পলাশ খীসা
১০ নভেম্বর ’৮৩ জুম্ম জাতীয় ইতিহাসে একটি কলংকজনক দিন। এই দিনে বিভেদপন্থী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের হাতে আটজন সহযোগীসহ নির্মমভাবে শহীদ হন আমাদের জুম্ম জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মহান নেতা এম এন লারমা। ঠিক তেমনিভাবে ১০ মার্চ ’৯৭ জুম্ম জাতীয় ইতিহাসে রচিত হয় আরও একটি কালো অধ্যায়। ১০ নভেম্বর ’৮৩ মহান নেতা এম এন লারমাকে খুন করেছে বিভেদপন্থী চক্ররা। অনুরূপভাবে ১০ মার্চ ’৯৭ পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের ডাক দেয়ার মধ্য দিয়ে প্রসিত-সঞ্চয় চক্র জনসংহতি সমিতি ও জুম্ম জনগণের যোগ্য নেতৃত্বকে ধ্বংস করতে অব্যাহতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ১০ মার্চ ’৯৭ পিসিপি-পিজিপি-এইচডব্লিউএফ এর নাম ব্যবহার করা হয় এবং সেদিন একটি মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি’র সড়ক দ্বীপ থেকে শুরু হয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে বিলি করা হয় লিফলেটগুলো। সেই মিছিলে আমরা অনেকেই ছিলাম। সেই মিছিল থেকে এ ধরনের জুম্ম জাতীয় ঐক্য পরিপন্থী লিফলেট প্রচার করা হবে সেটা অনেকেই জানতাম না। অত্যন্ত সুকৌশলে প্রসিত চক্র এ কাজটি করেছে। এরপর এই লিফলেটটা নিয়ে প্রচন্ড সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয় প্রসিত চক্রকে। শুধু তাই নয় লিফলেটটি রাঙামাটি পাঠানো হলে তৎকালীন রাঙামাটি জেলার সভাপতি তনয় দেওয়ান তা বিলি না করে রেখে দেন। পরে লিফলেটের বিষয়টা নিয়ে ১৯ মার্চ ’৯৭ কেন্দ্রীয় কমিটির এক জরুরী সভা জগন্নাথ হল উপসনালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। সভার শুরুতে সঞ্চয় চাকমা বলেন, “তিন সংগঠনের নামে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের ডাক অত্যন্ত যুগোপযোগী। কারণ আগামী কিছু দিনের মধ্যে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে – যে চুক্তিতে জুম্ম জনগণের অধিকার রক্ষিত হবে না।” তিনি আরো বলেন, “তিন সংগঠনে আমাদের মধ্যকার যে মত পার্থক্য অতীতে সৃষ্টি হয়েছে সেটার জন্য আমরা কেউ দায়ী নয়। এর জন্যে একমাত্র জনসংহতি সমিতিই দায়ী। আমরা আগেও সুখে দুঃখে একসাথে কাজ করেছি, ভবিষ্যতেও করতে চাই। তাই অতীতের সমস্ত মতভেদ ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন আদায়ের সংগ্রামকে আমাদের জোরদার করতে হবে।” সেদিন সঞ্চয়কে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম- ‘আপনি পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কোন আন্দোলনটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন, সশস্ত্র না গণতান্ত্রিক?’
তিনি উত্তরে বলেছিলেন, অবশ্যই সশস্ত্র। আমি আরো বলেছি যে, আপনি বলেছিলেন জনসংহতি সমিতি চুক্তি করবে, যেখানে জুম্ম জনগণের কিছুই থাকবে না। বর্তমানে আপনি কিভাবে আন্দোলন করতে চান?
তিনি বললেন, মনে করুন, আমরা যেখানে রয়েছি তার সামনে বিশাল একটি লেইক। লেইকের ওপাড়ে আমাদের অধিকারগুলো রয়েছে। আমাদের অবশ্যই সেখানে যেতে হবে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য।
আমি আরো প্রশ্ন করলাম, আপনি তো বলেছেন সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। অধিকারগুলো রয়েছে লেইকের ওপাড়ে। যেতে হলে লঞ্চে বা ইঞ্জিন চালিত নৌকায় যেতে হবে। বর্তমানে জনসংহতি সমিতিকে যদি আমরা লঞ্চ ধরি অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, তাহলে আমাদের সশস্ত্র আন্দোলনে বা জনসংহতি সমিতিতে কি যাওয়া প্রয়োজন ছিল না?
প্রত্যুত্তরে সঞ্চয় জবাব দিলেন, জনসংহতি সমিতি নামে যে লঞ্চটির কথা আপনি বললেন সেটি মোটেই চলছে না। এখনো ঘাটেই রয়েছে। সেখানে গেলেও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।
আমি আরো বললাম, লঞ্চটা যখন চলছে না তাহলে লঞ্চের কোনো না কোনো ত্রুটি রয়েছে। হয় ফুয়েল নেই; নয়তো মেশিনের কোনো যন্ত্রাংশ খারাপ হয়ে আছে। আমাদের কি উচিৎ নয় ত্রুটি কোথায় সেটা খুঁজে বের করে সেই লঞ্চ নিয়ে অধিকার নিয়ে আসা?
জবাবে তিনি বললেন, লঞ্চের বর্তমানে যিনি মালিক আছেন, তিনি এমনভাবে রয়েছেন মেশিনটা ধরতে, দেখতে বা চালাতে দিচ্ছেন না। কাজেই আমরা যদি সেই লঞ্চে উঠি তাহলে বেশী মানুষের ভারে লঞ্চটা ঘাটে ডুববে, কোনোদিনও লেইকের ঐ পাড়ে গিয়ে অধিকার নিয়ে ফিরে আসতে পারবে না।
তাহলে আমাদের কি করা উচিৎ? আমি আবার প্রশ্ন করলাম।
আমাদের আবারো নতুন করে গাছ লাগিয়ে বড় করে কাঠ চিড়ে লঞ্চ বানাতে হবে। সেখানে ভালো মেশিন এবং ভালো চালক দিয়ে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেই কাজে আমাদের সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা থাকা প্রয়োজন বলে তিনি উত্তর দিলেন।
সেদিনের সেই মিটিং-এ সঞ্চয় স্পষ্টভাবে কিছু না বললেও প্রদীপন খীসা আরো কিছুটা স্পষ্ট ভাষায় বলেছিল জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা তিনি আর আন্দোলন করতে চান না, চুক্তি করতে চান। কিছু না পেলেও তিনি চুক্তি করবেন। অপর পক্ষে জনসংহতি সমিতির একটা বড় অংশ অশোক বাবুর নেতৃত্বে এখনো আন্দোলন করতে চান। সেই দিনের সেই মিটিংএ সিদ্ধান্ত হয় যে, ২১-২২ এপ্রিল কেন্দ্রীয় বিশেষ প্রতিনিধি সম্মেলন চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হবে। সেই মিটিং-এ বিস্তারিত আলোচনা করে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবী বিষয়ে মীমাংসা করা হবে। যেহেতু পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের ডাক পিসিপি কেন্দ্রীয় কমিটির নয়, ব্যক্তিগতভাবে সঞ্চয় সেই দাবীর সাথে সংশ্লিষ্ট।
২০-২১ এপ্রিল ’৯৭ চট্টগ্রাম বুড্ডিষ্ট ফাউন্ডেশন মিলনায়নে কেন্দ্রীয় বিশেষ প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে ১০ মার্চ ’৯৭ সালে তিন সংগঠনের নামে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবী সম্বলিত লিফলেটের ব্যাপারে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা ও সমালেচনা করা হয়। বিভিন্ন শাখার প্রতিনিধিরা সক্রিয়ভাবে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। কতিপয় কর্মী এই দাবীটা যুগোপযোগী বলে আখ্যায়িত করলেও বেশীর ভাগ প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় কমিটিকে তীব্র সমালোচনা করেন। এমন যুক্তি উপস্থাপন করেন যে, সেখানে কেন্দ্রীয় কমিটির কিছুই বলার থাকে না। প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে বলা হয়, পিসিপি তার জন্মলগ্ন থেকে বলে আসছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি রাজনৈতিক সমস্যা। এই সমস্যাটাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করার জন্য সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে জনসংহতি সমিতির যখন আলোচনা কিছুটা অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে বলে আমরা পত্রিকায় খবর দেখছি তখন পিসিপির পক্ষ থেকে এ ধরনের লিফলেট ছাপানোর মধ্য দিয়ে সমাধানের প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। তাছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটি একতরফাভাবে এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত (পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন দাবী সম্বলিত লিফলেট ছাপানো ও বিতরণ করা) নিতে পারে না। প্রতিনিধিদের সমালোচনা-পর্যালোচনামূলক বক্তব্যের পর কেন্দ্রীয় কমিটির একটি মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সঞ্চয় প্রস্তাব করেন কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে কেবলমাত্র দু’একজন বক্তব্য রাখবেন। তখন কেন্দ্রীয় কমিটির অনেকেই তার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, “যে বিষয়টা নিয়ে আজ প্রতিনিধিরা কেন্দ্রীয় কমিটিকে সমালোচনা করছে তার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি দায়ী নয়। কারণ কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লিফলেট ছাপানো হয়নি। কাজেই প্রত্যেকের বলার রয়েছে।” ফলে সিদ্ধান্ত হয় যে, সবাই নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করবেন বিষয়টা নিয়ে। কেন্দ্রীয় কমিটির অনেকেই পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবী সম্বলিত লিফলেটের জন্য সঞ্চয়কে দায়ী করেন। সভার সমাপ্তি বক্তব্যে সঞ্চয় তার অপরাধ স্বীকার করে বলেন যে, “পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের ডাক আমি কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে দিয়েছি। এজন্য যদি শাস্তি ভোগ করতে হয় আমি করবো, যদি সংগঠন থেকে আমাকে বহিষ্কার করা হয় তাতেও আমার আপত্তি নেই। তবে আপনারা জেনে রাখুন, আগামী জুন মাসের মধ্যে জনসংহতি সমিতি সরকারের সাথে চুক্তি করবে- যে চুক্তিতে জুম্ম জনগণের কোনো অধিকার সংরক্ষিত হবে না। কারণ জনসংহতি সমিতির বর্তমান নেতৃত্ব অচল, ঘরের নষ্ট হওয়া খুঁটির মতো নড়েবড়ে, যে কোন মুহূর্তে ভেঙ্গে পড়তে পারে। তারা আর আন্দোলন করতে চায় না। তাই কোনো কিছু না পেলেও জনসংহতি সমিতি চুক্তি করতে বাধ্য সরকারের সাথে।”
সেই প্রতিনিধি সম্মেলনে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবী বাতিল করা হলো। তবে কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধি মনে করেন পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবীটা যৌক্তিক তাহলে কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে সেটা চূড়ান্ত হবে। আরো সিদ্ধান্ত হয় যে, পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের পরিবর্তে ৪টি মৌলিক দাবী নিয়ে পিসিপি’র ৮ম প্রতিষ্ঠা বার্ষির্কী ও ৭ম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। দাবীগুলো হলো –
১. সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ স্বায়ত্বশাসন দিতে হবে।
২. ভূমি অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
৩. সেনাবাহিনী ও সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করতে হবে।
৪. বহিরাগত বাঙালীদের ফেরত নিতে হবে।
এই ৪টি দাবীতে ৮ম প্রতিষ্ঠা বার্ষির্কী ও ৭ম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল ১৭-২০ জুন ’৯৭ তারিখে ঢাকা অথবা চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হবে।
১১ মে ’৯৭ খাগড়াছড়িতে নির্মাণাধীন ষ্টেডিয়ামে রাজশাহী মহানগর শাখার সাবেক সভাপতি ও সাবেক কেন্দ্রীয় সহ সাধারণ সম্পাদক উষাময় খীসাকে (বর্তমানে আইনজীবী) প্রসিত চক্রের সন্ত্রাসীরা দীপ্তিশংকরের নির্দেশে মারধর করে। সেদিন উষাময় ও অমিয় চাকমা (বিশিষ্ট ফটোগ্রাফার) নির্মাণাধীন ষ্টেডিয়ামে ছোট বোন স্বর্ণাশ্রী ও রূপাশ্রী (তটিনী ও এল্টনি)সহ বেড়াতে গিয়েছিল। বিকাল বেলায় ষ্টেডিয়ামের গ্যালারীতে বসে তারা যখন গল্প করছিল ঠিক সেই সময়ে একজন ছেলে এসে জিজ্ঞাসা করে- উষাময় কার নাম? উষাময় তখন নিজের পরিচয় দেয়। ছেলেটি বলে “আপনার সাথে কথা আছে। একটু আমার সাথে যেতে হবে।” উষাময় বিষয়টা সহজভাবে নিয়ে ছেলেটার সাথে যায়। ছেলেটা তাকে নিয়ে যায় ষ্টেডিয়ামের ভেতরের একটি রুমে। সেখানে গিয়ে দেখে অনেকগুলো ছেলে। তখন কোনো কথা না বলে দরজা বন্ধ করে উষাময়কে মারতে শুরু করে সন্ত্রাসীরা। যে যেভাবে পারে মারছে আর উষাময় চিৎকার করছে। কিন্তু শব্দটা অমিয়দের কাছে পৌঁছে না। তারা অপেক্ষা করছে উষাময় কখন আসবে। প্রায় ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করেও যখন আসছে না তখন তারা খুঁজতে যায়। খুঁজতে খুঁজতে চিৎকার শুনতে পায়। দরজা খুলে দেখে উষাময়কে ১৫/২০ জন ছেলে মারছে। দরজা খোলার সাথে সাথে অমিয়কে দু’চারজন এসে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় এবং চলে যেতে বলে। তখন অমিয়রা হুয়াং বোইও বা-তে যায়। সেটি পিসিপি’র অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সেখানে দীপ্তিশংকর ছিল। তাকে ঘটনাটা বিস্তারিত বলা হয়। কিন্তু সে জবাব দেয় অপরাধ করলে তো মার খেতে হবে। তাদের করার কিছু নেই। তখন স্বনির্ভর বাজারে আসা লোকদের কাছে উষাময়কে বাঁচানোর জন্য আহ্বান করে অমিয়রা। বাজারে আসা লোকজন উদ্ধারের জন্য গেলে সন্ত্রাসীরা চলে যায় এবং উষাময়কে মুমুর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর সে আপাততঃ ভালো হয়ে যায়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সেই সময়ের আঘাতের ব্যাথাগুলো জ্বালাতন করে। শুধু তাই নয় আমাদের পক্ষ থেকে খাগড়াছড়িতে দায়িত্ব পালনরত তনয় দেওয়ান ঊষাময় খীসাকে দেখাশুনা ও চিকিৎসা করার পর রাঙামাটি ফিরে আসার সময়ে ১৫ মে তারিখে তাকে খাগড়াছড়ি বাস ষ্টেশন থেকে প্রসিত চক্রের সন্ত্রাসীরা অপহরণের চেষ্টা চালায়।
৬ জুন ’৯৭ চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্রাবাসে কেন্দ্রীয় কমিটির একটি বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মৃগাঙ্ক খীসা যখন বক্তব্য রাখছিলেন তখন তার বক্তব্যের উপর কথা বলতে থাকে চম্পানন, নিকোলাস, মিন্টুসহ আরো দু’একজন। মৃগাঙ্ক বক্তব্য রাখতে পারছেন না, কারণ প্রতিটি কথায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। তখন আমি সভাপতির অনুমতি নিয়ে প্রশ্ন করলাম- “এখানে কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং হবে নাকি মাছের বাজারের মতো তর্ক-বিতর্ক হবে? মাছের বাজারের মতো হলে আমিও শুরু করতে পারি কি-না? যদি না হয় তাহলে মৃগাঙ্ক বাবুকে তার বক্তব্য উপস্থাপন করার সুযোগ দেয়া হোক।” তখন সভাপতি হিসেবে সঞ্চয় হস্তক্ষেপ করে বলেন- একজনের বক্তব্য শেষ না হলে আরেকজন কথা বলতে পারবে না। তখনই মৃগাঙ্ক বাবু বক্তব্য রাখার সুযোগ পান। তার বক্তব্যকে সমালোচনা করে প্রসিত চক্রের দু’একজন বলেছিল তিনি নাকি জনসংহতি সমিতির সদস্যের মতো বক্তব্য রাখছেন এবং তাদের দালালী করছেন। সেই মিটিংএ প্রসিত চক্রের দীপ্তি শংকর বাদে সবাই উপস্থিত ছিল। দীপ্তি শংকরও লিখিতভাবে কাগজ পাঠিয়েছে যে, সে আসতে পারবে না, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত মেনে নেবে। সেদিনের মিটিংএর উদ্দেশ্য ছিল কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলনের সিদ্ধাকেন্ত পরিবর্তন করা। সে কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য প্রসিত চক্র সবাই মিটিংএ উপস্থিত হয়। সেই মিটিংএ প্রস্তাব করা হয় যে, প্রতিনিধি সম্মেলনের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ৮ম প্রতিষ্ঠা বার্ষির্কী ও ৭ম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল ঢাকা ও চট্টগ্রামের পরিবর্তে খাগড়াছড়িতে অনুষ্ঠিত করা এবং যে ৪টি মৌলিক দাবী নিয়ে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ও কাউন্সিল করার সিদ্ধান্ত ছিল তা পরিবর্তন করে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবী অন্তর্ভুক্ত করা। কোনো প্রকার যুক্তি দেয়ার সুযোগ সেখানে দেয়া হয়নি। প্রস্তাবের পক্ষে না বিপক্ষে শুধুমাত্র এই মতামত চাওয়া হয়। যেহেতু প্রসিত চক্রের সবাই উপস্থিত কাজেই সংখ্যাগরিষ্ঠের মত হিসেবে সেটা চাপিয়ে দেয়া হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রতিনিধি সম্মেলনের সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় কমিটির পরিবর্তন করার ক্ষমতা নেই। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সংগঠনের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী সংস্থা হচ্ছে কেন্দ্রীয় কাউন্সিল, এরপরে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলন, তারপর কেন্দ্রীয় কমিটি। কেন্দ্রীয় কমিটির যে কোনো সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলন বা কেন্দ্রীয় কাউন্সিল বাতিল করে দিতে পারে, কিন্তু কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলনের সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয কমিটি বাতিল করে দিতে পারে না।
শুধু তাই নয় সঞ্চয় চাকমা উদ্ধত কন্ঠে বলেন যে, আমি পার্টির (জেএসএস) সবকিছু দেখেছি। কোথাও কিছু নেই। তাদের পক্ষে আর আন্দোলন করা সম্ভব নয়। মূলতঃ প্রতিনিধি সম্মেলনের সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে প্রসিতের নির্দেশ মোতাবেক কাজ করার জন্য সঞ্চয় এসব বক্তব্য দিয়েছিল।
(চলবে..)
লেখক: সাবেক সভাপতি, পিসিপি, কেন্দ্রীয় কমিটি