সোহেল তনচংগ্যা
বর্তমান একবিংশ শতাব্দী বিশ্ব সামাজিক নানা বাস্তবতা এবং তথ্য প্রযুক্তির এক নতুন বিপ্লব নিয়ে অগ্রযাত্রায় পদার্পণ করতে যাচ্ছে। সমাজের এই অগ্রযাত্রা তরুণ প্রজন্মকে যেমনি করেছে অগ্রগামী অন্যদিকে করেছে নব যুগের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। যার ফলস্বরূপ শাসক শ্রেণি এখনো নব নব কায়দায় শোষণকার্য পরিচালনা করে যাচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস এবং পরিস্থিতি মূল্যায়নে তরুণ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র (এম এন লারমা) দর্শনের অধ্যয়ন অতীব জরুরী। জুম্ম সমাজের বাস্তবতা এবং এখানকার মানুষের জীবনধারা এম এন লারমা’র চিন্তাধারার সাথে অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত। তাইতো সামন্তীয় যাঁতাকলে আষ্টে-পৃষ্টে বাঁধা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে প্রথম মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তরুণ এম এন লারমা।
তরুণ এম এন লারমা’র চিন্তাধারা শুধুমাত্র পাহাড়ের মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি সমতলের খেটে-খাওয়া কৃষক, শ্রমিক, রিক্সাচালক, এমনকি সমাজে সবচেয়ে অবহেলিত যেসব নারী যারা অসহায় জীবনযাপন করে থাকে যাদের সমাজে পতিতা বা বিভিন্ন নামে নামকরণ করেছে সেই সব মানুষদের অধিকারের জন্যেও তখনকার গণপরিষদে দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে লড়েছিলেন। কিন্তু তখনকার বাঙালি জাত্যাভিমানী শাসকগোষ্ঠী তরুণ এম এন লারমা’কে উপেক্ষা ও চিন্তাধারাকে বুঝতে অক্ষম হয়েছিলেন। এম এন লারমা’র চিন্তাধারা তখনকার সময়ে বৈপ্লবিক রূপে সমাজে বিস্তার লাভ করেছিল। সমান্তীয় সমাজকে তিনি পরিবর্তনের জন্য সর্বদা চেষ্টা করেছেন।
সম্প্রতি সমগ্র বিশ্ব এক যুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিশ্বের রাজনীতির মোড় দিন দিন ভয়াবহতায় রূপ নিচ্ছে। একদিকে পুরো উৎপাদনব্যবস্থা পুঁজিপতিদের হাতে কুক্ষিগত হচ্ছে, অন্যদিকে শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণি সমাজের উৎপাদনযন্ত্র থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে পুঁজিবাদের উত্থান সমাজের শোষণের নতুন মাত্রা ধারণ করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম নয়। দেশের শাসকগোষ্ঠী পরিবর্তন হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশ্নে হাকিম নড়ে তবুও হুকুম না নড়ার মতোই। অর্থাৎ শোষণের মাত্রা কোন শাসকের শাসনামলে কমেনি। যেমনটা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন পরবর্তী অন্তবর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে সমতার দৃষ্টিতে দেখেন না বলে পরিলক্ষিত হয়। এই সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে ব্যস্ত, অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশ্নে অতি উদাসীন। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৭ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও চুক্তি বাস্তবায়নের আশা জুম্ম জনগণ দেখছে না।
এমতাবস্থায় বর্তমান তরুণ সমাজের ভূমিকা কিরূপ হওয়া উচিত? ছাত্র ও যুব সমাজ এম এন লারমার বিষয়ে তারা কতটুকু জ্ঞাত? লারমার চিন্তাধারাকে আসলে কি তারা ধারণ করতে পারছে? প্রশ্ন থাকে।
সম্প্রতি দেশে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন সমগ্র ছাত্র সমাজের মধ্যে এক জোয়ার সৃষ্টি করেছে। এই জোয়ার পাহাড়ের ছাত্র ও যুব সমাজে প্রভাব পড়েছে। যার ফলে তিন পার্বত্য জেলায় ছাত্র সমাজ প্রথমে ‘বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন’, পরবর্তীতে ‘সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ী ছাত্র আন্দোলন’ এর ব্যানারে মিছিল করতে দেখা যায়। কিন্তু পাহাড়ের ক্ষেত্রে ‘বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন’ জুম্ম জনগণকে কি আদৌ অধিকার ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হবে? নাকি এই আন্দোলনের অজুহাতে পাহাড়ে আবারো ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ পলিসি শাসক শ্রেণি তৈরি করছে, যা ‘বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ী ছাত্র আন্দোলন’ সমন্বয়কেরাও এর দায় এড়াতে পারেন না।
অথচ এম এন লারমা’র ‘জুম্ম জাতীয়তাবাদ’ এর ভিত্তিতে জুম্ম সকল জাতি সম্মিলিত জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতিগত মুক্তির কথা বলা হয়েছে। সেটার মাধ্যমেও আমরা এক হওয়ার শক্তি পেতে পারি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি রাজনৈতিক সমস্যা যা রাজনৈতিকভাবে সমাধান সম্ভব। ফলে সমতলের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন আর পাহাড়ের আন্দোলন অভিন্নভাবে দেখলে রাজনৈতিকভাবে তা ভুল বলে গণ্য হবে। যেমনটি তৎকালীন স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে ভুল করেছিল। তদ্রুপ বর্তমানে বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ী ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে, সমতলের আন্দোলন কোনো না কোনোভাবে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন, কিন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশ্নে তা জুম্মদের অস্তিত্ব সংরক্ষণের আন্দোলন। সুতরাং বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ী ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জুম্মদের অস্তিত্ব ও স্বার্থ রক্ষা হবে না।
কোন আন্দোলন পরিচালনা করতে গেলে প্রয়োজন নীতি, আদর্শ ও আন্দোলনের সঠিক ধারণা। যদি আবেগবশত কোনো আন্দোলন পরিচালিত হয় তাহলে সেই আন্দোলন একটা সময়ে গিয়ে ভুল পথে পরিচালিত হতে থাকবে। সুতরাং পাহাড় এবং পাহাড়ের জুম্ম জনগণকে জানতে হলে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র (এম এন লারমা) চিন্তাধারা অবশ্যই অধ্যয়ন এবং আদর্শকে ধারণ করা জরুরী।
প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র জুম্ম জাতীয়তাবাদ আমার কাছে সময়োপযোগী ও ঐক্যের মতাদর্শ বলে মনে হয়। আমরা পাহাড়ে জুম্মরা ভিন্ন ভাষাভাষি ও চৌদ্দটি জাতি বাস করি। আমাদের মধ্যে রাষ্ট্রের সাথে যে সমস্যা সবার সমস্যা অভিন্ন। কাজেই বিচ্ছিন্নভাবে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা কালক্ষেপণ বলা যায়। আমাদের যা করণীয় তা হলো জুম্ম জাতীয়তার ভিত্তিতে এক হওয়া এবং অনাগত শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই করা। জাতিগত দিক থেকে সমস্যা ভিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই। দীর্ঘ ২৬ বছর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জন্মের পর থেকে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলমান রয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পাঁচ দশকের অধিক সময় থেকে জাতিগত অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে পাহাড়ের মানুষ। পাকিস্তান আমলে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে এম এন লারমা’র বলিষ্ঠ কন্ঠ এখনও অধিকারকামী মানুষকে লড়াই করতে অনুপ্রেরণা যোগায়। সে অনুপ্রেরণা নিয়ে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম সামনের দিনগুলোতে অস্তিত্ব রক্ষায় যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস আমার।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ভয়াবহতায় রূপ নিচ্ছে। আদর্শিক দ্বন্দ্বের পাশাপাশি এখানকার বিজাতীয় শাসন আরও উদ্বেগজনক ও হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ২৬ বছরেও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নকে প্রাধান্য না দিয়ে পাঁচ দশক ধরে সেটেলার বাঙালিদের সংখ্যানুপাত এবং জাতিগত বিভাজন নীতিকে উৎসাহ দিয়েছে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী। এতে করে পাহাড়ে অশান্তি অত্যাধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। যত বারে পাহাড় আক্রান্ত হয় শুধু টক শো, সাক্ষাৎকার ও টিভি রিপোর্টই হয়। সমাধানের কোনো চেষ্টাই করা হয়নি। যার ফলে সংকট বাড়ছে। এখন তরুণ প্রজন্ম শাসকগোষ্ঠীর এহেন প্রোপাগান্ডা গ্রহণ করে না।
জুম্ম শিক্ষার্থীরা পূর্বের তুলনায় অধিকার সচেতন হয়ে উঠেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিও বিস্ফোরন্মুখ অবস্থায় রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে বিরোধীতার সকল উপাদান প্রত্যাখানের মনোভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে জুম্ম জনগণের কাছে। যুদ্ধের জটিল পরিস্থিতি তৈরি হবার পরিবেশ জন্ম হচ্ছে। কাজেই শাসকগোষ্ঠীর উচিত হবে অতিদ্রুত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া। যত বিলম্ব তত সমস্যার মাত্রা বাড়বে।
জুম্ম তরুণ সমাজকে স্বার্থবাদিতাকে পরিহার করে ন্যায়-অন্যায়ের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পরিস্থিতিতে মূল্যায়ন করতে হবে। দুনিয়াজুড়ে সর্বত্র ন্যায় ও অন্যায়ের দুই পক্ষ দেখা যায়। তাই আমাদেরও যেকোন একটি পক্ষ নিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে চুক্তি বাস্তবায়ন তথা জুম্মস্বার্থ রক্ষা আন্দোলন বনাম চুক্তি বিরোধী তথা জুম্মস্বার্থ পরিপন্থী আন্দোলন চলমান রয়েছে। এখান থেকে যেকোন একটার পথ বেছে নিতে হবে।
পরিশেষে জুম্ম তরুণদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান “আসো, পড়ো, বুঝো এবং দায়িত্ব কাঁধে নাও, ক্রান্তিকালে জুম্ম জাতিকে মুক্ত করো”।
+ There are no comments
Add yours