হিল ভয়েস, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ঢাকা: গত সোমবার (২৫ নভেম্বর) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন কর্তৃক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মসূচীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন অগ্রাধিকার তালিকায় রাখার দাবিতে প্রধান উপদেষ্টা বরাবরে চিঠি পেশ করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের মানবাধিকার কর্মী ও যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন ও ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী কর্তৃক স্বাক্ষরিত উক্ত চিঠিতে বলা হয় যে, ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগ সন্ধিক্ষণ হিসাবে বিবেচিত হবে, যা ইতোমধ্যে ন্যায়বিচার, শান্তি এবং জাতীয় ঐক্যের জন্য নতুন করে আশা তৈরি করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন বিশ্বাস করে যে, এই অনন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার দেশমাতৃকাকে গণতান্ত্রিক নীতি ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত করবে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর ২৬ বছর ধরে চুক্তির মূল উপাদানগুলি অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি আদিবাসি জনগণ এবং সারাদেশের নাগরিকদের এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে। এই চুক্তির পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ বাস্তবায়ন শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যই নয়, বরং বাংলাদেশের সকল আদিবাসীদের মর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত রাখা এবং একই সাথে দেশের জাতীয় ঐক্যের জন্য অপরিহার্য।
প্রায় দুই বছর সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন অক্লান্তভাবে চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের পক্ষে জনগণকে সম্পৃক্ত করে কাজ করে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের এই আন্দোলন পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সারাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ছাত্র-যুব ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন নিম্নোক্ত ৭ দফা দাবির বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে:-
১. চুক্তি বাস্তবায়নে একটি সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা: এই চুক্তি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট সময়সীমা ভিত্তিক একটি সুস্পষ্ট ও কার্যকরী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।
২. পার্বত্য চট্টগ্রাম সামরিক তত্ত্বাবধান বন্ধ: পার্বত্য চট্টগ্রামে অব্যাহত সামরিক তত্ত্বাবধান এই অঞ্চলের শান্তি, অগ্রগতি ও উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেছে। অপারেশন উত্তরণ প্রত্যাহারপূর্বক সামরিক তত্ত্বাবধান স্থায়ীভাবে বন্ধ করা এবং এই অঞ্চলটিকে চুক্তির বিধানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তার শাসন কাঠামো বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৩. আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদের ক্ষমতায়ন: গণতান্ত্রিক, প্রতিনিধিত্বশীল স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা এবং পার্বত্য অঞ্চলের অন্যান্য চাহিদা মোকাবেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদকে চুক্তি অনুসারে যথাযথ ক্ষমতা প্রদান করার উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৪. ভূমি অধিকার এবং পুনর্বাসন: পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য ভূমি অধিকারের বিষয়টি অন্যতম সমস্যা। ভারত থেকে আগত পাহাড়ী শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনকে কার্যকর করা।
৫. অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও উন্নয়ন: পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণকে অবশ্যই দেশের মূলধারার অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘমেয়াদী সমৃদ্ধির জন্য এই অঞ্চলের অনন্য সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত ঐতিহ্যকে সম্মানপূর্বক টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা।
৬. সমতলের আদিবাসীদের জন্য প্রতিনিধিত্বশীল শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ: সমতলভূমির জেলাগুলির প্রচলিত সকল স্থানীয় সরকারে আদিবাসীদের জন্য বিশেষ আসন সংরক্ষণ এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া।
৭. সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন প্রতিষ্ঠা: সমতলের আদিবাসীদের জীবন, জমি এবং জীবিকা সংক্রান্ত তাদের নির্দিষ্ট চাহিদা এবং চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলায় অবিলন্বে একটি পৃথক ভূমি কমিশন প্রতিষ্ঠা করার জন্য দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করা।
উপরিউক্ত দাবিসমূহের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন শুরু করার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মসূচীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন অগ্রাধিকার তালিকায় রাখার জন্য নিম্নোক্ত ৫টি বিষয় অবিলম্বে বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সদয় দৃষ্টি প্রদান করা:-
১. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটির পুনর্গঠন: অন্তর্বর্তী সরকারকে চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটি পুনর্গঠন করা। পুনর্গঠিত কমিটি সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং চুক্তির বিধানগুলির আলোকে চুক্তি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণে ভূমিকা রাখা।
২. পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন সক্রিয় করা: পার্বত্য চট্টগ্রামে অমীমাংসিত ভূমি বিরোধ পাহাড়ীদের জন্য দুর্দশা ও বাস্তুচ্যুতির কারণ হয়েছে। এই কমিশনকে অবিলম্বে সক্রিয় করা এবং যতদ্রুত সম্ভব কমিশনের বিধিমালা প্রণয়ণ করা।
৩. আঞ্চলিক পরিষদের সাথে সংলাপ: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে অবিলম্বে গঠনমূলক সংলাপ শুরু করা। এই সংলাপের উদ্দেশ্য হবে চলমান সমস্যাগুলোর সমাধান, পার্বত্য চুক্তির বিধানগুলির সাথে আঞ্চলিক পরিষদের প্রচেষ্টাকে সমন্বয় করা এবং স্থানীয় শাসনে পরিষদের ভূমিকা নিশ্চিত করা। পারস্পরিক সহযোগিতা ও শ্রদ্ধার মনোভাব গড়ে তোলার মাধ্যমে, আঞ্চলিক পরিষদের সাথে সংলাপ চুক্তি বাস্তবায়নে অর্থপূর্ণ অগ্রগতির পথ প্রশস্ত করা।
৪. পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা পরিষদের পুনর্গঠন: আঞ্চলিক পরিষদের সাথে সংলাপের আলোকে, চুক্তির বিধান অনুসারে অনতিবিলন্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা পরিষদের পুনর্গঠন করা।
৫. সমতলের আদিবাসীদের ভূমি ও মানবাধিকার রক্ষায় উদ্যোগ গ্রহণ: সমতল ভূমিতে আদিবাসীরা তাদের ভূমি, মানবাধিকার এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে রক্ষার হুমকিসহ নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। অন্তর্বতীকালীন সরকারকে এই জাতিসমূহের সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য একটি কমিশন গঠন করা। এই কমিশন সমতলের আদিবাসীদের অধিকার রক্ষা, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা এবং তাদের উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য কাজ করা।