হিল ভয়েস, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, রাঙামাটি: আজ ২৫ নভেম্বর ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলনে ছাত্র সমাজ অধিকতর সামিল হউন’- এই স্লোগানকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ শাখার ২৮ তম বার্ষিক শাখা সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক জুয়েল চাকমা। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি, রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুমিত্র চাকমা, পিসিপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যা, পিসিপির রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক সুমন চাকমা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন, রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক উওয়াই নু মারমা।
বার্ষিক শাখা সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠানটি সঞ্চলনা করেন পিসিপির রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ শাখার ২৭তম বিদায়ী কমিটির সাধারণ সম্পাদক সজল চাকমা এবং সভাপতিত্ব করেন বিদায় কমিটির সভাপতি সুনীতি বিকাশ চাকমা। অনুষ্ঠানের শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সকল শহিদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জুয়েল চাকমা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামর ২৭টি বছরের চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা কার্যকর হয়ে উঠেনি, পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য রক্ষা হয়নি, অপারেশন উত্তরণসহ অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়নি, জুম্ম জনগণের ভূমির মালিকানা নিশ্চিত হয়নি, জুম্মদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে স্থানীয় পুলিশ ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। ফলশ্রুতিতে জুম্ম জনগণ আজ অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে রয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ অতি সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে আলোচনা না করে অনুগত লোকদের জেলা পরিষদ পুর্নগঠন করা হয়েছে যেখানে অস্থানীয় সেটেলার বাঙালি কয়েকজনকে সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী যথাযথ নয়। পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্যাঞ্চলে যেকোন আইন প্রণয়ণের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিষদের সাথে আলোচনা ও পরামর্শ নেওয়ার আইনী বাধ্যবাদকতা থাকলেও সেটি করা হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী স্থানীয় ভোটার তালিকা প্রণয়নপূর্বক তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন না দিয়ে দলীয় লোকদের দিয়ে পুর্নগঠন করায় পার্বত্যাঞ্চলের স্থানীয় জনগণ এখনও নিজেদের পছন্দমতো প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারেনি। পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহে নির্বাচন না হওয়ায় আঞ্চলিক পরিষদেরও নিবার্চন হতে পারেনি।’
তিনি আরো বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। বর্তমান অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারকে অবশ্যই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য রোডম্যাপ ঘোষণাপূর্বক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের যথাযথ ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।’
জুয়েল চাকমা আরো বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যাতে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হতে না পারে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে সাথে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় সেজন্য শাসকগোষ্ঠী ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতির ভিত্তিতে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থি বিভিন্ন সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এই সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো জনগণকে নানাভাবে বিভ্রান্তকরণের মাধ্যমে জুম্ম জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে বিভাজন করে চলেছে। বিভেদপন্থি সেসব সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সবাইকে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং তাদেরকে বর্জন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে চলমান পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলনে সবাইকে অধিকতর সামিল হতে হবে।’
বিশেষ অতিথি বক্তব্যে সুমিত্র চাকমা বলেন, ‘বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি জাতিকে টিকিয়ে রাখার, সংস্কৃতি ধরে রাখার, নিজের পরিচয়ে গড়ে ওঠার শিক্ষা পাওয়া যায় না। কিন্তু পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ নিজেকে টিকিয়ে রাখার, জাতির অস্তিত্ব ধরে রাখার, সংস্কৃতিকে আগলে রাখার শিক্ষা দেয়। এজন্য পাহাড় ছাত্র পরিষদকে একটি পাঠশালা হিসেবে কাজ করে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা একটি সার্বজনীন সমস্যা। এই সমস্যা একটি নির্দিষ্ট জাতির কিংবা নির্দিষ্ট শ্রেণীর নয়। তাই এ বিষয় কে উপলব্ধি করে আমাদের সকলকে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে সামিল হতে হবে।’
তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের সময় কালকে ক্ষেপন না করে জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ প্রদত্ত শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেকে গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে শোষণ সেই ব্রিটিশ, ব্রিটিশ-ভারত ও পাকিস্তান সময় হতে চলমান রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্ববর্তী সময় হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত জুম্মদেরকে বিভিন্নভাবে শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক অত্যাচার, শোষণ করা হচ্ছে। এই শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ তার জন্মলগ্ন থেকে লড়াই করে আসছে। তিনি আরো বলেন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা একটি পুঁজিবাদী। এই শিক্ষাব্যবস্থা একটি ব্যক্তিকে স্বার্থান্বেষী করে তুলে। তিনি ছাত্রদের এই শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তব শিক্ষা গ্রহণের আহ্বান জানান।
সুমন চাকমা বলেন, ‘তরুণরাই সমাজের শক্তি, তরুণরাই বিপ্লবের আধার। শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতন-নিপীড়নের হাত থেকে উত্তরণের জন্য তরুণদের শক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে। পিসিপির কর্মীদের মহান নেতা এমএন লারমার আদর্শ বুকে ধারণ করে কাজ করতে হবে।’
উওয়াই নু মারমা বলেন, ‘জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আন্দোলনের কোন বিকল্প নেই। এই আন্দোলন সফল করতে হলে নারী-পুরুষ সবাইকে একসাথে যুক্ত হতে হবে। সমাজের অর্ধেক অংশ নারী। নারীদের বাদ দিয়ে কোন আন্দোলন সফল হবেনা। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনেও নারী সমাজকে অধিকতরভাবে সামিল হতে হবে।’
কাউন্সিল অধিবেশনের প্রথম পর্বে আলোচনা সভা এবং দ্বিতীয় পর্বে পিসিপি রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ শাখার ২৭তম কমিটির বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। উপস্থিত সকলের সর্বসম্মতিক্রমে বিপুল করতালির মাধ্যমে সভাপতি হিসেবে সজল চাকমা, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে জ্ঞান চাকমা এবং সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে করুণ জ্যোতি চাকমাকে নির্বাচিত করে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট পিসিপির রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ শাখার ২৮তম কমিটি ও বিভিন্ন ইউনিট কমিটি ঘোষণা করা হয়।
নবনির্বাচিত কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা ও শপথ বাক্য পাঠ করান পিসিপির কেন্দ্রীয় সদস্য রনেল চাকমা।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন পিসিপির রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ শাখার ২৭তম কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক কবিতা চাকমা এবং বার্ষিক সাংগঠনিক প্রতিবেদন পেশ করেন পিসিপির রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ শাখার ২৭তম কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সচিব চাকমা।