পলাশ খীসা
৬ জুন ’৯৭ মিটিংএর গঠনতন্ত্র পরিপন্থী সিদ্ধান্ত শাখাসমূহে প্রেরণ করলে বিভিন্ন শাখায় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সর্বপ্রথমে রাঙ্গামাটি জেলা শাখার পক্ষ থেকে প্রতিবাদলিপি কেন্দ্রীয় কমিটির বরাবরে প্রেরণ করা হয়। এর পরপরই ঢাকা মহানগর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মহানগর ও রাজশাহী মহানগর শাখাসহ (সবগুলো জেলা শাখা মর্যাদা সম্পন্ন) বিভিন্ন থানা শাখা থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির গঠনতন্ত্র পরিপন্থী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানানো হয় এবং গঠনতন্ত্র মোতাবেক প্রতিনিধি সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৮ম প্রতিষ্ঠা বার্ষির্কী ও ৭ম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল ঢাকা অথবা চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত করা ও ৪টি মৌলিক দাবী সমুন্নত রাখার আহ্বান জানানো হয়। এরপর কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে থোয়াইঅং, জলি মং, পলাশ, মৃগাঙ্ক, ব্রজ কিশোর ও ডেভিড বমসহ ১২ জন কেন্দ্রীয় নেতা কর্তৃক শাখাসমূহের আবেদন গুরুত্ব সহকারে মূল্যায়ন করার আহ্বান জানানো হয় কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বরাবরে। গঠনতন্ত্রের ১৯ নং ধারার (চ) উপধারা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় কমিটির যে কোনো সিদ্ধান্ত যদি দু’টি জেলা শাখা মর্যাদা সম্পন্ন শাখা লিখিতভাবে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের দ্বিমত অথবা অনাস্থা জ্ঞাপন করলে কেন্দ্রীয় কমিটিকে ২১ দিনের মধ্যে বিশেষ প্রতিনিধি সম্মেলন আহ্বান করে জনমত যাচাই করতে হয় এবং এই মেয়াদের মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটি যেকোনো বৃহত্তর ও গুরুত্বপূর্ণ কার্যকলাপের বৈধতা হারায়। প্রতিনিধি সম্মেলনের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বিপক্ষে মত দিলে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যায়। অথচ ৫টি জেলা শাখা (৭টির মধ্যে)/ জেলা মর্যাদা সম্পন্ন শাখা দাবী জানানোর পরও কোনো বিশেষ প্রতিনিধি সম্মেলন আহ্বান করা হয়নি। উপরন্তু কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে লেখার জন্য রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সভাপতি তনয় দেওয়ান ও সাধারণ সম্পাদক বোধিসত্ব চাকমাকে ৭২ ঘন্টার মধ্যে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেন কেন্দ্রীয় সভাপতি সঞ্চয়। অন্যথায় তাদেরকে বহিষ্কার করা হবে। এখানেও তিনি গঠনতন্ত্রকে উপেক্ষা করেন। গঠনতন্ত্র মোতাবেক কোনো সদস্য অপরাধ করলে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য ১৫ দিন সময় দিতে হয় এবং সংগঠনের যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ দলিলে স্বাক্ষর করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। অথচ রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে সময় দেয়া হয়েছে মাত্র ৩ দিন (৭২ ঘন্টা) এবং সেই গুরুত্বপূর্ণ সার্কুলারে সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষর না করে স্বাক্ষর করেছেন সভাপতি হিসেবে সঞ্চয়। ৫টি জেলা শাখা মর্যাদা সম্পন্ন শাখা এবং কেন্দ্রীয় কমিটির ১২ জন নেতৃবৃন্দের যৌক্তিক দাবীর পরও প্রসিত চত্রের অন্যতম সহযোগী সঞ্চয় গঠনতন্ত্রকে উপেক্ষা করে বীরদর্পে ঘোষণা করে যে, কেন্দ্রীয় কমিটিসহ শাখা সমূহ থেকে কেউ না গেলেও তিনি পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবী নিয়ে খাগড়াছড়িতে ৮ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ও ৭ম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল করবেন, এমনকি বোমা ফাটালে কিংবা তাকে গুলি করে মেরে ফেললেও তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবেন না।
সবকিছুর মূলে রয়েছে প্রসিতের ষড়যন্ত্র ও কুপরামর্শ। পিসিপিসহ তিন সংগঠনকে দুর্বল করার জন্য দীর্ঘদিনের তিল তিল করে যে সংগ্রামী ভাবমূর্তি গড়ে তোলা হয়েছিল তা খন্ডিত করার মধ্য দিয়ে তার ক্ষতিসাধন করা হয়। সমস্ত গণতান্ত্রিক ও গঠনতান্ত্রিক নিয়ম নীতিকে উপেক্ষা করে প্রসিত চক্রের সহযোগী সঞ্চয় সংগঠনের ক্ষুদ্র একটি অংশকে নিয়ে খাগড়াছড়িতে ১৭ জুন ’৯৭ তারিখ ৮ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করলে ১৮ জুন ’৯৭ পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের প্রগতিশীল বৃহৎ অংশটি গঠনতন্ত্রকে সর্বোচ্চ মেনে চলার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্রাবাসে বিশেষ প্রতিনিধি সম্মেলন করতে বাধ্য হয়। সেই প্রতিনিধি সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেদিন বিকাল ৫ ঘটিকার সময় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ৩০ জুন ’৯৭ ৮ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ও ১-২ জুলাই ’৯৭ ৭ম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল করার ঘোষণা দেয়া হয়। সেই সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান মৃগাঙ্ক খীসা এবং সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন তৎকালীন ছাত্র নেতা থোয়াই অং মারমা, জলি মং মারমা, পলাশ খীসা ও মৃগাঙ্ক খীসা প্রমুখ। এভাবে প্রিয় লড়াকু সংগঠন পিসিপি’র গৌরবময় ইতিহাসে প্রসিত চক্ররা কালিমা লেপন করে, সংগঠনের উজ্জ্বল ভাবমূর্তির উপর মারাত্মকভাবে আঘাত হানে।
প্রসিত চক্রের মূল ভিত্তিটা খাগড়াছড়ি কেন্দ্রিক। ফলে ১৭-২০ জুন ’৯৭ অষ্টম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ও ৭ম কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ির একাংশ, দীঘিনালা, মহালছড়ি, খাগড়াছড়ি সদর, রাঙ্গামাটি জেলার নানিয়ারচর ও কুতুকছড়ি শাখা সমূহ থেকে যোগদান করে। অন্যান্য এলাকা থেকেও ছিটেফোটা দু’একজন বিপথগামী কর্মী যোগদান করে। অপরদিকে সংগঠনের মূল নীতি-আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং সংগঠনের গঠনতন্ত্রের অনুসারে অনুষ্ঠিত ৩০ জুন ’৯৭ ৮ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ও ৭ম কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে ঢাকা মহানগর, চট্টগ্রাম মহানগর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী মহানগর, বান্দরবন জেলাধীন সকল শাখা, রাঙ্গামাটি জেলাধীন কুতুকছড়ি ও নানিয়ারচর ব্যতীত সকল শাখা, খাগড়াছড়ি জেলাধীন মাটিরাঙ্গা থানা শাখা, জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক বিপ্লব ত্রিপুরা সহ বিভিন্ন শাখা থেকে সক্রিয়, ত্যাগী ও আদর্শিক কর্মীরা অনেকেই যোগদান করে। তৎসময়ে মানিকছড়ি ও রামগড়ে সংগঠনের শাখা ছিল না। লক্ষীছড়ি ও গুইমারা শাখা ছিল নিষ্ক্রিয়। তারা কোনো পক্ষে যোগদান করেনি।
পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের নামে প্রসিত চক্র পিসিপি’র মূল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর সংগঠনকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য এবং জনমনে যে সকল বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে তা দূরীভূত করার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে গোটা পার্বত্য অঞ্চলে সাংগঠনিক সফর করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি টীম জলি মং মারমা, মৃগাঙ্ক খীসা, ব্রজ কিশোর ত্রিপুরা, মনিন্দ্র চাকমা ও আমি প্রসিতের ঘাঁটি হিসেবে খ্যাত খাগড়াছড়ির বিভিন্ন অঞ্চলে সফর করি। আগষ্ট মাসের শুরুতেই দীঘিনালার বাবুছড়া, বড়াদমসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় মতবিনিময় করি এলাকার মুরুব্বী ও ছাত্র যুবকদের সাথে। মতবিনিময় করার পর বিশেষ করে এলাকার ছাত্র-যুবকদের অনুরোধে এবং মুরুব্বীদের পরামর্শে ৪ আগষ্ট ’৯৭ বড়াদমে পিসিপি, দীঘিনালা থানা শাখার কাউন্সিল করার সিদ্ধান্ত হয়। ৩ আগষ্ট ’৯৭ সবাই বসে একটি খসড়া কমিটিও প্রস্তুত করি। কিন্তু ৪ আগষ্ট সকালে খবর পেলাম প্রসিত চক্র আমাদের মনোনীত সভাপতিসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করেছে, হুমকি দিয়েছে কাউন্সিলে না আসার জন্য এবং তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে কাউন্সিল স্থলে হামলা করার জন্য।
আমাদের অনুষ্ঠান শুরু করার কথা ছিল সকাল ১০টায়। তার আগে তাৎক্ষণিকভাবে আমরা বড়াদমসহ অন্যান্য জায়গার উপস্থিত ছাত্র-যুবক ও অভিভাবকদের সাথে প্রসিত চক্রের কর্মকান্ডের বিষয়ে আলাপ করলাম। বড়াদমের ছাত্র-যুবক বন্ধুরা আমাদের আশ্বস্ত করলো বড়াদমে এসে হামলা করার দুঃসাহস প্রসিত চক্রের নেই। যদি হামলা করে তাহলে একজনকেও সুস্থ শরীরে ফেরৎ দেওয়া হবে না। বড়াদমের সেই সাহসী বৃদ্ধদের যে অপরিসীম সাহস ও বিশ্বাসের প্রতি সম্মান দেখিয়ে কাউন্সিল করার জন্য সমস্ত প্রস্তুতি চলতে থাকলো। আমরা যখন অনুষ্ঠান শুরু করতে যাচ্ছি ঠিক সেই সময়ে ধর্মজ্যোতির নেতৃত্বে প্রসিত চক্র আমাদের কাউন্সিল স্থলে এসে যায় এবং আমাদেরকে কাউন্সিল না করার জন্য চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। ধর্মজ্যোতির বক্তব্য হলো পিসিপি-র থানা কমিটির সভাপতির দায়িত্বে সে রয়েছে। তাকে না জানিয়ে আমরা কাউন্সিল করতে যাচ্ছি কেন? অথচ আমরা যখন বাবুছড়ায় মিটিং করেছি সেই সময়ে ধর্মজ্যোতির সাথে আলাপ হয়েছে। তারপরও তাদেরকে আমি বুঝিয়ে বললাম যে, পিসিপি থেকে একটি ক্ষুদ্র অংশ পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের নাম দিয়ে বের হয়ে গেছে। আমরা মৌলিক দাবীগুলি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। কাজেই এটা স্পষ্ট যে এখন পিসিপি-তে দুটো ধারা সৃষ্টি হয়েছে। তোমরা যদি আমাদেরকে বিশ্বাস করে থাক এবং আমাদের দাবীর সাথে একাত্ম হতে পার তাহলে কাউন্সিলে ঢুকে পড়। আর যদি পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনে বিশ্বাস কর তাহলে কোনো প্রকার ঝামেলা করার চেষ্টা না করে এখান থেকে চলে যাও। আমরা কাউন্সিলের তারিখ নির্ধারণ করেছি, কাউন্সিল অবশ্যই হবে। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রসিত চক্র সেদিন পিছু হতে যায়। আমরা সুশৃঙ্খলভাবে দীঘিনালা থানা শাখার কাউন্সিল সুসম্পন্ন করি।
সেদিনই সন্ধ্যায় আমরা পানছড়ি পৌঁছে যায়। ৫ আগষ্ট’৯৭ পিসিপির পানছড়ি থানা শাখার কর্মী সমাবেশ পূর্ব নির্ধারিত ছিল। পানছড়ি কর্মী সমাবেশ হওয়ার কথা সকাল ১০টায় বাজারের পাশে একটি ক্লাবে। কিন্তু সেদিন ৯টার আগে প্রসিত চক্রের অনিমেষ চাকমার (পরবর্তীতে ভুল বুঝতে পেরে প্রসিত চক্র ত্যাগ করে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে) নেতৃত্বে ৮/১০ জন সন্ত্রাসী ক্লাবে অবস্থান গ্রহণ করে। আমাদের কর্মীরা তাদেরকে সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য বললে তারা অপারগতা প্রকাশ করে এবং বলে যে পলাশ, জলিমং, মৃগাঙ্ক কাউকে ক্লাবে ঢুকতে দেবে না। তখন আমাদের ছাত্র সংখ্যা খুব বেশী ছিল না। পরবর্তীতে আমাদের ব্যাপক কর্মীর সমাগম ঘটলে প্রসিত চক্র সুর পাল্টায়। তখন বলে- তারা আসতে পারবে কিন্তু প্রসিত বিরোধী কোনো বক্তব্য দিতে পারবে না। তখন আমাদের কর্মীরা তাদেরকে উত্তম-মধ্যম দিয়ে বের করে দেওয়ার অনুমতি চায়। আমরা অনেক কিছু ভেবে তা অনুমোদন করিনি। প্রথমতঃ আমরা কারও সাথে সংঘাত হোক সেটা চায় না। তাছাড়া তাদেরকে মারধর করলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি হতে পারে। কারণ সেদিন ছিল বাজারের দিন। প্রসিত চক্র মার খেয়ে যদি বাজারে গিয়ে কোনো বাঙালীকে মারধর করে তাহলে পরিস্থিতি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রূপ নেবে। তাই সবকিছু বিবেচনা করে পূর্ব নির্ধারিত স্থানের পরিবর্তে বৌদ্ধ বিহারের পাশে কর্মী সমাবেশ শুরু করি। এমন সময় খবর এলো, প্রসিত চক্র পেরাছড়াস্থ গিরিফুল শিশু সদন এলাকায় গাড়ী থামিয়ে তল্লাসী চালাচ্ছে আমাদেরকে অপহরণ, হত্যা বা গুম করার জন্য। কাজেই আমরা যেন পানছড়িতে অবস্থান করি। আমাদের কর্মী সমাবেশ যখন শেষ পর্যায়ে তখন খাগড়াছড়ি থেকে একটা চাঁদের গাড়ী (জীপ) নিয়ে আমাদের সমর্থিত ২০/২৫ জন ছাত্র পৌঁছে যায় আমাদেরকে নিয়ে আসার জন্য। আসার পথে গিরিফুল এলাকায় কিরিচ, হকিষ্টিক নিয়ে ১০/১৫ জন প্রসিত চক্রের সন্ত্রাসীকে দেখা যায়। আমাদের ছাত্র সংখ্যা বেশী হওয়ায় তারা হামলা করার সাহস পায়নি।
৪ সেপ্টেম্বর’৯৭ খাগড়াছড়ি জেলার মাইচছড়ির বলিপাড়া বৌদ্ধ বিহারে পিসিপি এক জনসভা আয়োজন করলে চুক্তি বিরোধী সন্ত্রাসী প্রসিত চক্র সমাবেশ শুরুর আগে হামলা চালায়। সেখানে ছাত্রনেতা নয়ন জ্যোতি চাকমাকে মারধর করে মারাত্মকভাবে আহত করে। ইসলামী ছাত্র শিবিরের কায়দায় তার হাত ও পায়ের রগ কেটে দেওয়ার চেষ্টা করলে স্থানীয় ছাত্র জনতা সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করে। ধাওয়া খেয়ে চলে যাওয়ার সময় তৎকালীন পিসিপি’র কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি জলিমং মারমার ব্যবহৃত ব্যাগ ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সমাবেশ ভন্ডুল করে উপস্থিত নেতৃবৃন্দকে আঘাত করা। সে সময় টার্গেট করা নেতৃবৃন্দ না থাকায় তারা নয়ন জ্যোতির উপর হামলা চালায়। তাদের সে দিনের উদ্দেশ্য সফল করতে দেয়নি মাইচছড়ির সচেতন ছাত্র-জনতা।
শুধু তাই নয়, ঘাগড়াতে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের বর্তমান বিভেদের কারণ ও সঠিক পথটি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করার জন্য ঘাগড়ার ইউপি কার্যালয়ে আয়োজিত কর্মী সভায় প্রসিতের পকেটকর্মী ও স্থানীয় সন্ত্রাসী বাবুর্শে মারমার (পরবর্তীতে নিজের ভুল বুঝতে পেরে স্বপক্ষ ত্যাগ করেন) নেতৃত্বে কয়েকজন কর্মী তনয় দেওয়ান ও বোধিসত্ব চাকমার উপস্থিতিতে কর্মী সভা আয়োজনে বাধা প্রদানের চেষ্টা করে। এসময় ঘাগড়ার দোদুল্যমান কর্মীরা বাবুর্শের এহেন আচরণ দেখলে নিজেরাই প্রতিহত করার জন্য এগিয়ে আসে এবং বাবুর্শে মারমাকে তার সাঙ্গপাঙ্গসহ হলরুম থেকে বের করে দেয়। অনুরূপভাবে নান্যাচর থানা সদরে সন্তোষ বিকাশ খীসা, বোধিসত্ব চাকমা ও সুদীর্ঘ চাকমার নেতৃত্বে একদল কর্মী সাংগঠনিক সফরে গেলে নান্যাচর বাজারে প্রসিত চক্রের পকেট কর্মী তপনজ্যোতি ও উথোয়াইচিং মারমা তাদেরকে বাধা প্রদান করেন। পরে সেখানে খুল্যাং পাড়ায় আয়োজিত জনসভায় তারা আবার বাধা প্রদানের চেষ্টা করে। কিন্তু জনগণের তরফ থেকে তখন তাদের বলা হয় যে, এভাবে বাধা না দিয়ে তোমাদের যা বলার আছে তা মিটিংএ এসে বলো। তখন উথোয়াইচিং মারমা জনতার রোষ দেখে সুর পাল্টিয়ে জনসভায় বলে যে, আমরা জনসংহতি সমিতির বিপক্ষে নই। জনসংহতি সমিতি যা বলবে তাই আমরা মেনে নেবো। তখন আমাদের নেতৃবৃন্দ বলেন যে, তাহলে তোমরা কার ইঙ্গিতে বাধা দিচ্ছো? তখন তারা কোনো যুক্তি দেখাতে না পেরে জনসভার স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এভাবে প্রতিটি এলাকায় যেখানে প্রসিত চক্রের লোকজন রয়েছে সেখানে তারা মরণপণ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তাদের দুর্বলতা ছিল যে, তাদের সমর্থিত এলাকায় যদি আমরা প্রসিতের কুকীর্তিগুলো তুলে ধরি তাহলে তারা জনসমর্থন হারাবে। ফলে কোনো অবস্থায়ই তাদের সমর্থিত এলাকায় বিনা বাধায় সমাবেশ বা মত বিনিময় সভা করতে দেয়নি।
২ ডিসেম্বর ’৯৭ প্রসিত চক্রের সমস্ত বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণিত করে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রসিত চক্রের সমস্ত বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণিত হলেও তাদের অন্ধ সমর্থকদের আরো অন্ধ করে রাখার জন্য সেদিনই বিকালে ঢাবি’র সড়ক দ্বীপে একটি মিছিল শেষে সমাবেশের মধ্য দিয়ে প্রসিত চক্র চুক্তির কপি নাম দিয়ে একগাদা কাগজ পুড়িয়ে ফেলে এবং বলে সরকার ও জনসংহতি সমিতির স্বাক্ষরিত চুক্তিতে জুম্ম জনগণের কোনো অধিকার অর্জিত হয়নি। এটা ছিল কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিকতা। কারণ প্রসিত চক্র নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ১০ মার্চ ’৯৭ থেকে বৈঠক প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করে আসছিল। তখন থেকে তারা বিশ্বাস করতো জনসংহতি সমিতি সরকারের সাথে আলোচনার মাধ্যেমে চুক্তি করতে যাচ্ছে ’৯৭ সালের জুন মাসের মধ্যে, যে চুক্তিতে জুম্ম জনগণের অধিকার বা স্বার্থ অর্জিত হবে না। তারা এটাও বিশ্বাস করতো যে, জনসংহতি সমিতির বিরাট একটা অংশ চুক্তির বিরোধিতা করবে, অস্ত্র জমা দেবে না এবং সেই অংশটির সাথে তারা একাত্ম হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাবে। তাদের সেই আশা ও বিশ্বাস মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে জনসংহতি সমিতির সকল সদস্য অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে, জুম্ম জনগণের ন্যুনতম বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে। আমরা যারা পিসিপির মূল ধারায় কাজ করে চলেছি অর্থাৎ সংগঠনের গৌরবোজ্জ্বল ভাবমূর্তিকে সমুন্নত রেখে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার দৃপ্ত শপথ নিয়ে কাজ করে চলেছি চুক্তি হওয়ার সাথে সাথে আমরা চুক্তিকে সমর্থন করিনি। চুক্তির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে এবং পাশাপাশি জেলা পরিষদের আইনগুলো (১৯৮৯) দেখে সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, এই চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে জুম্ম জনগণের ন্যূনতম বেঁেচ থাকার অধিকার থাকবে। আমরা এই চুক্তিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের অগ্রগতির একটি উল্লেখ্যযোগ্য ধাপ হিসেবে চিহ্নিত করে ৬ ডিসেম্বর ’৯৭ খাগড়াছড়িতে ও ১৫ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটিতে চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে মিছিল ও সমাবেশ করি।
জেএসএস সদস্যদের অস্ত্র জমা দেওয়ার আগ পর্যন্ত পত্রপত্রিকার লেখা ও বক্তব্যে প্রসিত চক্রের আক্রমণের টার্গেট ছিলেন জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা ও তিন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। জনসংহতি সমিতির সকল সদস্য অস্ত্র জমা দেয়ায় প্রসিত চক্রের নেতৃত্ব কর্মীদের ক্ষোভের মধ্যে পড়েন। কেননা প্রসিত চক্র বলেছিল জনসংহতি সমিতির একটা বিরাট অংশ অস্ত্র জমা দেবে না। অথচ তারা সবাই অস্ত্র জমা দিলেন কেন- কর্মীদের এই প্রশ্নের মুখোমুখী হতে হলো। সেদিন প্রসিত চক্র কর্মীদের এই বলে সান্তনা দেয় যে, কিছু দিনের মধ্যে আমাদের অটোমেটিক হাতিয়ার আসবে। কাজেই চিন্তার কোনো কারণ নেই। কিন্তু পরে অটোমেটিক হাতিয়ার দেখতে না পেয়ে কর্মীরা আরো ক্ষুব্ধ হয়। ফলে প্রসিত চক্র ছলনার আশ্রয় নেয়। বিশ্বস্ত কর্মীদের দিয়ে নকল অটোমেটিক হাতিয়ার সাধারণ কর্মীদের দেখায়। প্রসিত চক্রের এ ধরনের ভন্ডামী দেখে অনেকেই স্বপক্ষ ত্যাগ করে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে। অবশ্যই জনসংহতি সমিতির একটা অংশকে নিজেদের পক্ষে রাখার কম চেষ্টা করেনি তারা। চুক্তির পর পরই তাদের এক পকেট সাংবাদিককে দিয়ে আজকের কাগজে একটি রিপোর্ট লিখে দেয় যে, মেজর বাতায়ন তার গ্রুপ নিয়ে বিদ্রোহ করেছে। সে অস্ত্র জমা দিতে চায় না। কিন্তু সন্তু লারমার অনুগত বাহিনী তাকে নিরস্ত্র ও গ্রেপ্তার করেছে। এভাবে তারা পার্টির অভ্যন্তরে ভাঙ্গন সৃষ্টি করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে যায়। ফলে প্রসিত চক্রের টার্গেট হয়ে যায় পুরো পার্টি, অস্ত্র জমাদানকারী সকল সদস্য ও তিন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
চুক্তির পর পরই প্রসিত চক্র হত্যার রাজনীতি শুরু করে। সর্ব প্রথমে তারা খুন করে কুতুকছড়ির অশ্বিনী কুমার চাকমাকে। অশ্বিনী কুমার চাকমা ছিলেন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মরত কুমার চাকমার ছোট ভাই। মরত কুমার ছিলেন চুক্তির একজন সমর্থক। তার দু’ছেলেও চুক্তি পক্ষের পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাথে যুক্ত ছিল। ১৬ জানুয়ারি ’৯৮ চুক্তির সমর্থনে কুতুকছড়ি বাজারে একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। প্রসিত চক্রের বাধা সত্ত্বেও অনেক লোক জমায়েত হয় সেখানে। সেই সমাবেশ আয়োজনের ক্ষেত্রে মরত কুমারের ভূমিকা ছিল নজরে পড়ার মতো। অশ্বিনী কুমারও সেই সমাবেশে যোগ দেন। দু’দিন পর ১৮ জানুয়ারি ’৯৮ প্রসিত চক্রের সন্ত্রাসীরা মরত কুমারকে মারার জন্য যায়। তাকে না পেয়ে তার ছোট ভাই অশ্বিনী কুমার চাকমার উপর আক্রমণ চালায়। কিছু সময় মার খাওয়ার পর অশ্বিনী কুমার আত্মরক্ষার জন্য কোদাল হাতে নিলে প্রসিত চক্রের সন্ত্রাসীরা চারদিকে ঘিরে পাথর ছুড়ে মারতে থাকে। অশ্বিনী বাঁচার জন্য আর্মী ক্যাম্পের দিকে যেতে চেষ্টা করেন। কিন্তু এতগুলো সন্ত্রাসীর সাথে একজনের পক্ষে মোকাবেলা করা সম্ভব হয়নি। একটার পর একটা পাথর দিয়ে বার বার আঘাত করতে থাকে সন্ত্রাসীরা। ফলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু ঘটে। এভাবেই চুক্তি বিরোধীদের হাতে প্রথম জীবন দিলেন অশ্বিনী কুমার চাকমা। রেখে গেলেন ছেলেমেয়েসহ অসহায়ভাবে নিজের স্ত্রীকে। অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে কেটে যেতে থাকে অশ্বিনীর বিধবা স্ত্রীর দিনকাল। কিছুদিন আগে প্রসিত চক্রের তথাকথিত এক নেতা তার প্রতি দরদ দেখিয়ে মদ বিক্রির অনুমতি দেয়। মদ বিক্রি করে কোনোমতে চলছে বিধবার অভাবী সংসার।
অশ্বিনীর মৃত্যুর পর দাহক্রিয়ায় যাওয়ার জন্য যখন আমাদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের মিটিং চলছিল তখনই ছাত্রনেতা বোধিসত্ব চাকমা সরেজমিনে ঘুরে এসে রিপোর্ট দেয় যে, প্রসিত চক্র রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছে। তারা চুক্তির যে কোনো সমর্থককে খুন করতে পারে। যদি অশ্বিনীর দাহক্রিয়ায় যাওয়া হয় তাহলে অবশ্যই আমাদের আঘাত করবে তারা। স্থল বা নৌ পথ কোনোটাই নিরাপদ নয়। তারপরও আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম উপস্থিত সকল কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ দাহক্রিয়ায় যাবো। একটা বাস ও একটা মাইক্রো নিয়ে ৬০/৭০ জনের একটা দল তৎকালীন সভাপতি থোয়াই অং মারমার নেতৃত্বে দাহ অনুষ্ঠানে যায়। যাবার পথে প্রসিত চক্রের অন্যতম সহযোগী অভিলাষসহ ৪/৫ জনকে দেখতে পেয়ে আমাদের কর্মীরা উত্তেজিত হয়ে তাদেরকে গাড়ীতে তুলে নিয়ে আসার প্রস্তাব করে। আমরা গাড়ী না থামিয়ে কর্মীদের বলি আমরা অশ্বিনীর দাহক্রিয়ায় যাচ্ছি। তাই প্রধান হচ্ছে দাহক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা, কাউকে ধরে নিয়ে যাওয়া নয়। আমরা অশ্বিনীর বাড়ীতে পৌঁছলে শত শত জনতা আমাদের স্বাগত জানান। তাদের চোখেমুখে ছিল শোকের ছায়া আর আতংকের প্রতিচ্ছবি। আমরা তাদের সাথে মত বিনিময় করি। তারা আমাদের জানান যে, তারা খুবই অসহায়, সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি। ফলে তারা চান না অশ্বিনীকে রাজনৈতিক মর্যাদায় দাহ করা হোক। এরমধ্যে আমরা খবর পেলাম সন্ত্রাসীরা আমাদেরকে হামলা করার জন্য অপেক্ষা করছে। দাহক্রিয়া ঘন্টা দুয়েক দেরী হতে পারে জেনে আমরা সেখান হতে শ্রদ্ধা জানিয়ে চলে এলাম।
বাজারে হামলা করার কথা শোনা গেলেও কেউ কিছু করেনি। আমরা আসতে থাকলাম। কিছুদূর এসে দেখা গেল অভিলাষসহ কয়েকজন রাস্তার কিছু দূরে দাঁড়িয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে গালিগালাজ করছে। আমাদের কর্মীরা তাদেরকে ধাওয়া করতে চাইলেও আমরা দিইনি। কিছু দূর এসে দেখি আবাসিক স্কুলের কাছে ধর্মঘরের পাশে সন্ত্রাসীরা ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে এবং তিন দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হামলার জন্য অবস্থান করছে। তখন আর কোনো উপায় না দেখে আমাদের কর্মীদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। মুহূর্তের মধ্যে সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করে ব্যারিকেড ভেঙ্গে ফেলে আমাদের কর্মীরা। সেদিন দেখেছি প্রসিত চক্রের সন্ত্রাসীদের ভীরুতা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল আমাদের উপর হামলা করা। কিন্তু আমাদের কর্মীরা গাড়ী থেকে হুংকার দিয়ে নামার সাথে সাথে তারা পালিয়ে যায়। আমরাও নিরাপদে চলে আসি।
(চলবে..)
লেখক: সাবেক সভাপতি, পিসিপি, কেন্দ্রীয় কমিটি
+ There are no comments
Add yours