পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী ছাত্র রাজনীতিতে প্রসিত চক্র (শেষ অংশ)

পলাশ খীসা

গত ১ আগষ্ট ২০০১ ইউপিডিএফ খাগড়াছড়ি ইউনিট থেকে একটা লিফলেট প্রকাশিত হয়। লিফলেটের হেডিং-এ লেখা ছিল – ‘জেএসএস এর প্রতি আহ্বান- ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানি নয়, আসুন জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হই’। লিফলেটের শেষে তারা লিখেছে – ‘ইউপিডিএফ অতীতে জেএসএস এর কোনো গণতান্ত্রিক কাজে বাধা দেয়নি, ভবিষ্যতেও দেবে না। ভিন্নমত সত্ত্বেও জেএসএস এর ডাকা হরতালে সমর্থন দিয়ে শুভেচ্ছার হাত প্রসারিত করেছে। আমরা আবারও ঘোষণা দিচ্ছি আমাদের পার্টি চুক্তি বাস্তবায়নে জেএসএস’কে সহায়তা দেবে। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আসুন আমরা যুগপৎভাবে আন্দোলন গড়ে তুলি।’ প্রসিত চক্রের এই আহ্বান সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে খুবই চমৎকার। কারণ ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানি কেউ চায় না। প্রকৃত অর্থে যারা জুম্ম জাতীয়তাবাদী এবং অধিকার প্রত্যাশী তারা সবাই চায় ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু যারা অতীত সম্পর্কে খবর রাখে কিংবা প্রসিত চক্রের উৎপত্তি, বিকাশ ও তাদের সম্পর্কে ভালো করে জানে তাদের কাছে এই আহ্বান হাস্যকর। এটা সহজ সরল জুম্মদেরকে প্রতারণা করার কৌশল ছাড়া কিছুই নয়।

প্রসিত চক্র শুরুতেই বলেছিল যে তারা অতীতে জেএসএস এর কোনো গণতান্ত্রিক কাজে বাঁধা দেয়নি, ভবিষ্যতেও দেবে না- একথা সত্য নয়। তারা প্রতি পদে পদে জেএসএস এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। তন্মধ্যে একটি হলো- ১০ নভেম্বর ১৯৯৮ যখন জেএসএস এম এন লারমার ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী কেন্দ্রীয়ভাবে খাগড়াছড়িতে পালন করে। সেই কর্মসূচীতে বিভিন্ন জায়গা থেকে জেএসএস কর্মী-সমর্থকরা আসার পথে প্রসিত চক্র কর্তৃক বাধাগ্রস্ত হয়। প্রসিত চক্রের সন্ত্রাসীরা সেদিন বিজিতলা নামক জায়গায় সকাল বেলা এম এন লারমার ছবি ভাংচুর ও পুড়িয়ে ফেলে এবং মহালছড়ি থেকে অনুষ্ঠানে আসা একটি বাস সেখানে আটকে রাখে। অনুষ্ঠান শেষে সন্ধ্যার দিকে কর্মীদের বহনকারী ১০টি বাস মহালছড়ি ফেরত যাওয়ার পথে বিজিতলায় প্রসিত চক্রের সন্ত্রাসীরা আক্রমণ চালায়। সেখানে জনসংহতি সমিতির জীবন প্রদীপ দেওয়ান, ইরান কুমার চাকমাসহ ২০ জন সদস্য-সমর্থক গুরুতর আহত হন এবং বাসগুলো ভাংচুর করা হয়।

তারা নিজেদেরকে গণতান্ত্রিক দাবী করলেও বাস্তবিক অর্থে তারা গণতান্ত্রিক নয়। তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে অগণতান্ত্রিক আচরণ করে চলেছে। জনসংহতি সমিতির সদস্যরা চুক্তির পর পরই যখন অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য যাচ্ছে তখন তাদেরকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে, জুতা দেখিয়ে হেনস্থা করে। তারা জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও জুম্ম জনগণের পরীক্ষিত নেতা সন্তু লারমার মাথায় শিং এঁকে দিয়ে পোষ্টার ছাপায় ও দেওয়াল লিখন করে অসুস্থ ও অগণতান্ত্রিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। দীর্ঘ আড়াই দশক ধরে কঠোর কঠিন পরিশ্রম করে জীবন বাজী রেখে যারা জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছিল এবং একটা চুক্তির মধ্য দিয়ে অধিকারের সনদ নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিল তাদেরকে এভাবে হেনস্থা করা কোনো দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক মানুষের আচরণ বা কাজ হতে পারে না।

তাদের প্রচারপত্রে ‘ভিন্নমত থাকা সত্ত্বেও জেএসএস এর ডাকা হরতালে সমর্থন দিয়ে শুভেচ্ছার হাত প্রসারিত করেছে’ বলে তারা যেটা উল্লেখ করেছিল সেটা আংশিক সত্য মাত্র। জেএসএস যখন তৎকালীন টাস্ক ফোর্স চেয়ারম্যান ও উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবীতে হরতাল আহ্বান করেছিল সেই হরতালে প্রসিত স্রেফ একটা বিবৃতি দিয়ে সেই হরতালকে সমর্থন জানায়। সেখান থেকে বেশী দূর যায়নি তাদের শুভেচ্ছার হাত। হরতালের সমর্থনে কোথাও তারা পিকেটিং কিংবা সভা করেনি।

২০০১ সালের ১ আগষ্টে এসে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে চুক্তি কতটুকু বাস্তবায়িত হবে কিংবা জুম্ম জনগণ কতটুকু অধিকার লাভ করবে? ইতিমধ্যেই ক্ষতি যা হবার হয়েই গেছে। সরকারের সাথে বৈঠকের সময় বৈঠকের বিরোধীতা করার মধ্য দিয়ে জুম্ম জনগণকে যে ক্ষতির সম্মুখীন করা হয়েছে তা আর পূরণ হবার কথা নয়। আজ পর্যন্ত ৪১ জন জেএসএস সদস্য-সমর্থক ও শুভাকাঙ্খীকে খুন করা হয়েছে, ৩০০ জনের অধিক অপহরণ করে গুম করা হয়েছে, ২৫০ জনকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, ৫০০ জনের অধিক লোককে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে মুক্তিপণ আদায়, ঘরবাড়ী লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে।

৩ জন বিদেশীকে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০১ তারিখে অপহরণ করার মধ্য দিয়ে বিদেশী সংস্থা কর্তৃক সমস্ত উন্নয়ন কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সর্বোপরি এই অপহরণের মাধ্যমে প্রসিত চক্র কর্তৃক সেনাবাহিনীকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থান করার একটা সুযোগ ও ভিত্তি সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে। ফলে জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটা সুদূর প্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করা হয়েছে চুক্তি বিষয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সন্দেহ, অবিশ্বাস সৃষ্টি করে জুম্ম জনগণকে বিভক্ত করার মাধ্যমে। গোটা পার্বত্য এলাকা জুড়ে সন্ত্রাস, হানাহানি ও চাঁদাবাজীর মাধ্যমে আন্দোলন সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা সৃষ্টি করা হচ্ছে। চুক্তির বিরোধিতা করে চুক্তি পক্ষের লোকজনকে খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়ের মাধ্যমে সরকারকে সহযোগিতা করা হয়েছে চুক্তি বাস্তবায়ন না করার জন্য। ফলে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার চুক্তির মৌলিক দিকগুলো বাস্তবায়ন না করে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছে। বর্তমানে বিএনপি’র নেতৃত্বে ৪ দলীয় জোট সরকার চুক্তি কতটুকু যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করবে তাতে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বাস্তবিক অর্থে আমরা যদি চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারি তাহলে যে কোন সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন করতে বাধ্য, অন্যথায় নয়।

তারপরও আমরা জুম্ম জনগণ আশ্বস্ত হতে পারতাম যদি প্রসিত চক্র তাদের ১ আগষ্ট তারিখের প্রচারপত্রে যা লিখেছে তা পালন করতো। আমার মনে হয় তারা যা বলে এবং লেখে বাস্তবে তার উল্টোটাই করে। তারা যা লিখেছে তা বাস্তবায়ন করলেও আমরা অন্ততঃ ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানি দেখতাম না, দেখতাম না কাউকে নির্মমভাবে খুন, অপহরণ হতে এবং অপহৃত হয়ে মুক্তিপণের বিনিময়ে ছাড়া পেতে। দেখতে পেতাম সকল জুম্ম জনগণ চুক্তি বাস্তবায়ন তথা অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে লড়ছে। তাদের এই বিবৃতির পরও আমরা শুনেছি, দেখেছি জনসংহতি সমিতির অনেক অনেক নেতা-কর্মী ও শুভাকাঙ্খীদের অপহরণ করতে, রাতের অন্ধকারে খুন হতে। তাদের এই বিবৃতির পর অনেকগুলোর ঘটনার মধ্যে দু’টো ঘটনার বিবরণ দেবো।

এক.
গত ১৮ অক্টোবর ২০০১ তারিখে প্রসিত চক্রের সন্ত্রাসীরা মহালছড়ি থানার মুবাছড়ির খুলারাম পাড়ায় যায়। সেখান থেকে তারা ৫ জনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। তিনজনকে ছেড়ে দিলেও বাকী ২ জনের মধ্যে আইনষ্টাইন চাকমার কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি। সম্ভবতঃ তাকে খুন করা হয়েছে। অপর একজন হলেন প্রসিতের আপন চাচাতো ও খালাতো ভাই বাপ্পী খীসা অর্থাৎ প্রসিত ও বাপ্পীর বাবারা আপন ভাই এবং উভয়ের মা আপন বোন। অথচ বাপ্পীকে প্রসিত চক্রের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনতে মুক্তিপণ দিতে হয়েছে ৪ লক্ষ ৭৯ হাজার টাকা। সন্ত্রাসীদের নেতা অভিলাষ চাকমা খাগড়াছড়ির পেরাছড়া এলাকায় সেই টাকা গ্রহণ করে বাপ্পী খীসাকে মুক্তি দেয়। বাপ্পী জনসংহতি সমিতির কোনো নেতা বা কর্মী ছিলেন না। তারপরও তাকে কেন অপহরণ করার পর মুক্তিপণ আদায় করা হলো- এই প্রশ্ন সবার, ব্যক্তিগতভাবে আমারও। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি পারিবারিক শত্রুতাকে কাজে লাগিয়েছে প্রসিত। প্রসিতের দাদী খুলারাম পাড়ায় মৃত্যুবরণ করেন কয়েক বছর আগে প্রসিতের এক চাচার বাসায়। সেই সময়ে প্রসিতের সেই চাচা ছিলেন সমাজচ্যুত। সামাজিক অপরাধ করার কারণে গ্রামের কেউ তার বাসায় যেতো না। মায়ের মৃত্যুর খবর শুনে প্রসিতের বাবা গ্রামের বাড়ী গিয়ে দেখতে পান তার মায়ের মৃতদেহ ছোট ভাইয়ের বাসায় গ্রামের লোকজন ছাড়া পড়ে রয়েছে। গ্রামের কেউ সেখানে নেই। দাহ করারও কোনো আয়োজন নেই। প্রসিতের বাবা অনন্ত বিহারী গ্রামের কয়েকজন মুরুব্বীকে ডেকে পাঠালেন তার কাছে যাওয়ার জন্য। তারপরও কেউ গেলো না। পরে তিনি গ্রামের প্রতিটি বাড়ীতে গিয়ে সবার কাছ থেকে ক্ষমা চাইলেন এবং অনুরোধ করলেন অন্ততঃ মায়ের মৃতদেহটা যেন সৎকার করা হয়। তখন গ্রামবাসী সবাই মিলে মৃতদেহকে সৎকার করলো। অনন্ত বিহারী খীসা নিজেকে অনেক পন্ডিত এবং সম্মানী মানুষ হিসেবে ভাবতেন। গ্রামবাসীদের কাছে ক্ষমা চাওয়াটা অপমান হিসেবে ধরে নিয়ে তিনি কোনো মতেই তা মেনে নিতে পারেননি। সেই ঘটনার জন্য তার আরেক ভাইয়ের ছেলে প্রজ্ঞান খীসা ও বাপ্পী খীসাকে দায়ী করতেন। তাদের কারণে গ্রামবাসীদের কাছে মাথানত করতে হয়েছে বলে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। অনুরূপভাবে প্রসিতও তার বাবার সেই অপমানিত হওয়ার ঘটনা সহজেই মানতে পারেনি। তাই প্রতিশোধ নেয়ার জন্য এই অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়। উল্লেখ্য যে, বাপ্পীকে অপহরণ করার পর তার মা অনন্ত বিহারী খীসার বাসায় যান ছেলের মুক্তির ব্যাপারে। তখন অনন্ত বিহারী খীসা তাকে বলেন – ‘এটা ছেলেদের ব্যাপার, আমি কিছুই জানি না এবং কিছুই করতে পারবো না’। অথচ খাগড়াছড়ির সবাই জানে অনন্ত বিহারী খীসা প্রসিত চক্রের সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দাতা এবং অন্যতম উপদেষ্টা। সেই সময় প্রসিত চক্র অনন্ত বিহারী খীসার বাড়ীতে ইউপিডিএফের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে সন্ত্রাসীদের আস্তানা গড়েছে।

দুই.
গত ২৩ ডিসেম্বর ২০০১ তারিখে একদল চুক্তি বিরোধী সন্ত্রাসী রাঙ্গামাটি জেলাধীন লংগদু থানার তিনটিলা গ্রামে রাত আনুমানিক ৯টার দিকে দেব বিকাশ চাকমাকে (সুবীর ওস্তাদ) দরজা ভেঙ্গে বাড়ীতে ঢুকে গুলি করে হত্যা করে। শহীদ দেব বিকাশ চাকমা জনসংহতি সমিতির লংগদু থানা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। তিনি ১৯৭৫ সালে তাঁর বয়স যখন পনর কি ষোল বছর তখন জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দেন। দীর্ঘ দুই দশকের বেশী সময় ধরে সশস্ত্র সংগ্রামে অমূল্য অবদান রেখেছেন। তিনি জীবন বাজী রেখে শত্রুবাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়ে শত্রুবাহিনীকে পরাস্ত করে অনেক অনেক অস্ত্র-গোলাবারূদ ছিনিয়ে এনেছেন এবং শত্রু শিবিরে ত্রাস সৃষ্টি করেছেন। সেই সময়ে তাঁর নাম শুনলেই শত্রু শিবিরে আতঙ্ক সৃষ্টি হতো। অপরদিকে নতুন ভর্তি হওয়া সদস্যদের গেরিলা প্রশিক্ষণ দিয়ে অনেক সুনাম অর্জন করেছেন। অথচ সেদিন সন্ত্রাসীরা রাতের অন্ধকারে নির্মমভাবে তাকে হত্যা করে। সেদিন সন্ত্রাসীদের বুলেটের আঘাতে দেব বিকাশ চাকমা শহীদ হলেন। অসময়ে অসহায়ভাবে ফেলে যেতে বাধ্য হলেন নিজের প্রিয়তমা স্ত্রী ও অবুঝ চার সন্তানকে। তাঁর চার সন্তানের মধ্যে তিনজনই মেয়ে, একটি মাত্র ছেলে- যার বয়স এখনো দুই মাস। বড় মেয়ে মঞ্জু অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে, দ্বিতীয় মেয়ে মহতী চতুর্থ শ্রেণীতে, তৃতীয় মেয়ের বয়স চার বছর।

২৫ ডিসেম্বর ২০০১ দেব বিকাশ চাকমার অন্তোষ্টিক্রিয়ায় রাঙ্গামাটি থেকে জেএসএস এর সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে উষাতন তালুকদার ও চন্দ্রশেখর চাকমাসহ ১৬ জনের একটি প্রতিনিধিদল লংগদুতে যান। তাদের সাথে আমিও ছিলাম বীর শহীদ সুবীর ওস্তাদকে সর্বশেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। দেব বিকাশ চাকমার মৃতদেহ শ্মশানে নেয়ার সাথে সাথে আমরাও তার স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলাম, শ্মশান থেকে সরাসরি রাঙ্গামাটি ফিরে আসবো বলে। শহীদ দেব বিকাশের স্ত্রী উষাতন তালুকদার, চন্দ্রশেখর চাকমাদের প্রণাম করার পর আমাকে প্রণাম করতে চাইলেন। আমি বাঁধা দিয়ে বললাম আমাকে নয়। তিনি স্বামী হারানোর শোকে এতটা চোখের জল ফেলে চলেছেন যে বুঝতে পারছেন না, কাকে কাকে প্রণাম করতে হবে। ভবিষ্যত অন্ধকার দেখছিলেন তিনি এই দুনিয়ায় চার অবুঝ সন্তানকে নিয়ে কিভাবে বেঁচে থাকবেন, কিভাবে চলবে তার সংসার? ছেলেমেয়েদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসার খরচ পাবেন কোথায়? দুই মাস বয়সের ছেলে কথা বলতে শিখে যখন বাবাকে খুঁজবে কী জবাব দেবেন তিনি। কেন তার বাবাকে হত্যা করা হলো? তিনি নিশ্চয় জবাব দেবেন তোমার বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। দীর্ঘ দুই দশকের বেশী সময় ধরে মাতৃভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম রক্ষার জন্য তিনি যুদ্ধ করেছেন, যুদ্ধের কৌশল শিখিয়েছেন অনেককে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তির মাধ্যমে অধিকার নিয়ে ফিরে এসেছেন বলে একদল সন্ত্রাসী হায়েনার মতো হিংস্র হয়ে রাতের অন্ধকারে তোমার বাবাকে খুন করেছে।

ছেলেটি যখন বড় হয়ে সমাজের কাছে জানতে চাইবে তার বাবার কি অপরাধ ছিল? কী জবাব দেবে সমাজ? প্রসিত খীসা ও সঞ্চয় গংরাই বা কি জবাব দেবে?

সমাপ্ত (৩১/১২/২০০১)

লেখক: সাবেক সভাপতি, পিসিপি, কেন্দ্রীয় কমিটি

More From Author