চেষ্টা করে। কি অলৌকিক তাদের ড্রামাবাজি! পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ঐক্যের বিষয়ে সুস্পষ্ট রূপরেখা দেওয়া আছে। এই ঐক্যের রূপরেখা হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে ভিত্তিকে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। এবং একক নেতৃত্ব বা একমুখী নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে আন্দোলন পরিচালিত করতে হবে। কিসের ভিত্তিতে ঐক্য তৈরি হবে? কার নেতৃত্বে ঐক্য হবে? ঐক্য হতে হলে আদর্শ দরকার। নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে ঐক্য মজবুত হয়। আমরা সত্যিকার অর্থে আদর্শের ভিত্তিতে ঐক্য দাবি করি। বুঝে না বুঝে কেবল ঐক্য ঐক্য বললে ঐক্য হয় না। ইউপিডিএফ গোড়া থেকে জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের বিরুদ্ধে সুক্ষ¥ভাবে নানা ষড়যন্ত্র চালিয়ে আসছে।

সাম্প্রতিক সময়ে এগত্তর স্লোগানের মাধ্যমে ছাত্র সমাজকে উস্কে দিয়ে রোমান্টিসিজমের বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে কতিপয় ছাত্রদের মনে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ শক্তভাবে তৈরি করে দিচ্ছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ও বাস্তবতার সাথে সংযোগ না ঘটিয়ে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত চিন্তা থেকে কর্মসূচি ডাক দিয়ে জুম্ম জাতির স্বার্থের বিপরীতে ফলাফল বেরিয়ে আসছে। তারা জানেনা কোন সময়, কোন বাস্তবতায় ও কোন পরিস্থিতিতে কি ধরনের কর্মসূচি ডাক দিলে জুম্ম জনগণ লাভবান হবে। এযাবত ধরে তাদের প্রতিটি কর্মসূচিতে জুম্ম জনগণের সার্বিকভাবে লাভবান না হয়ে বরঞ্চ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বেশি। তাদের প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচির অনিবার্য পরিণতি এসেছে কেবল হঠকারিতা। তাদের নেতৃত্বের মধ্যে বিপ্লবের উষ্ণ রোমান্টিসিজম বরাবরই পরিলক্ষিত হয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চিন্তাধারার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হল হুট করে অথবা অতিদ্রুত কোনোকিছু পাওয়ার আকাক্সক্ষা কিংবা করার প্রবণতা। এধরনের চিন্তাধারাদ্বয় নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ইউপিডিএফ বরাবরই হঠকারিতার সম্মুখীন হয়েছে। এটাই ইউপিডিএফ-এর শিশুসূলভ বিশৃঙ্খলার রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ মাত্র। শিশুসূলভ বিশৃঙ্খলার পক্ষে এতোদিন ধরে ইউপিডিএফ ওকালতি করে আসছে। যার কারণে গত ২৬ বছরেও পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখাসহ তথাকথিত ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত ও ঐক্য বা এগত্তর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা জুম্ম জনগণের সামনে হাজির করতে পারেনি। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ঐক্য বিষয়ে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা হচ্ছে “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করেই ঐক্য গড়ে তুলতে হবে এবং সেই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের নেতৃত্ব হতে হবে একক বা একমুখী”। এই একমুখী নেতৃত্বের ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিপ্লবী এম এন লারমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে।

(সমাপ্ত)

লেখক: পিসিপি’র সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি

More From Author

+ There are no comments

Add yours