হিল ভয়েস, ১০ নভেম্বর ২০২৪, আন্তর্জাতিক ডেস্ক: গত ০৪ নভেম্বর থেকে হাঙ্গেরির রাজধানী বুডাপেস্ট এ অবস্থিত ইউরোপীয়ান ইয়ুথ সেন্টারে শুরু হয়েছে আনরিপ্রেজেন্টেড ন্যাশনস্ এন্ড পিপলস্ অর্গানাইজেশন এর ইয়্যুথ প্লাটফর্মের সপ্তাহ ব্যাপী স্টাডি সেশন। মূলত ঐতিহাসিকভাবে নিপীড়িত এবং নির্যাতিত যে জাতিসমূহ পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে অবস্থান করছে এবং নানাভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের পীড়নের শিকার হয়ে মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে এসেছে এবং আত্মনিয়ন্ত্রাধীকারের জন্য লড়ছে সেসব জাতিসমূহের সম্মিলিত প্লাটফর্মই হল আনরিপ্রেজেন্টেড ন্যাশনস্ এন্ড পিপলস্ অর্গানাইজেশন (UNPO)। প্রতিবছর ইউএনপিও ইয়্যুথ এর আয়োজনে এই স্টাডি সেশনের আযোজন করা হয়। এবারের স্টাডি সেশনে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ ১৫ টি জাতিগোষ্ঠীর তরুণরা অংশ নিয়েছেন। উক্ত সেশনে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের তথা নিপীড়িত জাতিসমূহের নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজন করা হয় স্মরণ অনুষ্ঠান।
উক্ত স্মরণ আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন ব্রিটেনের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওগ্রাফির শিক্ষক ড. লিয়াম সাদ্দিংটন, ইউএনপিও ইয়্যুথ কো-অর্ডিনেটর পুথিয়ান কিম, কোর্স পরিচালক আরন জোনস, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি ও ইয়্যুথ কো-অর্ডিনেটর নিভিয়াস ক্যানসেলা, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধি সতেজ চাকমাসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর তরুণ প্রতিনিধিরা।
স্মরণ আয়োজনের শুরুতে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরেন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধি সতেজ চাকমা। পরে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার গুরুত্বপূর্ণ উক্তিগুলো নিয়ে করা একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিও প্রদর্শন করা হয়। উক্ত প্রদর্শনীর সময় প্রতিনিধিরা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ছবি হাতে দাঁড়িয়ে নিপীড়িত জাতিসমূহের এই নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নিরবতা পালন করেন।
উক্ত স্মরণ অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধি সতেজ চাকমা বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সদ্য স্বাধীন দেশটির সংবিধান রচনার সময় আদিবাসী জাতিসমূহের আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি চেয়েছিলেন। কেবল আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী নয়, তিনি নারীদের সমঅধিকারের কথা বলেছিলেন গণপরিষদ বিতর্কের সময়। একইসাথে সমাজে যারা নানাভাবে প্রান্তিকতার শিকার তাদের মধ্যে মেথর, পতিতা, বেদে, কৃষক, শ্রমিকসহ সকল নিপীড়িত জনগণের কথা সংসদে তুলে ধরেছেন। কাজেই তিনি হলেন প্রতিনিধিত্বহীন জনগণের এবং নিপীড়িন মানুষের প্রতিনিধি। তাঁর মত ব্যক্তিত্বকে স্মরণের মাধ্যমে আমরা তাঁদের চিন্তা থেকে প্রেরণা নিয়ে আমাদের সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে পারি। দেশী বিদেশী চক্রান্তের শিকার হয়ে ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বরে এই নেতাকে তাঁর আট সহযোদ্ধাসহ হত্যা করা হয়।
চলমান স্টাডি সেশনে ইউএনপিওর জেনারেল সেক্রেটারি মারসে মনজে ক্যানো বলেন, আপনারা অনেকেই জানেন ইতিমধ্যে আমেরিকার নির্বাচনের ফলাফল জানা হয়ে গেছে। এই ফলাফল আমাদেরকে নতুনভাবে ভাবাচ্ছে। পৃথিবীর নানাপ্রান্তে যে নিপীড়িত ও প্রতিনিধিত্বহীন জাতিসমূহ বাসবাস করছি তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন কীভাবে প্রভাবিত হবে- সেটা এখন ভাবনার বিষয়। আমাদের কৌশলগত পরিবর্তন যেমন জরুরী তেমনি আমাদের টিকে থাকার সংগ্রামে কেবল আমাদের নিজেদের জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, ইউএনপিও’র মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, আমাদের কথাগুলো, চিন্তাগুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে পৌঁছে দিতে হবে। এক্ষেত্রে তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি, উদ্যোগ এবং নবতর প্রজ্ঞা নিয়ে হাজির হতে হবে। গ্লোবাল মুভমেন্টের মধ্যে আমাদেরকে ছড়িয়ে পড়তে হবে।আমরা এমন রাষ্ট্রে বসবাস করি যেখানে আমরা প্রতিনিধত্বহীন। আমি জানি না এসবের সমাধান কী। তবে প্রাথমিকভাবে একত্রে কাজ করা একটি সমাধান হতে পারে এবং পারষ্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে আমাদের আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হবে। নতুন কৌশল এবং নতুন মিত্র গড়ে তুলতে হবে।
উল্লেখ্য যে, ১৯৮০’র দশকে এসকল জাতিসমূহের যেসব প্রতিনিধি বিশ্বের নানাপ্রান্তে নির্বাসনে অবস্থান করছেন তাঁরা নানাভাবে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ তৈরী হয়। পরে নিপীড়িত জাতিসমূহের এই প্রতিনিধিদের সম্মিলিত প্র্রয়াসে ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ন্যাদারল্যান্ডের হেগ শহরে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয় এই সংস্থাটি। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে যারা সদস্য ছিলেন তারা হলেন-অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীরা, আর্মেনিয়া, ক্রিমিয়ান তাতারস, কর্ডেলিয়ারা, পূর্ব তুর্কস্তান, এস্তোনিয়া, জর্জিয়া, গ্রিকের আলেবেনিয়ান মাইনোরিটি, কুর্দিস্তান, লাতভিয়া, পালাউ, তিব্বত, তাইওয়ান, তাতারস্থান, পশ্চিম পাপুয়া। পরে কয়েক মাসের মধ্যেই যুক্ত হয় আবকাজিয়া, আচে, এশিরিয়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম, দক্ষিণ মলুক্কাস, বউগেইভিল্লে, কসোভো, জানজিবার, মাউরি, ইরাকের তুর্কিমান পিপলরা। বর্তমানে এই সংস্থাটির সদস্য সংখ্যা ৩৮। উক্ত সদস্যদের মধ্যে এবারের সপ্তাহব্যাপী সেশনে ১৫ টি জাতিগোষ্ঠী অংশ নেয়।