হিল ভয়েস, ৯ নভেম্বর ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক: আগামীকাল (১০ নভেম্বর ২০২৪) মহান বিপ্লবী নেতা, সাবেক সংসদ সদস্য, জুম্ম জাতির জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (এম এন লারমা) ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জুম্ম জাতীয় শোক দিবস। পাহাড়ি-বাঙালি নাগরিক সমাজের অনেকের কাছে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা, গণমানুষের প্রিয় নেতা, শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষের বন্ধু এবং দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নেতা।
এম এন লারমার স্মরণে এবং দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন উপলক্ষে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম সহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে জানা গেছে।
এই দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন উপলক্ষে বিগত বারের ন্যায় এবারও ঢাকায় শামসুল হুদাকে আহ্বায়ক ও হিরণ মিত্র চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক করে ‘মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটি’ গঠন করা হয়। উক্ত কমিটি এই দিন (১০ নভেম্বর) রবিবার, বিকাল ৩টায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ এর বকুলতলায় এক অনুষ্ঠানমালা আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠানমালার প্রথম পর্বে রয়েছে শ্রদ্ধা নিবেদন, সূচনা সঙ্গীত ও স্মরণ সভা এবং দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রতিবাদী গান ও প্রদীপ প্রজ্বালন।
দিবসটি উপলক্ষে ‘মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ৪১তম প্রয়াণ দিবস পালন কমিটি-চট্টগ্রাম’ এর উদ্যোগে এইদিন বিকাল ৩টায় চট্টগ্রামের থিয়েটার ইনস্টিটিউট হল-এ ‘জুম্ম জাতীয় চেতনার অগ্রদূত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: প্রাসঙ্গিক ভাবনা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক রঞ্জিত কুমার দে, কবি ও সাংবাদিক হাফিজ রশিদ খান, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা তাপস হোড়, ঐক্য ন্যাপ, চট্টগ্রাম এর নেতা অজিত দাস, যুব ঐক্য পরিষদ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা এর নেতা অ্যাড. সুমন সরকার ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এর প্রতিনিধি জুনিয়া ত্রিপুরা। আলোচনা সভার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রঁদেভূ শিল্পী গোষ্ঠীর শিল্পীদের কর্তৃক শোক সঙ্গীত পরিবেশন করা হবে এবং সন্ধ্যা ৬টায় মোমবাতি প্রজ্বালন।
একইদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির উদ্যোগে রাঙ্গামাটি জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে পালন করা হবে মহান নেতার ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জুম্ম জাতীয় শোক দিবস। এবার সমিতির জেলা কমিটি কর্তৃক শ্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘জুম্ম জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করুন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী সকল কার্যক্রম প্রতিরোধ করুন, জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অধিকতর সামিল হউন’। অনুষ্ঠানসূচির মধ্যে রয়েছে- সকাল ৮:৩০ টায় জমায়েত ও কালোব্যাজ ধারণ, সকাল ৯ টায় পুষ্পমাল্য অর্পণ, সকাল ১০টায় শোক প্রস্তাব পাঠ ও স্মরণ সভা, বিকাল ৫ টায় প্রদীপ প্রজ¦ালন ও ফানুস উড়ানো।
এছাড়া জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে রাঙ্গামাটি জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়নে এবং খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও নাগরিক সমাজের উদ্যোগে দিবসটি উপলক্ষে আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
এছাড়া নিউইয়র্কেও আমেরিকান জুম্ম কাউন্সিলের উদ্যোগে স্মরণ সভার আয়োজন করা হয়েছে বলে জানা গেছে৷
উল্লেখ্য, আজ থেকে ৪১ বছর আগে ১৯৮৩ সালের ১০ই নভেম্বর গভীর রাতে জনসংহতি সমিতিরই মধ্যে থাকা রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী, বিশ্বাসঘাতক, বিভেদপন্থী ও অপরিণামদর্শী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের অতর্কিত সশস্ত্র হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন জুম্ম জনগণের অত্যন্ত প্রিয়জন, নিপীড়িত মানুষের পরম বন্ধু, পাহাড়ি-বাঙালি সকল সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় অবিসংবাদিত এই নেতা এম এন লারমা। তাঁর এই মর্মান্তিক মৃত্যুতে সমগ্র জুম্ম জাতিসহ বিশ্বের অধিকারকামী জনগণের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়।
একই ঘটনায় এম এন লারমার সাথে আরও শহীদ হন তাঁরই বড় ভাই সহযোদ্ধা শুভেন্দু প্রবাস লারমা (তুফান), সহযোদ্ধা অপর্ণাচরণ চাকমা (সৈকত), অমর কান্তি চাকমা (মিশুক), পরিমল বিকাশ চাকমা (রিপন), মনিময় দেওয়ান (স্বাগত), কল্যাণময় খীসা (জুনি), সন্তোষময় চাকমা (সৌমিত্র) ও অর্জুন ত্রিপুরা (অর্জুন)।
এম এন লারমা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর রাঙ্গামাটি শহরের অনতিদূরে মহাপূরম (মাওরুম) নামক এক বর্ধিষ্ণু গ্রামে। তাঁর ছোটভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) তাঁর অনুপস্থিতিতে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্ব ও জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের হাল ধরেন। সন্তু লারমার নেতৃত্বেই ১৯৯৭ সালে জনসংহতি সমিতি বাংলাদেশ সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। তাঁদের একমাত্র ও সবার বোন জ্যোতিপ্রভা লারমা মিনুও এক পর্যায়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এম এন লারমা ছিলেন একজন মহান চিন্তাবিদ, আদর্শবান রাজনীতিক ও আপোষহীন সংগ্রামী। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত, পুরনো সামন্ততান্ত্রিক সমাজের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ও জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের পথিকৃৎ, শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনিই প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের জন্য দাবি জানান।
এম এন লারমা ১৯৬০ দশকে জুম্ম জনগণের মরণ ফাঁদ খ্যাত কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এবং স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্রের হীন মুখোশ উন্মোচন করে এক বিবৃতি প্রদান করলে পাকিস্তান সরকার তাঁকে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত করে ১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নিরাপত্তা আইনের অধীনে গ্রেফতার করে। তিনি দুই বছর জেল খাটার পর ১৯৬৫ সালের ৮ মার্চ জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন।
তিনি মাত্র ৩১ বছর বয়সে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তরাঞ্চল হতে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭৩ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে এই অঞ্চল থেকে পুনরায় জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।
তাঁরই সুদক্ষ নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ভিন্ন ভাষাভাষি অধিকার বঞ্চিত আদিবাসী জুম্ম জনগণ জনসংহতি সমিতির পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণতান্ত্রিক উপায়ে নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন পরিচালনা করার সকল পথ রুদ্ধ হলে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের সংগ্রাম সশস্ত্র রূপ লাভ করে।
জুম্মদের জাতীয় জীবনে তাঁর অবদান অপরিমেয় ও অপরিসীম। নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন অসীম ধৈর্য, মনোবল, আত্মবিশ্বাস ও কষ্টসহিষ্ণুতার অধিকারী এবং অসাধারণ আদর্শবান, সৃজনশীল রাজনীতিক ও আপোষহীন সংগ্রামী। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন মৃদুভাষী, আচার-ব্যবহারের অমায়িক, ভদ্র, নম্র, ক্ষমাশীল, সৎ, নিষ্ঠাবান ও সুশৃঙ্খল এবং সাদাসিধা জীবনযাপনে অভ্যস্ত।
+ There are no comments
Add yours