‘সকল গণহত্যার বিচার করতে হবে’- নান্যেচর গণহত্যা স্মরণসভায় রুমেন চাকমা

হিল ভয়েস, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, রাঙ্গামাটি: বর্বরোচিত নান্যেচর (নানিয়ারচর) গণহত্যা স্মরণে আয়োজিত এক স্মরণসভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রুমেন চাকমা বলেছেন, আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা-সেটেলার কর্তৃক সংঘটিত সকল গণহত্যার বিচার করতে হবে।

আজ ১৭ নভেম্বর ২০২৪, রোজ রবিবার, রাঙ্গামাটিতে পিসিপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পিসিপির রাঙ্গামাটি জেলা শাখার উদ্যোগে বর্বরোচিত নান্যেচর গণহত্যার ৩১তম বার্ষিকীতে শহীদদের স্মরণে একটি স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

‘নান্যেচর গণহত্যাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা-সেটেলার কর্তৃক সংঘটিত সকল গণহত্যার বিচার নিশ্চিত কর’- এই দাবিকে সামনে রেখে অনুষ্ঠিত স্মরণসভায় প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পিসিপির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রুমেন চাকমা, বিশেষ আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি, রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সদস্য রিতেশ চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এলি চাকমা। স্মরণ সভায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন পিসিপির রাঙ্গামাটি জেলা শাখার অর্থ সম্পাদক মিলন চাকমা। স্মরণ সভায় সঞ্চালনা করেন পিসিপির রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সহসাধারণ সম্পাদক রনেল চাকমা এবং সভাপতিত্ব করেন পিসিপি ররাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক সুমন চাকমা।

স্মরণ সভায় শুরুতে নান্যেচর গণহত্যাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা-সেটেলার কর্তৃক সংঘটিত সকল গণহত্যায় নিহত শহীদদের স্মরণে ১ মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।

স্মরণ সভায় প্রধান আলোচক পিসিপির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রুমেন চাকমা বলেন, “পার্বত্যাঞ্চলে পার্বত্য চুক্তির পূর্ববর্তী সময়ে সেনা-সেটেলার কর্তৃক সংঘটিত ডজনখানেক গণহত্যা এবং চুক্তির পর ২১টির অধিক সাম্প্রদায়িক হামলা ঘটানোর একটিই উদ্দেশ্য থাকতে পারে, সেটি হলো- পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিপুত্র জুম্মদের স্বভূমি থেকে উৎখাত করা এবং জাতিগতভাবে বিলুপ্তিকরণ। পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সমস্ত গণহত্যা ও সাম্প্রদায়িক হামলার একটিরও সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত হয়নি। কীভাবে হবে? খোদ সরকারই সেনা-সেটেলার বাঙালিদের হামলার লাইসেন্স দিয়ে রেখেছে। যার ফলে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে নির্দ্বিধায় ত্রাস চালাচ্ছে। আজকে সেই উগ্র সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী শক্তিসমূহের নারকীয় দৌরাত্ম্য পার্বত্য চট্টগ্রামের চারদিকে। তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বিরোধিতা করে আবার ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে চুক্তির ফসল ভোগ করতে চায়। আজ চুক্তির মাধ্যমে গঠিত জেলা পরিষদসমূহে অস্থানীয় সেটেলার বাঙালিরা বসে আছে। আজকে চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী অপশক্তিরা দেশে-বিদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চুক্তির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে, ষড়যন্ত্র করছে। কিছুদিন আগে কলকাতা নিউজ নামক একই কথিত নিউজ চ্যানেলে জনসংহতি সমিতির কথিত নেতা আলাদা রাষ্ট্র চায় বা ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তোলেন। জনসংহতি সমিতির নাম জড়িত করে এরকম মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্রের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। তারা জুম্ম জনগণের মুক্তির সনদ পার্বত্য চুক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে স্বার্থের খেলায় মেতে উঠেছে।”

তিনি আরো বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফদের হুশ ফিরুক। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে তাদের যেকোনো ষড়যন্ত্র জুম্ম জনগণ বরখাস্ত করবে না। জুম্ম জনগণ তাদের সেই চুক্তি বিরোধী সকল কার্যক্রম প্রতিহত ও প্রতিরোধ করতে বদ্ধ পরিকর। আর তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সংঘটিত সকল গণহত্যার বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি জানান এবং গণহত্যার সাথে জড়িত সকল সেটেলার বাঙ্গালি ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিচারের আওতায় আনতে হবে বলে মন্তব্য করেন।”

পরিশেষে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় বৃহত্তর আন্দোলনে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান।

স্মরণ সভায় রিতেশ চাকমা বলেন, ‘নান্যেচর গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল ১৯৯৩ সালের ১৭ই নভেম্বর। এই বর্বরোচিত গণহত্যার ৩১টি বছর সময়ের পাতা থেকে চলে গেলেও, ঐ ঘটনায় নিহত হওয়া লাশেরা ন্যায় বিচার পায়নি, গুমের শিকার ব্যক্তিদের খোঁজ মেলেনি। দীর্ঘ সময় পরেও জুম্মদের উপর চালানো গণহত্যাসমূহের জন্য বিচারের দাবি করতে হয়। কিন্তু বিচার চাইবো কার কাছে? এত বছরেও এই রাষ্ট্র নান্যেচর সহ অপরাপর গণহত্যার সঠিক তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করতে পারেনি, বিচার তো দূরের কথা। এটা রাষ্ট্রের জন্য ব্যর্থতা, এটা রাষ্ট্রের জন্য চরম লজ্জার।’

স্মরণ সভায় এলি চাকমা বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামে গণহত্যা, সাম্প্রদায়িক হামলা, গুম-খুন, ধর্ষণের মতো ন্যাক্কারজনক ও বর্বরোচিত ঘটনার জন্ম দিয়েছে সেনা-সেটেলার চক্র। তারা একদিকে জুম্মদের অধিকার ভূলুণ্ঠিত করছে, আরেকদিকে সমানতালে চালানো হচ্ছে নির্মম অত্যাচার। পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের পরও জুম্ম নারীরা ধর্ষনের শিকার হচ্ছে, জুম্মরা স্ব-ভূমি থেকে উৎখাত হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে চারিদিকে আজ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। চারিদিকে ক্ষোভ, হতাশা,ভয়, সে এক অদ্ভুত অবস্থা। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য অবশ্যই পাহাড়ের তরুণ সমাজকে গুরু দায়িত্ব নিতে হবে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনে অধিকতর ভাবে সামিল হতে হবে।”

পরিশেষে স্মরণ সভায় সভাপতির বক্তব্যে সুমন চাকমা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত নিপীড়ন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করতে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী সকল প্রকার ষড়যন্ত্র জারি রেখেছে। তরুণরাই সজীব শক্তি, আগামীদিনের ভবিষ্যৎ।’

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে সেই তরুণ সমাজকে সামিল হতে হবে বলে স্মরণ সভাটি সমাপ্ত করেন তিনি।

More From Author

+ There are no comments

Add yours