বাচ্চু চাকমা
ষড়ঋতুর চক্রাকারে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে প্রতি বছরের ন্যায় এবারেও ১০ নভেম্বর জুম্ম জাতির কাছে এসে হাজির হয়েছে। বর্ষা শেষে যেমন শরতের আগমন হয় তেমনি ঘুরে ফিরে ১০ নভেম্বরও বারবার জাতির সামনে শোকের বার্তা নিয়ে চলে আসে এবং সমগ্র জুম্ম জনগণের অন্তরকে বিদ্ধ করে। ‘৮৩ পরবর্তী হতে জুম্ম জাতির আপামর জনতা ১০ নভেম্বর জুম্ম জাতীয় শোক দিবসকে অতি আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করে মহান নেতাকে এক মুহুর্তের জন্য হলেও গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সাথে স্মরণ করতে চায়। ১০ নভেম্বর আসলে জুম্ম জাতীয় শোককে শক্তিতে পরিণত করে জাতির শত্রু বেঈমান ও বিশ্বাসঘাতকদের সকল ষড়যন্ত্র নির্মূলীকরণের লক্ষ্যে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। ১০ নভেম্বর বিভীষিকাময় ঘটনার পূর্ববর্তী সময় আজও জুম্ম জাতিকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। বিভেদপন্থী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্ররা নেতার বিরুদ্ধে বিষোদগার ও যত্রতত্র সমালোচনা কিংবা পদ্ধতি বহির্ভূত কুৎসা রটনায় মশগুল থাকতো বলে আমরা অতীতের ইতিহাস থেকে জানতে পেরেছি।
এম এন লারমার পিতৃহৃদয় বিশ্বাস করতো- বিভেদপন্থীরা একদিন বুঝে উঠতে পারবে, আত্মোপলদ্ধি করে সৎপথে ফিরে আসবে। নেতার এই সহনশীল ও ক্ষমাশীল মনোভাবকে বিভেদপন্থী চক্ররা দুর্বলতা হিসেবে গ্রহণ করে ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নেন। জনসংহতি সমিতির আন্দোলনের অতীতের ইতিহাসের পাতা থেকে আরও জানা যায় যে, এক সময় বিভেদকারীদের ক্ষমা প্রদর্শন করে পুনর্বার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পন করেছিলেন। কিন্তু অবিশ্বাসের ভূত প্রতিক্রিয়াশীল ও জুম্ম জাতির চিরশত্রু গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রদের মন থেকে কখনো সরে যায়নি। জুম্ম জাতির ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টির লক্ষ্যে বরাবরই ষড়যন্ত্রের পথে পা বাড়িয়েছেন তারা। এভাবে জুম্ম জাতির মুক্তির সংগ্রামে অবিচল পার্টির মধ্যেকার চরম সংকট তৈরি করে দেন বিভেদপন্থী চক্র।
অতীতের অভিজ্ঞতার সারসংক্ষেপ হলো এই যখন বিভেদপন্থী চক্র দুর্বল ও মুমূর্ষু হয় তখনই হন্যে হয়ে পাগলের মতো সমঝোতার পথ খুঁজতে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে বহু যুগান্তকারী ঘটনা প্রবাহ তারই ইঙ্গিত বহন করে। পার্টির যখন বিভেদের ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়েছে তখন সর্বাগ্রে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে জুম্ম জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। সমস্যা সৃষ্টি হলে তা সমাধানের পদ্ধতি হলো আলাপ আলোচনা করা, আসল রোগটি পরিচিহ্নিত করতে পারলে তা নিরাময়ের জন্য যথাযথ ঔষধ সেবন করতে হয় অথবা উপযুক্ত চিকিৎসা করাতে হয়। কাজেই জুম্ম জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনে ঐক্য বিনষ্টকারীদের সাথে আলাপ আলোচনার দরজা পার্টি সব সময় খোলা রেখেছে। পার্টির নেতৃত্ব জুম্ম জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে “ক্ষমা করা, ভুলে যাওয়া” নীতির ভিত্তিতে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করতে সর্বত্রই চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। জুম্ম জাতির আন্দোলনের ইতিহাস শিক্ষা দেয় যে, চোরেরা ধর্মের কাহিনী শুনতে কখনো রাজি হয় না। তাই বিভেদপন্থীরা গোপনে গোপনে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে, ফলশ্রুতিতে জুম্ম জাতির ইতিহাসে ১০ নভেম্বর কলঙ্কিত অধ্যায় জন্ম দিয়েছে। ক্ষমতালিপ্সু গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্ররা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের সাথে হাত মিলিয়ে তৎকালীন বহিঃশক্তির সাহায্য নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার সমাধান দ্রুততার সঙ্গে হবে এই মর্মে জুম্ম জনগণকে ভুল বুঝিয়ে বিভ্রান্ত ছড়াতে থাকে। অথচ বাস্তবিকপক্ষে “ভাগ কর-দুর্বল কর-শাসন কর”-এই নীতির উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রযন্ত্রের একটা পলিসি পার্টির মধ্যে প্রয়োগ করে পার্টিকে বিভক্ত করতে সক্ষম হয়।
রাষ্ট্রযন্ত্রের এধরণের পলিসির মাধ্যমে প্রয়াতনেতা এম এন লারমাকে হত্যা করে পাহাড়ের বুকে গজে উঠা মুক্তিকামী জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে চিরতরে ধ্বংস করার একটা হীন পরিকল্পনা ছাড়া অন্য কিছু নয়। প্রথম দিকে শ্রেণিগত অবস্থান থেকে জুম্ম জনগণের একটা বিরাট অংশ বিভেদপন্থী চক্রের মিষ্টি কথায় প্রভাবিত হয়েছিল। ধীরে ধীরে বেঈমানদের হীন মুখোশ তাসের ঘরের মতোই চারিদিকে খসে খসে পড়েছিল। এতোকিছু জানার পরেও মহান নেতা এম এন লারমা তথা পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃবৃন্দের যুক্তি ছিল, গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্ররা আমাদের ভাই, তারা হয়তো ভুল করেছে। কিন্তু জাতীয়তাবোধের আবেগ তথা জুম্ম জাতির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা আছে বলে শুরুতে তারা আমাদের সাথে লড়াইয়ে সামিল হয়েছে। নেতার বিশ্বাস ছিলো তারা একদিন অবশ্যই ঘরে ফিরবে, আমাদের সাথে আন্দোলনে সামিল হবে। তারা যদি ফিরে আসে আমি অবশ্যই তাদের ক্ষমা করবো। আমি চাই না আমাদের গুলিতে আমাদের কারোর মায়ের বুক খালি হোক”। নেতার এই বিশ্বাস ও উদারতাকে বিভেদপন্থী চক্ররা দুর্বলতা ভেবে ১০ নভেম্বর গভীর রাতে এম এন লারমাকে হত্যা করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে ভয়াবহ ও কলঙ্কজনক অধ্যায় জন্ম দিয়েছে।
আমরা জানি, মৃত লারমা চেয়ে জীবিত লারমা আরও অধিক শক্তিশালী। বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মানে আমাদের জুম্ম জনগণের একটা আবেগের নাম ও ভালোবাসার নাম- যা প্রতিটি মুহুর্তে আমাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করে। নিপীড়িত জুম্ম জাতিসমূহের মুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলন সংগ্রামে বিপ্লবী এম এন লারমা আজও প্রাসঙ্গিক। নির্লোভ ও নির্মোহ জীবন যাপনে বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা চিরকাল অনুকরণীয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কোন প্রকার ভোগবাদ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। ত্যাগী ও বিপ্লবী এই মহান নেতার জীবন মৃত্যুর পরেও থেমে থাকেনি। প্রতিটি সংগ্রামে, প্রতিরোধে, স্লোগানে, ব্যানার-প্লেকার্ডে ও আত্মবলিদানের মহান পথে লারমা এখনও পথপ্রদর্শক। প্রচলিত সকল ধ্যান-ধারণাকে বদলে দেয়ার প্রগতিশীল দর্শনের সফল অনুশীলনে লারমা কখনো আপোষ করেননি। সেজন্য অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর অনুচরেরা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে। অথচ দলীয় ঐক্য ও সংহতিকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে লারমা ভিন্ন মতাবলম্বীদের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। ষড়যন্ত্রকারীরা সে দিকে এগিয়ে আসেননি। ১০ নভেম্বর ১৯৮৩ সালে গভীর রাতে শাসকের অনুচরেরা লারমার গোপন ঘাঁটিতে হামলা চালায়। সেদিনে জুম্ম জাতির মীরজাফরদের বুলেটে নিভে যায় বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জীবন প্রদীপ। ঘাতকের বুলেট বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জীবন কেড়ে নিয়েছে।
মুক্তিকামী মানুষের অধিকার আন্দোলনে আমরা যারা রাজনীতিতে যুক্ত আছি, সকলের লক্ষ্য পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত জুম্ম জনগণকে বিজাতীয় শাসন-শোষণ থেকে মুক্ত করা। তা নিয়েই আমাদের আন্দোলন। এই আন্দোলনের ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে জুম্ম জনগণের মনে বাঁচার আশা জাগাতে হবে। ধীরে ধীরে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যে পরিবেশে প্রতিক্রিয়াশীল দৈত্য দানব বিভেদপন্থী চক্র টিকতে পারবে না। প্রতিক্রিয়াশীলতার মুকুট পড়ে যাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতে হয়, সেধরণের একটা প্রগতিশীল আবহাওয়া সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য জুম্ম ছাত্র সমাজকে এধরণের মহান উদ্দেশ্য নিয়ে আন্দোলন শক্তিশালীকরণের প্রচেষ্টা রাখতেই হবে! প্রতিটি সংগ্রামীকে আত্মোৎসর্গের মানসিকতায় তৈরি থাকতে হবে। অতীতে অসংখ্য পাহাড়ের বীর সন্তান পাহাড়কে শৃঙ্খলমুক্ত করতে নিজের জীবন নিঃস্বার্থভাবে উৎসর্গ করেছেন। একটু ভাবুন, এই আন্দোলনে ধরা পড়লে জেল-জুলুম, নির্মম নির্যাতন, মৃত্যু, নয়তো যাবজ্জীবন পঙ্গুত্ব নিশ্চিত তা জেনেও ভয় করেনি পাহাড়ের অগণিত জুম্ম বীরযোদ্ধা। নির্ভীকচিত্তে পাহাড়ের জুম্ম জনগণের সামগ্রিক মুক্তির জন্য এগিয়ে গেছেন।
এই ধারাবাহিকতা অক্ষুণœ রেখে বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে আন্দোলনে এগিয়ে আসা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। জুম্ম জনগণকে বুঝিয়ে দিতে হবে, সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে পুরো জগত ও প্রকৃতি। কিন্তু তরুণ সমাজ সব যুগেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী কন্ঠস্বর হিসেবে তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে আসছে। বিপ্লবী এম এন লারমা তাঁর অস্তিত্ব জানান দিয়ে জুম্ম জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে নিবেদিত প্রাণে নিজের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। পৃথিবীর দেশে দেশে মুক্তিকামী তরুণরা প্রাণশক্তিতে ভরপুর, তারা প্রতিবাদী, তারা বিদ্রোহী এবং তারা কোনখানে দমে যাওয়ার বস্তু নয়। রাজনীতিতে নিপীড়িত মানুষের মুক্তির আন্দোলনের ঢেউ সংগ্রামী তারুণ্যের হৃদয়ে আঘাত হানে। এই তরুণ সমাজ মানুষের মুক্তির জন্য, অধিকারের জন্য, নিজের আত্মপরিচয়ের অধিকার পাওয়ার জন্য, নিজস্ব ভূমি অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য অস্থির, চঞ্চল ও উন্মাদ হয়ে থাকে। অধিকারের জন্য পাগল প্রায় এই অধিকারকামী তরুণরা মরণপণ লড়াই করে অধিকার ছিনিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। এজন্য তরুণ বয়সে বিপ্লবী এম এন লারমাও ছিলেন অজেয়!
ঐক্য ও বিভেদ প্রসঙ্গে:
কাউকে বা কোনো পক্ষকে সমালোচনার জন্য বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আমার এ লেখা নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের তথাকথিত ঐক্য ও ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত, নানা বিভক্তির প্রসঙ্গে বাস্তব সত্যটাকে জনগণের সম্মুখে উপস্থাপন করার জন্যে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। প্রথমে বলে রাখা ভালো এই যে, পাহাড়ের জুম্ম জনগণের আন্দোলনকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করার জন্যে শাসকশ্রেণির ষড়যন্ত্রের কোনো শেষ নেই। আগে বিভেদ বা বিভক্তি মানে কি তা জেনে নেওয়া শ্রেয় মনে করি। অভিধানের ভাষায় যদি বলি বিভক্তি মানে হল ভাগ বা বিভাজন! যদি রাজনৈতিক গ্রামারে চলে যাই তাহলে দেখবো যে, বিভক্তি মানে পার্থক্য আর পার্থক্য মানেই হল দ্বন্দ্ব। পার্থক্যটা কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করা হবে, চিন্তা-চেতনা বা নীতি, আদর্শগত পার্থক্য ও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য, মতাদর্শগত পার্থক্য একই সমাজের মানুষের চিন্তা-চেতনা তথা দৃষ্টিভঙ্গির অমিল। অপরদিকে মানবসমাজের ক্রমবিকাশের দিকে যদি একটু ফিরে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো কোন স্তর থেকে বিভক্তির শুরু হয়েছে। তীর ছুঁড়তে গেলে আগে পেছনে টেনেই ছুঁড়লে তখন গতি বেশি হয় এবং কার্যকরীও হয়। ঠিক তেমনিভাবে পাহাড়ের এই বিভক্তি ও বিপরীতের সংগ্রাম আলোচনা করতে হলে আমারও ইতিহাসের পেছনের অধ্যায়ে ফিরে যেতে হবে।
মানবসমাজের ক্রমবিকাশের এক পর্যায়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা ব্যক্তিগত মালিকানা উদ্ভব হল সাথে সাথে শ্রেণির উৎপত্তি হয়েছে তখন থেকে সমাজের মধ্যে বিভক্তি শুরু হয়ে গেল। সেখান হতে শুরু হল মানবসমাজে বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যেকার দ্বন্দ্ব আর সংঘাত। শুরু হল শাসক আর শোষিতের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব যাকে রাজনীতির গোড়ার কথা হল শ্রেণীসংগ্রাম, একশেণি আর অপরশ্রেণির মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ও অবশেষে রাষ্ট্রযন্ত্রের পীড়ন-এই বাস্তবতা দেখা দিয়েছে। তাহলে আসল কথায় চলে যাই, বিভক্তি মানেই হল ভাগ, ভাগ মানেই হল পার্থক্য আর পার্থক্য মানেই হল দ্বন্দ্ব। আবার এখানে আরও কথা আছে, দ্বন্দ্ব কিসের উপর ভিত্তি করে পরিচিহ্নিত করা হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, নীতি ও আদর্শের উপর ভিত্তি করে দ্বন্দ্ব পরিমাপ করতে হয়। কিন্তু অতীব দুঃখের সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, এখনও অনেকেই মনে করেন জেএসএস ও ইউপিডিএফ-এর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব-সংঘাত, জেএসএস ও সংস্কারপন্থী মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব, জেএসএস ও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দলের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব, জেএসএস ও জুম্মলীগ-জুম্মদল মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব ও সংঘাত।
আমি আবার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, জেএসএস ও অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব- ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব-সংঘাত নয়, এটা হল আদর্শগত দ্বন্দ্ব, আদর্শের লড়াই। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলা হবে, এই দ্বন্দ্ব হল প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল এর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব। এই লড়াই ভাইয়ে-ভাইয়ে লড়াই নয়, এই দ্বন্দ্ব ভাইয়ে-ভাইয়ে দ্বন্দ্ব নয় এবং এই দ্বন্দ্ব ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানি ও মারামারি দ্বন্দ্ব নয়; এটা আদর্শের লড়াই, নীতি-আদর্শগত দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত বুঝতে হলে অধ্যয়ন করতে হবে প্রয়াতনেতার প্রদর্শিত চিন্তাধারা এবং তাঁর সমগ্র জীবন ও সংগ্রাম। অধ্যয়ন করতে হবে তিনি বিভেদপন্থীদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব কিভাবে নিরসন করতে চেয়েছিলেন?
ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে কিভাবে আমরা আমাদের প্রিয়নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে হারালাম। জুম্ম সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে শিকড়গড়া সেই গুণেধরা সামন্তীয় সমাজের ভুল চিন্তাধারাগুলো পরিচিহ্নিত করে সেই ভুল চিন্তাধারার বিরুদ্ধে তিনি কিভাবে আমৃত্যু সংগ্রাম চালিয়েছেন। পৃথিবীর বুকে এধরনের মহামানবের আবির্ভাব ক্ষণস্থায়ী হয়। কিন্তু তিনি যে আদর্শকে লালন করেছিলেন সেই আদর্শের কোন মৃত্যু নেই। সুবিধাবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল ও বিভেদপন্থী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের প্রতি তাঁর ছিল বিশ্বাস, গভীর মহানুভবতা আর ভালবাসা। যার কারণে হাজারো ভুল করার পরেও জুম্ম জাতীয় স্বার্থে, সামগ্রিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে “ক্ষমা করা-ভুলে যাওয়ার” নীতির ভিত্তিতে চক্রদের সকল প্রকার ভুলচিন্তাধারার পরিবর্তনের সুযোগ দিয়ে একেবারেই ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। বিপরীতে বিভেদপন্থী, প্রতিক্রিয়াশীল ও চরম সুবিধাবাদীরা জেএসএস ও গোটা জুম্ম জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করল এম এন লারমাকে হত্যা করে এবং সৃষ্টি করল জুম্ম জাতির ইতিহাসে এক কলংকজনক অধ্যায়। ইতিহাসের এই বাস্তব ঘটনা হতে শিক্ষা নিতে হবে এই ভেবে যে, “প্রতিক্রিয়াশীলরা জুম্ম জাতির জন্য কখনও কোনদিন আপন হতে পারেনি, পারবেও না”।
যদিও আমার আলোচনার বিষয়টা খুবই স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল তারপরও গভীরভাবে আলোচনার দাবী রাখে। জেএসএস তাঁর জন্মলগ্ন থেকে বিভক্তি, শোষণ, বৈষম্য, মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ ও পীড়নের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার ছিলেন। বিপ্লবী এম এন লারমার হাতে গড়া জুম্ম জনগণের প্রাণের সংগঠন জনসংহতি সমিতি তাঁর গঠনতন্ত্রে পরিষ্কারভাবে বলা আছে যে, জেএসএস হল শোষিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত জাতি ও মানুষের পার্টি। তাহলে আমাদের পিসিজেএসএস এর নীতি, আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখাটা নিশ্চয়ই সমীচীন হবে। পিসিজেএসএস এর নেতৃত্বের গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন একদিন বিপ্লবী লারমা দুই ভাই ও তাঁদের সাথে একই পথের পথিক হয়ে ৬০-৭০ দশকের তরুণ বিপ্লবী বীর সেনানীরা। বিপ্লবী দুই লারমার হাত ধরে তিল তিল করে গড়ে উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে প্রাণের সংগঠন জনসংহতি সমিতি তাঁর নেতৃত্বের গতিধারা। দীর্ঘ প্রায় ৪৭ বছর ধরে চলা জুম্ম জনগনের প্রাণের সংগঠন নানা চরাই-উৎরাই পেরিয়ে হাজারো বাধা-বিপত্তিকে উপেক্ষা করে এখনও তার ন্যায়সঙ্গত দাবী দাওয়া থেকে এক পাও পিছপা হয়নি। পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হলে সংগ্রাম ছাড়া কোন বিকল্প পথ নেই। সেজন্য অসংখ্য বীরযোদ্ধা প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে জুম্ম জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সামিল হয়েছিলেন।
বিপ্লবী এম এন লারমা ও বর্তমান নেতা শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের মধ্যে “শত ফুল ফুটুক ও শত রকমের মতবাদ পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করুক” এই চিন্তাধারাদ্বয় স্পষ্ট করে ফুটে উঠে। কিন্তু ক্ষমতালোভী, প্রতিক্রিয়াশীল ও বিভেদপন্থীদের মুখে নেতার বিরুদ্ধে অর্থহীনভাবে নিন্দার প্রলাপ ভুগতে শুনবেন। সেই বিভেদপন্থী চক্রের মুখে মিথ্যার বেসাতি ও গোয়েবলসীয় প্রোপাগা-াকেও হার মানায় এমনই ভিত্তিহীন বক্তব্য শুনবেন ভুরিভুরি। জুম্ম জনগণের আশা আকাক্সক্ষার প্রতীকরুপে আবির্ভূত হওয়া এই প্রাণপ্রিয় সংগঠনের বিরুদ্ধে যতই অপলাপ চড়াও না কেন, যতই বিভক্তির প্রসঙ্গ হাজির করে শাসকশ্রেণির গুনগান করে চলো না কেন, একদিন সত্যের পথে চলা আদর্শের কাছে ধরা দিয়ে জুম্ম জাতির নিকট প্রতারণা ও বেঈমানের চরম খেসারত দিতে হবে। সেই দিনের অপেক্ষায় থাকবে বিপ্লবী লারমার প্রদর্শিত আদর্শ ও চেতনার বিশ্বাসী পাহাড়ের অসংখ্য বীর সেনানী। যে আদর্শ ও চেতনার কোন কালে মৃত্যু হয়নি, হবেও না। মনে রাখবেন, এই আদর্শকে শুধুমাত্র কিছু সময় পর্যন্ত নিশ্চুপ করে রাখা যায়, কিন্তু সমূলে উৎপাটন করা যায় না।
অনেককেই হতাশা প্রকাশ করে বলতে শুনেছি জুম্মরা অনেক ভাগে বিভক্ত। আমি বলি আমার প্রিয় জুম পাহাড়ের মানুষ বিভক্ত হয়নি, বরং শাসকশ্রেণিরা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে “ভাগ কর, শাসন কর” এই ব্রিটিশদের নীতির ভিত্তিতে জুম্মদের শাসন, শোষণ করে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের প্রাণের সংগঠন জনসংহতি সমিতি জন্মলগ্ন থেকেই সেই বিভক্তি আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এসেছে। যারা আজ ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত নিয়ে তালমাতাল তাদেরকে আমি আহ্বান করতে চাই যে, আপনারা জুম্ম সমাজ ব্যবস্থা এবং জুম্ম সমাজের শ্রেণি বিশ্লেষণে চলে আসুন। বিষয়টি সম্পর্কে তখন আরো বেশি পরিষ্কার ধারণা লাভ করতে পারবেন। অন্যদিকে মানবসমাজের ক্রমবিকাশের স্তরগুলোতে আরও একটু করে জানার চেষ্টা করলে তো ক্ষতি নেই। আমরা মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় দেখতে পেয়েছি, বিকাশের এক পর্যায়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তি উদ্ভব হল, সাথে সাথে উদ্ভব হল শ্রেণি এবং বিষয়টা আরও দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে উঠলো ধনী-গরীব, উঁচু-নিচু, শাসক-শাসিত, শোষক-শোষিত মধ্যেকার বিভক্তি ও বৈষম্যের অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। সেই আদিম সাম্যবাদী সমাজের পরবর্তী স্তর দাস সমাজ হতে শুরু হল এই বিভক্তির অগ্রযাত্রা। সেই থেকে আজো পর্যন্ত চলছে মানবসমাজের শোষক ও শোষিত শ্রেণির মধ্যেকার দ্বন্দ্ব আর সংঘাত।
(চলবে…)
লেখক: পিসিপি’র সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি
+ There are no comments
Add yours