পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী ছাত্র রাজনীতিতে প্রসিত চক্র (৩য় অংশ)

পলাশ খীসা

১২ ডিসেম্বর ’৯৫ ঢাকা মহানগর শাখার উদ্যোগে ঢাকাস্থ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন ভর্তি হওয়া পাহাড়ী ছাত্রছাত্রীদের বরণ করে নেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রধান অতিথি ঢাবি’র তৎকালীন উপাচার্য এমাজউদ্দিন আহমেদকে ঠিক করা হয় এবং ঢাবির ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের অডিটোরিয়াম ভাড়া করা হয়। কিন্তু তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের ৯-১১ ডিসেম্বর ৭২ ঘন্টার হরতাল এবং পরিবহন শ্রমিকদের পক্ষ থেকে ৭-৮ ডিসেম্বর দু’দিন পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। ফলে নবীন বরণ অনুষ্ঠান যথেষ্ট কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে। সবচাইতে সমস্যায় পড়তে হয় কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তের কারণে। ঢাকা মহানগর শাখার পক্ষ থেকে বিশেষ অতিথি করা হয় তৎকালীন পাহাড়ী গণ পরিষদের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য সৌখিন চাকমা, সহ সাধারণ সম্পাদক শক্তিপদ ত্রিপুরা, পিসিপির কেন্দ্রীয় সভাপতি কে এস মং মারমা। কে এস মং মারমা দীর্ঘদিন যাবৎ বান্দরবানে অবস্থান করার কারণে কেন্দ্রীয় দপ্তরের সাথে তার খুব বেশী যোগাযোগ ছিল না। ফলে পিসিপির কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে ৬ ডিসেম্বর ’৯৫ বলা হলো সৌখিন চাকমাকে অতিথি করা যাবে না। কারণ তিনি জুম্ম জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী কাজে লিপ্ত, আর্মীদের সাথে তার ঘনিষ্ট সম্পর্ক ইত্যাদি ইত্যাদি। ঢাকা মহানগর শাখার পক্ষ থেকে আমরা কেন্দ্রীয় কমিটিকে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখিতভাবে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করি। পরের দিন কেন্দ্রীয় কমিটি লিখিতভাবে জানালো যে, সৌখিন চাকমাকে অতিথি করা যাবে না। কিন্তু বিস্তারিত কোনো কারণ তারা উল্লেখ করেনি। সেই সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর ঢাকা মহানগর শাখার পক্ষ থেকে খাগড়াছড়ি গিয়ে সৌখিন চাকমার সাথে আলাপ করার সিদ্ধান্ত হলেও পরিবহন ধর্মঘটের কারণে তা সম্ভব হয়নি। ৯ ডিসেম্বর ভোর রাতে তিনি ঢাকায় এসে পৌঁছেন। এই বিষয়টি নিয়ে আমরা সিনিয়রদের সাথে পরামর্শ করলাম। তারা আমাদের জানালো যেহেতু সৌখিন চাকমাকে অতিথি করা হয়েই গেছে অর্থাৎ তাকে বলা হয়েছে, আমন্ত্রণপত্রে তার নাম ছাপানো ও বিলি করা হয়েছে কাজেই তাকে বাদ দেওয়া যায় না। আমরা মহানগর শাখার নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নিলাম যা হবার হোক আমাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সৌখিন চাকমা অতিথি হবেন। পরবর্তীতে সৌখিন চাকমার বিষয়ে আমরা খবর নিয়ে তেমন কিছু পেলাম না। মূল কারণ হলো সৌখিন চাকমার সাথে প্রসিতের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো নয়। প্রসিতের ভুলগুলোর একজন তীব্র সমালোচক তিনি। তাই তাদের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। তাছাড়া পাহাড়ী গণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অতিথি হবার কথা প্রসিতের- সাংগঠনিক দিক বিবেচনা করলে। সেই জায়গায় সৌখিন চাকমাকে অতিথি হিসেবে প্রসিতের বা তার অনুসারী পিসিপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভবপর ছিল না। ফলে যে কোনো অজুহাতে সৌখিন চাকমাকে বাদ দিতে চায় তারা। কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে নবীনবরণ অনুষ্ঠানে কোনো প্রকার সহযোগিতা তো দূরের কথা বরং বিরোধিতা করা হলো। অনুষ্ঠানে যাতে ছাত্রছাত্রীদের জমায়েত কম হয় তার চেষ্টা করা হলো। প্রসিতের অনুসারীরা কেউই সেই অনুষ্ঠানে যায়নি। তারপরও লোকের উপস্থিতি বা শৃঙ্খলার দিক দিয়ে কোনো প্রকার ঘাটতি ছিল না। অত্যন্ত সুন্দরভাবে নবীনবরণ অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন হয়।

১৫-১৬ ডিসেম্বর ’৯৫ বিশেষ প্রতিনিধি সম্মেলন কুতুকছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। কুতুকছড়ি প্রসিতের সমর্থিত অঞ্চল বলা যায়। সেই প্রতিনিধি সম্মেলনে ঢাকা মহানগর শাখার পক্ষ থেকে আমরা তিনজন কনকবরণ ত্রিপুরা, জিতেন চাকমা ও আমি অংশগ্রহণ করি। সেই সম্মেলনে এতই শৃঙ্খলা (?) আরোপ করা হয় যে, কুতুকছড়ি শাখার পক্ষ থেকে যেখানে বলবে সেখানে আমাদের থাকতে হবে। অথচ আমি সম্মেলনের বেশ কিছুদিন পূর্বে আমার স্কুল জীবনের ঘনিষ্ট বন্ধু সুবর্ণ চাকমাকে চিঠিতে জানিয়েছি যে, প্রতিনিধি সম্মেলনের সময় আমরা তাদের বাড়ীতে থাকবো। তাদের বাড়ী বাদলছড়ি গ্রামে, বাজারের সামান্য পূর্ব দিকে। সেই অনুযায়ী সুবর্ণ আমাদের অপেক্ষায় ছিল। আমরা যখন তাদের বাসায় যেতে চাচ্ছি তখন পিসিপি নেতা অমর জীবন চাকমা যেতে দিচ্ছে না। ইতিমধ্যে সুবর্ণের বড় ভাই অহিংসা’দাও সেখানে উপস্থিত হয়েছেন চবি শাখার নেতাদেরকে তাদের বাড়ীতে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু কাউকেই যেতে দিচ্ছে না অমর জীবন। অহিংসা’দা যেহেতু অভিলাষের বড় ভাই (আপন মামাতো ভাই) তাই তিনি এক প্রকার জোর করে নিয়ে গেলেন তাদের বাড়ীতে। আমি জানি না সেই সম্মেলনে আমাদের অবস্থা কি হতো। কারণ আমরা অত্যন্ত গোপন সূত্রে খবর পেয়েছি যে, আমাদেরকে কুতুকছড়ি সম্মেলনে প্রসিত চক্র বড় ধরনের ক্ষতি করবে। তাই সুবর্ণ এবং অহিংসা’দা দু’ভাই আমাদের জন্য বাজারে অপেক্ষা করতেন যতক্ষণ আমাদের অধিবেশন চলতো। তাদের বাড়ী কুতুকছড়ি বাজারের পাশে এবং এলাকার শিক্ষিত ছেলে হিসেবে তাদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। তাদের সামনে আমাদেরকে কোনো কিছু করা সেই সময়ে কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। সম্মেলনে ঢাকা মহানগর শাখার উপর নিন্দা জ্ঞাপন করা হয় নবীনবরণ অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করার অপরাধে। আমরা আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য রেখেছি। সম্মেলনে ব্যক্তি বিশেষে আমাদেরকে তীব্রভাবে সমালোচনা করে কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ সম্পাদক নিকোলাস চাকমা। সে বলে “জিতেন চাকমা বর্মাছড়িতে বক্তব্য রাখতে না পারায় চম্পানন চাকমাকে ঢাকায় মারধর করা হয়েছে। চম্পাননকে মারধর করেছে পলাশ খীসার মাস্তানরা। তার সব সময় ৭/৮ জনের একটি মাস্তান বাহিনী থাকে। যাকে ইচ্ছে করে তাকে পেটায় সে তার মাস্তান বাহিনী দিয়ে।” এছাড়াও অনেক অনেক অযৌক্তিক, বানোয়াট ও মিথ্যা কথা বলেছিল নিকোলাস। কেন্দ্রীয় কমিটির কোনো কোনো বক্তার একতরফা অযৌক্তিক সমালোচনা বিষয়ে রাঙ্গামাটি জেলার তৎকালীন সভাপতি মৃগাঙ্ক খীসাসহ অনেকেই সমালোচনা করেন। কেন্দ্রীয় কমিটির বক্তব্য আরো মার্জিত এবং তথ্য ভিত্তিক হওয়া উচিৎ বলে শাখার নেতৃবৃন্দ মন্তব্য করেন।

সেই প্রতিনিধি সম্মেলনে তৎকালীন কেন্দ্রীয় নেতা প্রতীক দেওয়ান বলেন, প্রসিত উদীয়মান সূর্যের মতো। তার যোগ্যতাকে কেউ ঢেকে রাখতে পারবে না। বিভিন্ন সময়ে শোনা যায় প্রসিত গ্রুপ বনাম সমীর গ্রুপ, প্রসিত গ্রুপ বনাম পাম্পু গ্রুপ, প্রসিত গ্রপ বনাম শক্তিমান গ্রুপ। প্রসিতকে ঘিরে প্রায় সব সময় অন্য একটা গ্রুপকে তার বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়।

২০ মে ’৯৬ ৭ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ও ২১-২৩ মে ৬ষ্ঠ কেন্দ্রীয় কাউন্সিল ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০ মে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর সকালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এবং র‌্যালী সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে সমাপ্ত হয়। কিন্তু বিকালে আলোচনা সভা চলাকালীন সময়ে আমাদের এক শুভাকাঙ্খী খবর দিলেন বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান হতে চলেছে। আমাদের সতর্ক অবস্থায় থাকা উচিৎ। আলোচনা সভা শেষ হওয়ার পর সংক্ষিপ্তাকারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানসূচী শেষ করা হয়। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগে সঞ্চয়, দেবাশীষ ও আমি বিভিন্ন পাহাড়ী সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে ফোনে যোগাযোগ করি। এছাড়াও অন্যান্য শুভাকাঙ্খীদের পরামর্শ নিই। সবাই কাউন্সিল স্থগিত করে তিন পার্বত্য জেলা থেকে আগত ছাত্রছাত্রীদের ফেরৎ পাঠিয়ে দেয়ার পরামর্শ দেন। আমরাও বিষয়টা চিন্তা করে সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। সবাইকে এক এক করে বিদায় দেয়া হচ্ছে। কিন্তু রাঙ্গামাটি জেলাকে বিদায় দেয়া যাচ্ছে না জেলা শাখার সভাপতি মৃগাঙ্ক খীসা ও সাধারণ সম্পাদক বোধিসত্ত্ব চাকমাকে পাওয়া যাচ্ছে না বলে। সজল চাকমা চাম্পা সমস্ত জায়গা খোঁজাখুঁজি করেও পায়নি। আমার হঠাৎ মনে পড়লো সেই সময়ে সিনিয়র কয়েকজন নেতৃবৃন্দের সাথে একটি জায়গায় মতবিনিময় করার কথা ছিল তাদের। তাৎক্ষিণকভাবে আমি সেখানে গিয়ে তাদেরকে ডেকে নিয়ে আসলাম। তখনই সঞ্চয়দের সন্দেহ হলো যে, রাঙ্গামাটি জেলা শাখাও তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। যেহেতু মৃগাঙ্ক ও বোধি’কে আমি খুঁজে নিয়ে এসেছি।

স্থগিত করা কাউন্সিলের তারিখ পুনঃ নির্ধারণ করা হয় ১৮-২০ জুন ’৯৬। স্থান খাগড়াছড়ি জেলা সদরে খবংপয্যা পুরাতন প্রাইমারী স্কুলে (তৎসময়ে পরিত্যক্ত)। যথারীতি কাউন্সিল শুরু হয় প্রথম দিনে ১৪২ জন প্রতিনিধি নিয়ে। দ্বিতীয় দিনে কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু তৃতীয় দিনে (শেষ দিন) কাউন্সিলার সংখ্যা বেড়ে ১৬৩ জনে উন্নীত হয়। কাউন্সিলে ঢাকা মহানগর, চট্টগ্রাম মহানগর ও বিশ্ববিদ্যালয়, রাবি- এই শাখাসমূহের নেতৃবৃন্দকে আসামীর মতো চোখে চোখে রাখা হতো। কাউন্সিলে ঢোকার সময় ব্যাগগুলো নিয়ে যাওয়া হতো দপ্তরে জমা রাখার কথা বলে। প্রস্রাব করতে গেলেও কমপক্ষে একজন স্বেচ্ছাসেবক সাথে যাবেই যাতে অন্য কারো সাথে কথা বলা না যায়। কাউন্সিলের এক পর্যায়ে একজন স্বেচ্ছাসেবক এসে আমাদের ঢাকা মহানগর শাখার ফাইলসহ কাগজ-পত্রগুলি নিয়ে যাচ্ছে দেখে আমি সরাসরি বলি- ‘এসব ফাইলপত্র আমাদের দেয়া সম্ভব নয়। এখানে অনেক মূল্যবান কাগজপত্র রয়েছে।’ বক্তব্য রাখার জন্য যখন মঞ্চে গেছি তখন মঞ্চের পাশে বাইরে থেকে বেড়ায় আঘাত করা হয় এবং বক্তব্য শেষ করার জন্য বলা হয়। আমার মতো রাজশাহী ও চট্টগ্রাম শাখার নেতাদেরসহ বেশ কিছু শাখার নেতাদের এরকম করা হয়েছে। অর্থাৎ এমন একটা ভীতিকর পরিস্থিতি তারা সৃষ্টি করেছে যাতে কাউন্সিলররা তাদের সুচিন্তিত মতামত দিতে না পারে। তারপরও তারা যখন দেখলো যে- ভোটাভুটি হলে জিতবে না, সে কারণে তৃতীয় দিনে শাখা না থাকলেও বিভিন্ন আঞ্চলিক শাখার নাম দিয়ে ২১ জন কাউন্সিলর বৃদ্ধি করেছে। কাউন্সিলের শেষ অধিবেশনে সাবজেক্ট কমিটি একটি নতুন কমিটি হাউসে উপস্থাপন করে। সাবজেক্ট কমিটির ঘোষিত পদের বিপরীতে কাউন্সিলরদের পক্ষ থেকে নতুন নাম প্রস্তাব করা হয়। ফলে হস্ত উত্তোলনের মাধ্যমে ভোটাভুটি সম্পন্ন হয়ে যায়। হস্ত উত্তোলনের সময় স্বেচ্ছাসেবকরাও নিরপেক্ষ ছিল না। তারা প্রসিত চক্রের পক্ষে হস্ত উত্তোলন করার জন্য কাউন্সিলরদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। তাই কাউন্সিলে সাবজেক্ট কমিটির বিপরীতে প্রস্তাবিত কোনো পদে কেউ জয়ী হতে পারেনি। তবে সাবজেক্ট কমিটির ভোট যোগ করেও প্রসিত চক্রের সঞ্চয়সহ অন্যান্যরা কয়েক ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, যদি বিভিন্ন আঞ্চলিক শাখার নাম দিয়ে শেষ দিনে ২১ জন অবৈধ কাউন্সিলর বৃদ্ধি না করতো তাহলে সেদিনই পদ্ধতিগতভাবে প্রসিতচক্র পিসিপি থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হতো। তাছাড়াও তাদের সমর্থিত এলাকা থেকে আঞ্চলিক ও স্কুল শাখার নামে অনেক অবৈধ কাউন্সিলর নিয়ে এসেছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাঘাইছড়ি থেকে ১০ জন অতিরিক্ত অবৈধ কাউন্সিলর আনা হয়েছে আঞ্চলিক ও স্কুল শাখার নাম দিয়ে। এতকিছু করার পরও প্রসিত চক্র একতরফাভাবে নিজেদের লোক দিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করতে পারেনি। ’৯৬ এর কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে ভোটাভুটি হওয়ার বা পদ্ধতিগতভাবে প্রসিত চক্রকে পিসিপি থেকে হটানোর চেষ্টা করা হয়েছিল এ কারণে যে, প্রসিতের নেতৃত্বে আলাদা একটি পার্টি গঠনের প্রক্রিয়া নব্বই দশকের প্রথম দিকে শুরু হলেও ’৯৫ সালের শেষের দিকে সেটা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। ’৯৪ এর ১৫ জুন ছাত্র রাজনীতি থেকে বিদায় নেয়ার পর প্রসিত গ্রুপিং-এর মাধ্যমে গণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের পদটি দখল করে নেয় এবং পাহাড়ী গণ পরিষদের নাম পরিবর্তন করে “জুম্ম ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট” বা “ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট” করে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে একটি পূর্ণাঙ্গ পার্টিতে রূপ দেয়ার চেষ্টা করেন প্রসিত। সেই সময়ে পাহাড়ী গণ পরিষদের অনেকেই বিরোধিতা করার কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তবে গঠনতন্ত্রে উপরেল্লেখিত দু’টি নাম সন্নিবেশিত করা হয়। তখন থেকে বাইরে গণতান্ত্রিকভাবে আন্দোলনরত তিন সংগঠনের (পিসিপি, পিজিপি, এইচডব্লিউএফ) সচেতন নেতাকর্মীরা প্রসিতের বিষয়ে আরো অধিকতর সতর্ক হয়ে যায়।

১৮-২০ জুন ’৯৬ কাউন্সিলের মাধ্যমে পিসিপির নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ২১ জুন ’৯৬ খাগড়াছড়ির খবংপয্যায়। সেই মিটিংয়ে উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্তের মধ্যে ছিল ১১-১২ জুলাই ’৯৬ কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে এবং ২৭ জুন ’৯৬ কল্পনা চাকমা অপহরণের প্রতিবাদে তিন পার্বত্য জেলায় সড়ক অবরোধের ডাক দেয়া হয়। সেই কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে জনৈক অনুপ্রবেশকারী ভিডিপির কাছ থেকে রাইফেল কেড়ে নিয়ে জনতার উপর গুলি চালালে বাঘাইছড়ির বাবু পাড়া এলাকায় স্কুল ছাত্র রূপন চাকমা ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন এবং অনুপ্রবেশকারীরা তাকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। রূপনের শরীর টুকরো টুকরো করে কেটে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয় অনুপ্রবেশকারীরা। একই দিনে তুলাবান থেকে আসার পথে মুসলিম ব্লক এলাকায় গুম করা হয় সুকেশ, মনোতোষ ও সমর বিজয় চাকমাকে। আজো পর্যন্ত তাদের খোঁজ মিলেনি। ধারণা করা হয় তাদেরকে নৃশংসভাবে খুন করেছে অনুপ্রবেশকারীরা। উল্লেখ্য যে, ১২ জুন ’৯৬ ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৬ ঘন্টার পূর্বে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদিকা কল্পনা চাকমাকে কুখ্যাত লেঃ ফেরদৌস এর নেতৃত্বে অপহরণ করা হয়। আজ অবধি আমাদের প্রিয় বোন কল্পনাকে পাওয়া যায়নি।

১১ ও ১২ জুলাই কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভা হবার কথা থাকলেও একদিন আগে ঢাকায় জানানো হলো ১১ জুলাই ’৯৬ তিন সংগঠনের যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হবে। অথচ সেই সভার খবর পাহাড়ী গণ পরিষদের অনেকেই জানেন না। ব্যক্তিগত কাজে তখন ঢাকায় গিয়েছিলেন ভূবন ত্রিপুরা (বর্তমানে বিসিএস কর্মকর্তা)। যিনি তৎকালীন সময়ে পাহাড়ী গণ পরিষদের একজন কেন্দ্রীয় সদস্য। তিনিও এই সভার খবর জানতেন না। একদিন আগে শুনে মিটিংএ গিয়েছিলেন তিনি। সেই মিটিংএ তৎকালীন নবগঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে তিন সংগঠনের উদ্যোগে আমাদের দাবী দাওয়া সম্বলিত স্মারকলিপি প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যেহেতু ১২ জুলাই পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সভা অনুষ্ঠিত হবে সেহেতু স্মারকলিপি লেখার দায়িত্ব দেয়া হয় প্রসিতকে। প্রসিত স্মারকলিপিটি লিখে পিসিপির কেন্দ্রীয় সভা শেষ হওয়ার আগে পিসিপির নেতৃবৃন্দকে দিবেন। তিন সংগঠনের সেই মিটিংএ সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল প্রসিতের একটি প্রস্তাব। তিনি প্রস্তাব করেন যে, তিন সংগঠনের নামে একই রশিদ বই ছাপানো ও এক সাথে টাকা উত্তোলন করা এবং প্রতি তিন মাস অন্তর তিন সংগঠনের যৌথ মিটিং করা। এটাও তার আলাদা পার্টি গঠনের প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নিয়ে প্রথমেই তৎকালীন পিসিপির সাংগঠনিক সম্পাদক মৃগাঙ্ক খীসা সেই প্রস্তাবের বিরোধীতা করেন। তিনি বলেন এটা একটা মৌলিক বিষয়। তাই এই মুহূর্তে আমাদের এখতিয়ার নেই তিন সংগঠনের নামে একই রশিদ বই ছাপার। প্রতিটি সংগঠন তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে নির্ধারণ করবে তারা তিন সংগঠনের নামে রশিদ বই ছাপাবে কি-না। আর গঠনতন্ত্র সংশোধন করতে হলে পিসিপিকে অবশ্যই কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন আদায় করতে হবে। তার সাথে একমত হয়ে থোয়াই অং মারমা, জলিমং মারমা, ভূবন ত্রিপুরা ও পলাশ খীসাসহ অনেকেই বক্তব্য রাখেন। মৃগাঙ্কের বক্তব্যের বিরোধীতা করেও অনেকেই বক্তব্য রাখেন এমনকি সেদিন রবি শংকর চাকমা ও সচিব চাকমা তাকে বলেন বিরুদ্ধবাদী, সংকীর্ণমনা। উপরোক্ত শব্দদ্বয়ের (বিরুদ্ধবাদী, সংকীর্ণমনা) উপর আপত্তি জানানো হলে প্রসিত তাদের পক্ষ হয়ে ক্ষমা চান। সেদিন রণজিৎ দেওয়ান রাজু রবি শংকরের উদ্দেশ্যে বলেন- ‘আলোচনা ব্যতীত কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক নয়। আলোচনা করতে না দিয়ে সংকীর্ণমনা বলা- এটাও এক ধরনের সংকীর্ণতা।’ এভাবে সেদিন প্রসিতের ষড়যন্ত্র রুখে দেয়া হয়।

পরের দিন ১২ জুলাই পিসিপির কেন্দ্রীয় সভার শেষ অধিবেশনে প্রসিতের লেখা দাবীদাওয়া সম্বলিত স্মারকলিপি পৌঁছে যায়। তখন সেটি একে একে পড়ে দেখার জন্য দেয়া হয়। এসময় প্রসিতের অনুসারীরা কোথাও কোনো ভুল নেই বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু যখন মৃগাঙ্ক এর পড়ার দায়িত্ব পড়লে তখন তিনি সাথে সাথে আপত্তি জানান যে, দাবীগুলোর প্রথমেই ভুল রয়েছে। প্রথম দাবীটাতে লেখা হয়েছে, “পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানের জন্য সরকারকে বৈঠকে বসে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে এবং সেই বৈঠকে পিসিপি, পিজিপি, এইচডব্লিউএফ এই তিন সংগঠনের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক রাখতে হবে।” তিনি বলেন সরকার কার সাথে বৈঠকে বসে সামাধান করবে এটা স্পষ্ট নয়। এখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের একমাত্র রাজনৈতিক দল জনসংহতি সমিতির নাম উল্লেখ করতে হবে এবং তিন সংগঠনের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক দাবী করা যুক্তিসঙ্গত হবে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন যে, জনসংহতি সমিতির নাম না লিখলে অস্পষ্টতা থেকে যাবে। তিন সংগঠনের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক দাবী করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কারণ জনসংহতি সমিতি জুম্ম জনগণের একমাত্র প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল এবং আমরা তিন সংগঠনের পক্ষ থেকে অভিভাবক সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এসেছি সংগঠনগুলোর জন্মের পর থেকে। অনেক যুক্তি, পাল্টা যুক্তি দেওয়ার পর প্রসিত চক্র জনসংহতি সমিতির নাম সংযোজনে রাজী হলেও পর্যবেক্ষকের বিষয়ে তারা রাজী হতে চাচ্ছিলেন না। যখন তাদেরকে বলা হলো আমরা যদি পর্যবেক্ষক এর দাবী করি তাহলে পার্বত্য বাঙালী পরিষদ জাতীয় সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোও একই দাবী করতে পারে। ফলে একটা জটিলতা সৃষ্টি হবে। পরবর্তীতে তারা এই যুক্তিটি মেনে নিতে বাধ্য হয়। তখন থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তারা জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রাখতে পারছিলেন না বা জনসংহতি সমিতির অধীনে তারা থাকতে চাচ্ছিলেন না এবং তাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের আকাঙ্খার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। সেই কারণে তিন সংগঠনের নামে একই রশিদ বই ছাপিয়ে তারা পার্টি গঠনের প্রক্রিয়াকে একধাপ এগিয়ে নিতে চায়।

৯ আগষ্ট ’৯৬ ঢাকা মহানগর শাখার কাউন্সিলের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। দুই দিন আগে ঢাকা মহানগর শাখার কাউন্সিল পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে একটি ৫ সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক হলেন ক্যাজরী মারমা (পিসিপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক) এবং সদস্য হিসেবে নেয়া হয় মৃগাঙ্ক খীসা (পিসিপির তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক), খুশীরায় ত্রিপুরা (পিসিপির তৎকালীন এজিএস), সমারী চাকমা (সাংস্কৃতিক সম্পাদিকা), সদস্য-লয়েল ডেভিড বম ও মংএচিং চাক এমং-কে। সেই মিটিং-এ আরো সিদ্ধান্ত হয় যে, ৮ আগষ্ট বিকেল ৫টার মধ্যে প্রতিনিধিদের তালিকা কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কাছে ঢাকা মহানগর শাখাকে অবশ্যই জমা দিতে হবে। কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা মহানগর শাখার পক্ষ থেকে প্রতিনিধিদের তালিকা দেয়া হলে কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি তা যাচাই বাছাই করে চূড়ান্ত করে। ৯ আগষ্ট ’৯৬ ঢাকা মহানগর শাখার কাউন্সিলে প্রথম অধিবেশন জগন্নাথ হলের দক্ষিণ বাড়ী টিভি কক্ষে শুরু হয়। কাউন্সিল অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন শাখার সভাপতি পলাশ খীসা। এক এক করে স্বাগত বক্তব্য, অর্থ সম্পাদকের রিপোর্ট, সাংগঠনিক সম্পাদকের রিপোর্ট পেশ করা হয়। তারপর প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে অর্থ ও সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টের উপর আলোচনা আরম্ভ হয়। এক পর্যায়ে জনৈক এক বক্তা ঢাকা মহানগর শাখার মনোৎপল চাকমাকে মুখোশ বাহিনীর অধিকার পত্রিকায় মুখোশ বাহিনীর ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি হয়েছে বলে উল্লেখ করেন এবং তিনি জানতে চান বিষয়টা সত্য কি-না? এসময় এক প্রতিনিধি সুজ্ঞান চাকমা তার বক্তব্যে বলেন, মুখোশ বাহিনী তাদের পত্রিকায় কেবল মনোৎপলের কথা লিখেনি তারা এটাও লিখেছে এবং প্রচার করেছে- কবিতার পেটে প্রসিতের বাচ্চা রয়েছে। সেটাও সত্য কি-না তা তিনি জানতে চান। তখন কবিতা মঞ্চে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অনেক আলোচনা ও পর্যালোচনার পর দুপুরের আহারের ১ ঘন্টার বিরতি দিয়ে প্রথম অধিবেশনের সমাপ্তি ঘটে। দ্বিতীয় অধিবেশনের শুরুতেই সাবজেক্ট কমিটির পক্ষ থেকে জিতেন চাকমাকে সভাপতি ও বিবিসুৎ ত্রিপুরাকে সাধারণ সম্পাদক করে ২১ সদস্যের একটি প্যানেল প্রতিনিধিদের নিকট উত্থাপন করা হয়। উল্লেখ্য যে, দুপুরের বিরতির সময়ে সাবজেক্ট কমিটি মিটিং-এ বসে উক্ত প্যানেল প্রস্তুত করে। প্রসিত চক্র সেই প্যানেলের বিপরীতে দীপায়ন খীসাকে সভাপতি ও রূপক চাকমাকে (কিছুদিন আগে নিহত হন) সাধারণ সম্পাদক করে একটি পাল্টা প্যানেল প্রস্তাব করে। ফলে ভোটাভুটির প্রশ্ন এসে গেলে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির উপর দায়িত্ব বর্তায় সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার। কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে ব্যালট পেপার তৈরী করা হয় এভাবে-

নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে খুশীরায় ত্রিপুরা কিভাবে ভোট দিতে হবে তা প্রতিনিধিদের বুঝিয়ে দেন। তিনি বলেন বাম দিকে সাবজেক্ট কমিটি কর্তৃক প্রস্তাবিত কমিটির নাম এবং ডানদিকে হাউস কর্তৃক প্রস্তাবিত কমিটির নাম রয়েছে। মাঝখানে পদবী লেখা হয়েছে। আপনারা সাবজেক্ট কমিটি কর্তৃক প্রস্তাবিত কমিটির পক্ষে ভোট দিতে চাইলে বামে ঠিক চিহ্ন দিবেন এবং হাউস কর্তৃক প্রস্তাবিত কমিটির পক্ষে ভোট দিতে চাইলে ডানে ঠিক চিহ্ন দিবেন। তিনি বলেননি যে সর্ববামে ক্রমিক নং রয়েছে এবং সেখানে ঠিক চিহ্ন দেয়া যাবে না। ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর ভোট গণনা শুরু হয়। গণনার সময় দীপায়ন খীসা ক্রমিক নম্বর ও নামের মাঝখানে ঠিক চিহ্ন দেয়া ভোটগুলো কি হবে এ প্রশ্ন করেন সঞ্চয় চাকমাকে। সঞ্চয় চাকমা উত্তরে বলেন যে, “এগুলো ঠিক আছে”। গণণা শেষ করে দেখা যায় যে, সাবজেক্ট কমিটি কর্তৃক প্রস্তাবিত কমিটি জয়যুক্ত হয়েছে। তখন দীপায়ন খীসা আপত্তি তুলেন ক্রমিক নম্বর ও নামে যাদের ঠিক চিহ্ন পড়েছে সে ব্যালটগুলো বাতিল করতে হবে। এধরনের ব্যালট পেপার বা ভোট ছিল মোট ৬৪টি। এই ৬৪টি ব্যালট বাতিল করলে হাউস কর্তৃক প্রস্তাবিত কমিটি জয়যুক্ত হয়। ভোট গণনা যখন শেষ হয় তখন রাত ১০টা বাজে। ৬৪টি ভোট বাতিল হবে কি হবে কি না এবিষয়টি সমাধা করার জন্য কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে। ফলে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি মিটিং-এ বসলে সেখানেও মত পার্থক্য সৃষ্টি হয়। দুইজন বাতিল করার পক্ষে এবং দুইজন বিপক্ষে। ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির মধ্যে লয়েল ডেভিড বম-এর কাজ থাকার কারণে ভোট গ্রহণ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর পরই তিনি চলে যান। যে ৪ জন উপস্থিত ছিলেন তার মধ্যে মৃগাঙ্ক খীসা ও মংএচিং চাক এমং বাতিল করার বিপক্ষে। তাদের যুক্তি হলো, “যে ৬৪ জন ভোট দিয়েছে তাদের কোন ভুল নেই। নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে খুশীরায় সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিতে পারেননি বলে ঠিক চিহ্ন নামের পাশে ক্রমিক নং এ এসে পড়েছে। তাছাড়া এটা স্পষ্ট বোঝা যায় সাবজেক্ট কমিটি কর্তৃক প্রস্তাবিত কমিটিকে সমর্থন করে বাম পাশে ভোট দিয়েছে। কারণ দুটো কমিটির মধ্যে একটা বাম পাশে আর একটা ডান পাশে। কাজেই এই গণতান্ত্রিক মতামতকে বাতিল করার ক্ষমতা নির্বাচন পরিচালনা কমিটির নেই।” অপরপক্ষে খুশীরায় ত্রিপুরা ও ক্যজরী মারমা সেই ভোটগুলো বাতিল করার পক্ষে। তাদের যুক্তি হলো, “তাদেরকে বাম পাশে নামের উপর ভোট দিতে বলা হয়েছে, ক্রমিক নম্বরের উপর নয়।”

এখানে উল্লেখ্য যে, ক্যজরী মারমা আহ্বায়ক হিসেবে শুরুতে ভোট দিতে পারেন না। যদি সমান সমান ভোট পড়ে তখন কাষ্টিং ভোট দিতে পারেন। কিন্তু তিনি আগে থেকেই একটা পক্ষ নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি করেন। অমীমাংসিতভাবে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির মিটিং শেষ হয়। তখন রাত ১২টা বাজে। তখনো প্রায় ১৫০/১৬০ জন প্রতিনিধি রেজাল্টের অপেক্ষায় ছিল। এরপর কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং শুরু হতে যাচ্ছে এমন সময় কাউন্সিল পরিচালনা কমিটির সদস্য মংএচিং চাক হল থেকে বের হয়ে গেলে উপস্থিত প্রতিনিধিদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে প্রদীপ চাকমা (সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা মহানগর) কেন্দ্রীয় কমিটিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আমরা আজকের মধ্যে রেজাল্ট চাই, আমাদের দ্রুত রেজাল্ট দিন।” তখন তৎকালীন সভাপতি সঞ্চয় চাকমা রাগতঃস্বরে প্রতিনিধিদের হল থেকে বের হয়ে যেতে বললে আরো বেশী উত্তেজিত হয় প্রতিনিধিরা। তখন ঢাকা মহানগরের সভাপতি পলাশ খীসা এবং থোয়াইঅং মারমা কেন্দ্রীয় মিটিং-এর স্বার্থে প্রতিনিধিদের বাইরে যাওয়ার অনুরোধ করলে তারা চলে যায়। সেই সময়ে প্রসিত চক্রের অনুসারীরা অক্টোবর স্মৃতি ভবনের দিকে গেলে স্বেচ্ছাসেবকরা নিরাপত্তার কারণে হলের গেইট ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়। এরপর কেন্দ্রীয় মিটিং শুরু হলে অনুরূপ যুক্তি দিয়ে ৬৪টি ভোট বাতিল করার পক্ষে ও বিপক্ষে মতামত ব্যক্ত করা হয়। ফলে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছে না কেন্দ্রীয় কমিটি। এক পর্যায়ে সঞ্চয় ৬৪টি ভোট বাতিল না করলে তারা (প্রসিত চক্র) সংগঠন থেকে পদত্যাগ করবে বলে জানায়। সে মনে করেছিল তাদেরকে ছাড়া সংগঠন চলবে না। ফলে তাদের পদত্যাগের হুমকিতে কেন্দ্রীয় কমিটির বাকী সদস্যরা সবাই একমত হয়ে ভোটগুলো বাতিল করে দীপায়নের নেতৃত্বাধীন কমিটিকে জয়যুক্ত হিসেবে অনুমোদন করবে। কিন্তু ফল হয়ে যায় উল্টো, জলিমং মারমা (তৎকালীন সহ-সভাপতি) বলে ফেলেন যে, “ঠিক আছে পদত্যাগ করেন, আমরা সংগঠন চালাবো। তারপরও অযৌক্তিক দাবী মেনে নেব না।” ঐ সময় মৃগাংঙ্ক খীসা বলেন, “আপনারা পদত্যাগ করবেন কেন? আপনাদের উপর তো অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। প্রয়োজনে কাউন্সিল স্থগিত হবে কিংবা ৫ সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আবারও বৈঠক হবে।” এক পর্যায়ে আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে বসে রয়েছে সঞ্চয়। সমারী ও মিন্টু বিকাশ খীসা প্রকৃতির ডাকের অজুহাত দেখিয়ে বাইরে যেতে চাইলে গেইট বন্ধ থাকার কারণে যেতে পারেনি। স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে তালার চাবি না থাকায় স্বেচ্ছাসেবকরা তালা খুলে দিতে পারেনি। রাত বেশী হওয়ায় দারোয়ান তালা খুলে দিয়ে চলে গেছে যাতে যাওয়ার সময় রুমটি বন্ধ করে দিয়ে যেতে পারে। স্বেচ্ছাসেবকরা ভিতরে ছিল ফলে চাবি আসতে আসতে দেরী হয়ে যায়।

রাত বাড়তে থাকে। গেইট খোলা হলে সমারী, খুশীরায় ও মিন্টু বাইরে চলে যান। এর মধ্যে সৈকত দেওয়ান ও কালাবাবুকে টেলিফোন করতে দেখা যায় এবং সেখান থেকে এসে সঞ্চয়কে কানে কানে কি যেন বলে। কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে সমাধানের কোনো চেষ্টা করা হচ্ছে না দেখে আমি ক্যাজরী মারমাকে বললাম পদত্যাগ করবো ঢাকা মহানগরী সভাপতির পদ থেকে (তৎসময়ে আমি একই সাথে কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক ছিলাম)। ক্যজরী আমাকে ধৈর্য ধরতে বললেন। আমি তার কথায় বেশ কিছু সময় ধৈর্য ধরে ছিলাম। কিন্তু তারপরও সমাধানের যখন কোনো চেষ্টাই নেই বরং যে যার মতো করে ধুমপান করছে তখন আমি একটি পদত্যাগপত্র লিখি। তাতে উল্লেখ করি যে, ঢাকা মহানগর শাখার পক্ষ থেকে সুষ্ঠুভাবে কাউন্সিলররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে। কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির ভুল ব্যাখ্যার কারণে কাউন্সিলে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে ঢাকা মহানগর শাখার নেতৃবৃন্দ কিংবা প্রতিনিধিবৃন্দ কোনো অবস্থাতেই দায়ী হতে পারে না। এত রাতেও (রাত তখন প্রায় ৩টা) কেন্দ্রীয় কমিটি কাউন্সিলের রেজাল্ট দিতে না পারায় ঢাকা মহানগর শাখার পদ থেকে পদত্যাগ করলাম। আমি আমার পদত্যাগপত্রটি তৎকালীন সভাপতি সঞ্চয় চাকমার হাতে দিলে তিনিও একটি পদত্যাগ পত্র লিখেন এবং স্বাক্ষর করার পর ক্যজরীকে দেন। এর পরপরই আরও তিনজন স্বাক্ষর করেন। তৎসময়ে সমারী ও মিন্টু বাইরে ছিলেন। তাদের দুইজনকে ডেকে এনে স্বাক্ষর করতে বলা হলে তারাও স্বাক্ষর করেন। ফলে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ মোট ৭ জন পদত্যাগ করেন (৬ জন সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য)। তাদের পদত্যাগের পরও মৃগাঙ্ক খীসা বার বার অনুরোধ করেন “আপনারা যাবেন না, বসে পড়ুন। পদত্যাগ করা ঠিক হয়নি।” সঞ্চয় বসতে যাচ্ছে এমন সময় চম্পানন ধমক দিয়ে বলে- ‘সঞ্চয়’দা, আমরা পদত্যাগ করেছি কাজেই এখান থেকে চলে যাবো।’ তারপর তারা যখন হল ত্যাগ করছে তখনই ঢাকা মহানগরের কর্মীরা হাততালি দিয়ে তাদের স্বাগত জানায়। এর পর পরই কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি জলিমং মারমা নবনির্বাচিত ঢাকা মহানগর কমিটিকে অনুমোদন দেন। ৭ জন কেন্দ্রীয় নেতার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন সহ-সভাপতি থোয়াই অং মারমা।

(চলবে..)

লেখক: সাবেক সভাপতি, পিসিপি, কেন্দ্রীয় কমিটি

More From Author

+ There are no comments

Add yours