পলাশ খীসা
১৩-১৫ জুন ’৯৪ চট্টগ্রাম ওয়াজিউল্লাহ ইনষ্টিটিউটে ৪র্থ কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে চবি শাখার সাথে কেন্দ্রীয় কমিটির বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। চবি শাখার পক্ষ থেকে প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষকের তালিকা দেয়া হলে কেন্দ্রীয় কমিটি দু’জন পর্যবেক্ষকের নাম পরিবর্তন করে দেয় এবং প্রতিনিধি সুখেশ্বর চাকমা পল্টু, তৎকালীন চবি শাখার সাংগঠনিক সম্পাদককে হলে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। কেন্দ্রীয় কমিটির এই সিদ্ধান্ত চবি শাখা মানতে পারেনি। তারা তাদের দেয়া তালিকা মোতাবেক প্রতিনিধি পর্যবেক্ষক রাখার দাবী জানালে কেন্দ্রীয় কমিটি তা নাখোশ করে দেয়। প্রতিনিধি হিসেবে না নেয়ার কারণ হিসেবে কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে পল্টুকে বলা হয়, সে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে রাঙ্গামাটিতে বিজু উদযাপন করার জন্য যে র্যালীর আয়োজন করা হয়েছে তার প্রচারণার কাজে (মাইকিং) জড়িত ছিল। সে কারণে তাকে প্রতিনিধি করা যাবে না। এ খবর চবিতে ছড়িয়ে পড়লে পরের দিন ১৪ জুন সেখান থেকে ৫০/৬০ জন ছাত্র ওয়াজিউল্লাহ ইনষ্টিটিউটে এসে কেন্দ্রীয় কমিটিকে তাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক পল্টুকে প্রতিনিধি করার জোর দাবী জানায় এবং তা নিয়ে জনৈক কেন্দ্রীয় নেতার সাথে তুমুল বিতর্ক চলে। ফলে একটা উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সে সময় প্রসিত চক্রের পক্ষ থেকে সুক্ষ্মভাবে প্রতিনিধিদেরকে জানিয়ে দেয়া হয় যে, চবি থেকে দালাল প্রতিক্রিয়াশীল কিছু ছাত্র এসেছে, যে কোনো মুহূর্তে মারামারি হতে পারে। ১৪ জুনের শেষ অধিবেশনে রাত প্রায় সাড়ে ৮টায় পল্টুর লিখিত একটি আবেদনপত্র কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে তৎকালীন সভাপতি প্রসিত খীসা পড়ে শোনান। সে লিখেছিল চবি শাখার প্রতিনিধি হয়েও তাকে কেন কেন্দ্রীয় কমিটি কাউন্সিলে ঢুকতে দিল না তার কারণ ব্যাখ্যা করে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থন করার জন্য যেন সুযোগ দেয়া হয়। সেই সময়ে বিভিন্ন শাখার সাংগঠনিক রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা চলছিল। প্রসিত বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করবেন কিনা মতামত জানতে চাইলেন। তিনি এভাবে বলেছিলেন- ‘এখন শাখাসমূহের সাংগঠনিক রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা চলছে এই মুহূর্তে পল্টুর বিষয়টা আলোচনা করা যায় কিনা? তবে কেন্দ্রীয় কমিটি এই মুহূর্তে আলোচনা করার পক্ষপাতি নয়।’
তৎসময়ে সংগঠনের অবস্থা এমন ছিল যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখাগুলো বাদে অন্যান্য শাখাগুলো কেন্দ্রীয় কমিটির মতের বিপক্ষে একটা বাক্যও উচ্চারণ করতে চাইতো না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা থেকে বেশ কয়েকজন আলোচনা করার পক্ষে মত দেন। ব্যক্তিগতভাবে আমিও তখন বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করার পক্ষে ছিলাম। কারণ দ্বিতীয় দিনের শেষ অধিবেশনে যদি বিষয়টা নিষ্পত্তি না হয় তাহলে শেষ দিন (তৃতীয় দিন) পর্যন্ত চবি শাখার একজন প্রতিনিধি কম হবে। তাই আমি বিষয়টা নিষ্পত্তি করে হয় তাকে না হয় অন্য আরেকজন প্রতিনিধি নির্বাচন করার পক্ষে মতামত রেখেছিলাম। যেহেতু সেই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় কমিটি আলোচনার পক্ষে নয় সেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় শাখাসমূহ বাদে সবাই আলোচনার বিপক্ষে। কন্ঠভোটে কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে মত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার সাথে সাথে চবি শাখার নেতৃবৃন্দসহ ঢাকা ও রাজশাহী বেশীর ভাগ নেতৃবৃন্দ হল থেকে বের হয়ে যায় এবং সেই সময় দরজায় একটা বড় শব্দ হয়। ঠিক তখনই হলের ভিতর থেকে প্রসিত চক্রের কিছু উচ্ছৃংখল কর্মী উত্তেজিত হয়ে ‘ধর ধর’ বলে চিৎকার করে উঠে এবং চেয়ার হাতে দরজার দিকে যেতে চেষ্টা করে। বেশীর ভাগ প্রতিনিধি পর্যবেক্ষক নিজ আসনে বসেছিল। ফলে উচ্ছৃংখল কর্মীদের পক্ষে দরজার বাইরে গিয়ে মারামারি করা সম্ভব হয়নি। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ছাত্র রাজনীতি আর করবো না। কারণ আমরা যারা প্রতিনিধি পর্যবেক্ষক হয়ে হলে ছিলাম তারা সবাই বিভিন্ন শাখার নেতৃস্থানীয়। যারা ‘ধর ধর’ বলছে তারা সংগঠনের কোনো না কোনো শাখার নেতা এবং যাদেরকে ধরতে বলছে তারাও কোনো না কোনো শাখার নেতা। আমরা যদি নিজেরা ‘ধর ধর, মার মার’ করি, তাহলে জাতির ভবিষ্যৎ কী হবে? এসব ভেবে সংগঠনের পদ থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু সেই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না কার কাছে পদত্যাগপত্র দেবো- ঢাকার মহানগর শাখা নাকি কেন্দ্রীয় কমিটির বরাবরে। সেটা জানার জন্য একজন স্বেচ্ছাসেবককে তৎকালীন সভাপতি প্রসিত খীসার কাছে পাঠালাম। উত্তরে তিনি জানালেন, আমাকে কেউ কিছু করবে না, আমি যেন হল ত্যাগ না করি। এ তথ্য পেয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি এবং ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি/সাধারণ সম্পাদকের বরাবরে দু’টি পদত্যাগ পত্র দিয়ে সেদিন রাতে ঢাকায় চলে গেলাম। পল্টুর বিষয়টা অমীমাংসিত রেখে কাউন্সিল সমাপ্ত হয়।
সদ্য বিদায় নেয়া সভাপতি প্রসিত খীসা ও নব নির্বাচিত সভাপতি কে এস মং মারমার নেতৃত্বে কাউন্সিল শেষ হওয়ার পরপরই একটা টীম চবিতে যায়। সেখানে কর্মী সভা করার চেষ্টা করলে সফরকারী কেন্দ্রীয় টীমকে অপদস্থ হয়ে ফিরে আসতে হয়। কাউন্সিলের ঘটনা এবং চবিতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অপদস্থ হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দীঘিনালার বাবুছড়ায় তৎকালীন চবি শাখার সহ সভাপতি রিপন চাকমাকে (বর্তমানে ফ্রান্সে) মারধর করা হয়। তার জের ধরে প্রসিতের অনুসারী চবি ছাত্র জ্ঞান জ্যোতি চাকমাসহ দু’জনকে মারধর করা হয় ক্যাম্পাসে। এরপর ২০ মে ’৯৫ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আলোচনা সভা চলাকালীন সময়ে খাগড়াছড়ির খেজুর বাগান মাঠে চবি শাখার প্রতিনিধি (গ্রামের বাড়ী বাঘাইছড়ি) রাজীব চাকমাকে (বর্তমানে প্রভাষক, দীঘিনালা কলেজ) মারধর করে মারাত্মকভাবে আহত করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ছাত্র দীলিপ চাকমা ও চবি ছাত্র রমেশ দেওয়ানের নেতৃত্বে স্কুল-কলেজে পড়ুয়া বাঘাইছড়ি শাখার ছাত্ররা রাজীবকে মারধর করে। তাদের কাছ থেকে রাজীব চাকমাকে জামিন নেয় তৎকালীন খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা। রাতে আমি আমার বড় বোনের বাসায় মধুপুরে ছিলাম। সকালে চবির ছাত্রনেতা সুগতদর্শী চাকমা (বর্তমান প্রভাষক, দীঘিনালা কলেজ) আমাকে ডাকতে যায়। সে বলল রাজীবকে বাঘাইছড়ির ছাত্ররা নিয়ে যাবে এবং নিয়ে গেলে তাকে মেরে ফেলবে। মনটা খুবই খারাপ হলো, রাজীব আমার বন্ধু। একই ব্যাচে চবিতে ভর্তি হয়েছি। মানুষ হিসেবে রাজীবকে খারাপ বলার কোনো যুক্তি নেই। সুগতদর্শী কথাটা বলার সাথে সাথে আমি তৈরী হয়ে তার সাথে যাত্রা করলাম। উদ্দেশ্য যেভাবে হোক রাজীবকে নিতে না দেয়া। প্রথমে গেলাম উন্নয়ন বোর্ডের কোয়ার্টারে এমং চাকের কাছে। এমংসহ চলে গেলাম খবংপয্যায় যেখান থেকে রাজীবকে নিয়ে যাবে। সেখানে গিয়ে দেখা হয় উজ্জ্বল স্মৃতির সাথে। উজ্জ্বল স্মৃতিও বন্ধু মানুষ। তাকে জিজ্ঞেস করলাম রাজীব কোথায়? সে বলল রাজীব রাতে পালিয়ে গেছে (মনে মনে বললাম ভালো হয়েছে প্রাণে বেঁচে গেছে)। বাঘাইছড়ির ছাত্ররা নাকি উজ্জ্বলকে চোখ রাঙিয়ে চলে গেছে রাজীবকে না পেয়ে। তাকে বললাম যারা চোখ রাঙিয়ে গেল তারা কারা, আর তুমিই বা কে? বাঘাইছড়ির থানা শাখার কর্মী হয়ে যদি খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদককে চোখ রাঙিয়ে যেতে পারে তাহলে তুমি কী নেতা হলে? তোমার জেলার সাধারণ সম্পাদকের পদটা চেঙ্গী নদীর ওপারে ফেলে দাও। এসব বিষয়ে তার সাথে বেশ কিছু আলোচনা করে আমরা চলে গেলাম মধুপুরে।
দীর্ঘদিন খাগড়াছড়িতে ছিলাম, ৪ জুন ঢাকায় গিয়ে শুনি পরিস্থিতি অনেক দূর চলে গেছে। এরমধ্যে ৩০ মে ’৯৫ সন্ধ্যায় জাবি ছাত্র দীলিপকে রাজীবের বন্ধুরা (আমারও বন্ধু) জাবি ক্যাম্পাসে মারধর করেছে। তার মাথা ফেটে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তার এক শিক্ষক সেই মুহূর্তে সেখানে না পৌঁছলে তার অবস্থা আরো খারাপ হতে পারতো। বন্ধুরা এত ক্ষিপ্ত হওয়ার পেছনে কারণ হলো রাজীবের মারাত্মক আহত হওয়া। এমনভাবে রাজীবকে মারধর করা হয়েছে কয়েকদিন পর্যন্ত তাকে বিছানা থেকে ধরে তুলতে নামাতে হয়েছে। শরীরের কয়েক জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে ছিল। সুস্থ হতে পারবে কি পারবে না নিশ্চয়তা ছিল না। রাজীবের সৌভাগ্য বলতে হবে সে সুস্থ হয়ে এখন দীঘিনালা কলেজে অংক বিষয়ে পড়ায়।
পরে খবর নিয়ে জানা যায়, রাজীবকে মারার পেছনে অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি কারণ ছিল উল্লেখযোগ্য। ’৯৪ এর বিজু বর্জনের পর চবি’র ক্যাফেটোরিয়ায় বিজু-উত্তর পর্যালোচনা সভা করা হয়। সেখানে কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে সঞ্চয় চাকমা উপস্থিত ছিলেন। সেই পর্যালোচনা সভায় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে উদ্দেশ্য করে রাজীব বলেছিল যে, প্রকৃত দালাল ও সুবিধাবাদীদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে নেতাদের ভুল দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। প্রসিতের বাবা একজন প্রকৃত দালাল ও সুবিধাবাদী হয়েও তাকে সেভাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে না। কারণ প্রসিতের বাবা হলেন ’৮৯ সালের ৯ দফায় স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে তিন নম্বর ব্যক্তি। সেই সুবাদে তিনি আর্মীদের কাছ থেকে অনেক সুবিধা নিয়েছেন। খাগড়াছড়ি বাজারের অনেক প্লট নিজের নামে করেছেন। তা ছাড়া আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে যেটা বিরোধিতা করি সেই চাকমা উন্নয়ন সংসদ গঠন করে এবং সভাপতির পদ গ্রহণ করে আর্মীদের দালালীপনা করেছেন। কারণ এসব সংগঠন সরকারের ‘ভাগ করো শাসন করো’ নীতির অংশ হিসেবে সেনাবাহিনী গঠন করে দেয়।
ঘটনার পরের দিন ২১ মে রমেশ দেওয়ানের নেতৃত্বে খবংপয্যার অনিল চাকমার বাড়ীতে (যে বাড়ীতে রাজীব ছিল) তল্লাসী চালায় এবং অশোভন আচরণ করে। ঘটনার ২/৩ দিন পর রাজীবের বাবা-মার কাছ থেকে লিখিতভাবে অঙ্গীকার নেয়া হয় যে, তিন দিনের মধ্যে রাজীবকে প্রসিত চক্রের হাতে হস্তান্তর করতে হবে। অন্যথায় রাজীবের বাবার স্থাবর অস্থাবর সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। তিনদিন পর রাজীবের বাবা বলেন যে তার পক্ষে রাজীবকে হাজির করে দেয়া সম্ভব নয়। কারণ রাজীব বর্তমানে তার অবাধ্য। তখন রাজীবের বাবার কাছ থেকে অঙ্গীকার নেয়া হয় যে, আমার ছেলে দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে কাজ করছে। কাজেই তাকে যেখানে পাওয়া যাবে সেখানে হত্যা করলে আমার কোনো আপত্তি বা দাবী দাওয়া নেই। একই মাসে তৎকালীন চবি ছাত্র বিতাংশু চাকমা (বর্তমানে প্রভাষক, দীঘিনালা কলেজ) সন্ধ্যায় মিলনপুর বেড়াতে গেলে প্রিয় সম্পদ চাকমার নেতৃত্বে ঘেরাও করা হয়। বিতাংশু চাকমা খাগড়াছড়ির স্থানীয় ছেলে হওয়ায় তিনিও পাল্টা হুমকি দেন। ফলে প্রিয় সম্পদরা ভয়ে পালিয়ে যায়। এরপর আরেকবার রাতে বিতাংশুকে বাড়ীতে ঘেরাও করে প্রসিত চক্র। সে সময়ে সে বাড়ীতে ছিল না।
এসব ঘটনার পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়–য়া ছাত্রদের একটা তালিকা তৈরী করে প্রসিত চক্র। প্রত্যেকটি থানা শাখায় পাঠিয়ে দেয়া হয় সে তালিকা এবং নির্দেশ দেয়া হয় যে সংশ্লিষ্ট শাখা যেন তালিকাভুক্ত পরিবারে হুমকি দিয়ে আসে। তাছাড়াও এসব ছাত্রদেরকে গ্রামে গেলে যাতে বিনা আঘাতে ছেড়ে দেয়া না হয় তার নির্দেশ দেয়া হয়। এই নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথে আমার গ্রামের বাড়ীতে হুমকি দেয়া হয়েছে ২৩ জুন’৯৫। হুমকি দেয়া হয়েছে বঙ্গরতœ চাকমা (বর্তমানে লেদার ইঞ্জিনিয়ার), বিপ্লবসহ ১০/১২ জনের বাড়ীতে।
এরমধ্যে মনোৎপল চাকমা (বর্তমানে প্রভাষক, মহালছড়ি কলেজ) জন্ডিসে আক্রান্ত হলে চিকিৎসার জন্য গ্রামের বাড়ী পানছড়িতে যায়। যাওয়ার ২/১ দিন পর খাগড়াছড়ি থেকে প্রসিত চক্রের দুই ট্যাক্সি সন্ত্রাসী পানছড়ি পিসিপি অফিসে (পানছড়ি বাজারের ক্লাব) যায়। সেখান থেকে এক সন্ত্রাসী পানছড়ির এক ছাত্রকে নিয়ে মনোৎপলের বাড়ীতে গিয়ে তাকে বলে যে, বড় ভাইয়েরা তাকে ক্লাবে যেতে বলেছে। মনোৎপল জানায় সে জন্ডিসে আক্রান্ত। প্রয়োজন থাকলে তাদের বাড়ীতে গিয়ে কথা বলার জন্য। এরপরই তারা ক্লাবে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হয়ে যায় এবং অর্ধেক রাস্তা থেকে পানছড়ির ছেলেটা মনোৎপলের বাড়ীতে ফিরে এসে তাকে বলে যে, খাগড়াছড়ি থেকে ১০ জন ছাত্র এসেছে আপনাকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাদের গতিবিধি খুব বেশী ভাল নয়। বরং আপনি অন্যত্র চলে যান। ছেলেরা ক্লাবে ফিরে যাওয়ার পর বাকিরা ক্ষিপ্ত হয়ে যায় এবং মনোৎপলের বাড়ী ঘেরাও করে। ঘেরাও করার আগেই মনোৎপল অন্যত্র চলে যায়। মনোৎপলকে না পেয়ে উচ্ছৃংখল ছেলেরা তার বাবা মাকে নির্দেশ দিয়ে আসে যে, পরের দিন বেলা ১টার মধ্যে খাগড়াছড়ির ‘হোয়াং বই-ও বা’তে যেন মনোৎপলকে হাজির করে দেয়া হয়। মনোৎপল বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। ফলে মনোৎপলকে পানছড়ি থেকে পায়ে হেঁটে ফেনী-তবলছড়ি হয়ে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয় তার মা-বাবা এবং মনোৎপলকে ছাড়া তার মা ও তার ভগ্নিপতি দুপুর ১২টায় ‘হোয়াং বই-ও বা’তে হাজির হয়। তাদেরকে সেখানে এক চেয়ারে ১০ ঘন্টা (রাত ১০টা পর্যন্ত) আটকে রেখে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করা হয়।
এর পরপরই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া সচেতন ছাত্র সমাজ একমত হয় যে, প্রসিত চক্রকে অবশ্যই হটাতে হবে, পদ্ধতিগতভাবে সংগঠন থেকে বের করে দিতে হবে। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক রাজশাহী মহানগর শাখা থেকে প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে প্রসিত চক্রকে হটিয়ে সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন সন্তোষ বিকাশ খীসা (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, নানিয়ারচর কলেজ)।
২৩ জুন ’৯৫ ঢাকা মহানগর শাখার কাউন্সিল জগন্নাথ হলের দক্ষিণ বাড়ীর টিভি কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলের একদিন আগে জগন্নাথ হলের পূর্ব বাড়ীর ছাদে ঢাকাস্থ বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিকেলে পড়া ছাত্রছাত্রী প্রতিনিধিদের নিয়ে এক বিরাট মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। সেই মিটিংয়ে প্রসিত চক্র জাতীয় মুক্তির বিপক্ষে কাজ করে চলেছে বলে মত প্রকাশ করা হয়। কাজেই তাদেরকে সংগঠনের কোনো প্রকার পদ দেয়া যাবে না। কাউন্সিলের দিনে বড় ধরনের অনাকাংখিত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। বাসাবো এলাকা থেকে আগত ৪০/৪৫জন ছাত্রকে কাউন্সিলর করা হয়নি, তারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না। অপরদিকে একই এলাকা থেকে আসা প্রসিতের অনুসারীদের কাউন্সিলর করা হয়েছে। এ বিষয়টা নিয়ে হলের বাইরে তৎকালীন কেন্দ্রীয় নেতা দেবাশীষ চাকমার (বর্তমানে আমেরিকায়) সাথে বাসাবো এলাকার ছাত্র নেতা জিকো চাকমার (বর্তমানে প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার) তর্কাতর্কি ও হাতাহাতি হয়। এক পর্যায়ে দেবাশীষ চাকমা আনারস বিক্রেতার চাকু দিয়ে জিকোকে আঘাত করতে চেষ্টা করলে জিকো তা ধরে ফেলে। ফলে তার হাতের কয়েকটা আঙ্গুল কিছুটা কেটে যায়। এক পর্যায়ে দেবাশীষ জগন্নাথ হলের মাস্তানদের দিয়ে জিকোকে হলের দক্ষিণ বাড়ীতে ধরে নিয়ে যায়। একটা রুমে আটকে রেখে তাকে মারধর করা হয়, তার গলার চেইন, পরনের গেঞ্জী ও মানিব্যাগ কেড়ে নেয় মাস্তানরা। খবর পেয়ে ছাত্ররা তাকে উদ্ধার করতে যায়। তারা রুমের কাছাকাছি পৌঁছলে মাস্তানরা তাকে ছেড়ে দেয়। বাসাবো এলাকার ছাত্ররা বাদেও প্রায় ৩০০-এর মতো প্রতিনিধি তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। প্রসিতের পক্ষে মংসানু মারমা (বর্তমানে আমেরিকায়) সভাপতি প্রস্তাব করা হলে প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে পলাশ খীসাকে সভাপতি পদে প্রস্তাব করা হয়। এভাবে ২১টি পদের মধ্যে ১৭টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। পলাশ খীসার নেতৃত্বে প্রসিত বিরোধী প্যানেল বিপুল ভোটে জয়যুক্ত হলে বিজয়ী কমিটিকে শপথবাক্য পাঠ করান তৎকালীন সভাপতি কে এস মং মারমা।
ঢাকা মহানগর শাখার কাউন্সিলের পরপরই সমীরণ চাকমা সচিব চাকমাকে একটি চিঠির মাধ্যমে জানায়, কে এস মং এর বিশ্বাসঘাতকতা ও সঞ্চয়ের নির্লিপ্ততার কারণে ঢাকা মহানগর শাখা হাত ছাড়া হয়ে গেছে। ঢাকা এবং রাজশাহীতে পূর্ণ প্যানেলে প্রসিত চক্র হেরে যাওয়ায় তারা ভোটে যেতে চায় না। সে কারণে চবি শাখার কাউন্সিল সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলেও কেন্দ্রীয় কমিটি তা গ্রহণ করে না। ফলে কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে চবি শাখার সাথে কেন্দ্রীয় কমিটির বেশ কয়েকবার আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বাক-বিতন্ডা হয়।
একদিকে সচেতন ছাত্র সমাজের অব্যাহত প্রচেষ্টা ও অন্যদিকে ১৫ জুন ’৯৫ দুদুকছড়ায় এক প্রকাশ্য জন সমাবেশে জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রসিত বিরোধী আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। তিনি বলেন ‘হঠকারী কর্মকান্ড বন্ধ করতে হবে। রিক্সার পাম্প ছেড়ে, গুলতি মেরে, সামাজিক বিশৃংখলা সৃষ্টি করে জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।’ লিডারের এই ঐতিহাসিক বক্তব্য এবং একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখাসমূহ হাত ছাড়া হওয়ায় প্রসিত চক্র বুঝতে পারে তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে এবং সেই প্রতিক্রিয়া (প্রসিত বিরোধী জনমত) ছড়িয়ে যাচ্ছে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে। ফলে তাদের নিয়ন্ত্রিত শাখা দিয়ে বিরোধী শক্তিকে দমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে প্রসিত চক্র। নানিয়ারচর শাখার তৎকালীন সভাপতি জ্যোতি লাল চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ১৮ জুলাই ’৯৫ এক সভা থেকে তৎকালীন রাজশাহী মহানগর শাখার সভাপতি সন্তোষ বিকাশ খীসা, চবি শাখার অর্থ সম্পাদক সমর বিজয় চাকমা (বর্তমানে টাস্ক ফোর্স একাউন্টেন্ট, ব্রাক), রাজশাহী মহানগর শাখার সদস্য তোষণ চাকমা (বর্তমানে আইনজীবী) ও তৎকালীন নানিয়ারচর শাখার দপ্তর সম্পাদক সতীশ চন্দ্র চাকমাকে (৬ নভেম্বর ২০০০ চুক্তি বিরোধী সন্ত্রাসীরা অপহরণ করে নিয়ে হত্যা করে) মারধর করা হয়।
বর্মাছড়ি বাজারে একটি সমাবেশ আহ্বান করা হয় ৬ অক্টোবর ’৯৫। বর্মাছড়ির নেতৃবৃন্দ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে কে কে যেতে পারবেন জানার জন্য ঢাকায় যান। সে সময় কেন্দ্রীয় দপ্তরে কেন্দ্রীয় কমিটির দীপ্তি শংকর চাকমা বাদে কেউ ছিল না। তিনি আমাকে ডেকে পাঠান। আমি কেন্দ্রীয় দপ্তরে গেলে বর্মাছড়ির নেতৃবৃন্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন এবং অনুরোধ করেন ৬ অক্টোবরের বর্মাছড়ির সমাবেশে আমি যাতে অংশগ্রহণ করি। আমার ৫ তারিখ একটি পরীক্ষা ছিল। তারপরও দীপ্তি শংকর ও বর্মাছড়ির নেতৃবৃন্দের অনুরোধে রাজী হয়ে বললাম আমরা দু’জন যাবো। কিভাবে যেতে হবে তা জেনে নিলাম। ৫ অক্টোবর পরীক্ষা শেষ করে জিতেন চাকমা (তৎকালীন ঢাকা মহানগরের সহ সাধারণ সম্পাদক) ও আমি বর্মাছড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। আমরা যখন চবির হাসান অতিথি ভবনে পৌঁছলাম তখন রাত ১১টা ১৫ মিনিট। সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল। রাত যতই গভীর হচ্ছে ততই বৃষ্টির মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। খুব ভোরে আমরা যখন যাওয়ার জন্য প্রস্তুত তখনও বৃষ্টি থামেনি। তারপরও করার কিছু নেই, নির্ধারিত প্রোগ্রাম- কোনো অবস্থায় বাদ দেয়া যাবে না। তাই বৃষ্টি হলেও আমরা যেতে শুরু করি। চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি বাসে উঠে নাজিরহাট ঝুমুর সিনেমা হলে নেমে সেখান থেকে বেবী ট্যাক্সীতে নানুপুর চলে গেলাম। নানুপুরে প্রায় দু’ঘন্টা অপেক্ষা করার পর একটা জীপে (চাঁদের গাড়ী) করে খিরাম পর্যন্ত গেলাম। রাস্তাগুলো এতই খারাপ যে মাঝে মধ্যে নামতে হতো। খিরাম থেকে হেঁটে বর্মাছড়ি বাজার যেতে হবে (প্রায় এক ঘন্টার রাস্তা)। হাঁটতে হাঁটতে এক পর্যায়ে মাইকের আওয়াজ শোনা গেল। ঘোষক বলছে কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের সমাবেশ শুরু হবে, আমাদের মাঝে উপস্থিত রয়েছেন কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ সম্পাদক নিকোলাস চাকমা, ঢাকা মহানগর শাখার প্রাক্তন অর্থ সম্পাদক চম্পানন চাকমা, ঢাবি ছাত্র মিল্টন চাকমা, আরও উপস্থিত থাকবেন চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি ইত্যাদি ইত্যাদি….। কিন্তু আমরা যে যাবো তা ঘোষক বলছে না। আমরা বলাবলি করছি নিকোলাস কোনো না কোনোভাবে সমস্যা সৃষ্টি করে রেখেছে। তা না হলে আমাদের নাম তো ঘোষকের হাতে থাকার কথা। তখন প্রায় ১টা বাজে আমরা সমাবেশ স্থলে পৌঁছি। সেখানে গিয়ে আমাদের ধারণা সত্যে পরিণত হলো। আমাদের সাথে কেউ কথা বলছে না, কেউ সৌজন্যতাও দেখালো না। যারা বার বার অনুরোধ করেছে (ঢাকায়) সমাবেশে আসার জন্য তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের কাছাকাছি। কিন্তু দেখেও না দেখার ভান করছে। যেখানে সমাবেশ হবে তার দক্ষিণ পূর্ব সাইডে গাছের ছায়ায় কিছু লোক (দেখে নেতা মনে হলো) দাঁড়িয়ে কথা বলছে। আমরা সেখানে গেলাম, হাত বাড়িয়ে আমাদের পরিচয় দিলাম। তারাও খুশী হয়ে তাদের পরিচয় দিলো। একজন কাউখালী থানা শাখার সহ সভাপতি প্রদীপ চাকমা। তিনি খুবই আন্তরিকতা নিয়ে আমাদের সাথে আলাপ করলেন। তাদের শাখার সাথে গাছ ব্যবসায়ীদের একটা সমস্যার কথা বললেন এবং আমরা যাতে কেন্দ্রীয় কমিটির নিকোলাসসহ গিয়ে সমাধা করে দিয়ে আসি তারও অনুরোধ জানালেন। আমরা বললাম ঠিক আছে নিকোলাসের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। আমরা জানতাম নিকোলাস কোনোদিন আমাদের নিতে চাইবে না। কারণ আমরা গেলে তার দুর্বলতাগুলো ধরা পড়বে। এক পর্যায়ে নিকোলাস এসে বলল এন্ট্রি করেছি কিনা? তার কথায় আমরা আমাদের নাম ও পদবীসহ জমা দিলাম। জমা দেয়ার পর একবার আমাদের নাম মাইকে ঘোষণা করা হলো। এরপর মিছিল শুরু হলো। আমরাও মিছিলে যোগ দিলাম। মিছিলের পর সবাই (প্রদীপ বাদে) মঞ্চে উঠে গেল, আমাদের কেউ ডাকলো না। আমি প্রদীপকে বললাম চল আমরাও মঞ্চে যায়। মঞ্চে গিয়ে বক্তব্য শুরু হলো। মিল্টন, চম্পাননসহ সবাই বক্তব্য রাখলো কিন্তু ঢাকা মহানগরের সহ সাধারণ সম্পাদক হয়েও জিতেন চাকমাকে বক্তব্য দিতে দেয়া হলো না।
আমার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর জিতেন বলল- প্রতিবাদ করি। আমি বললাম এখানে নয়, ঢাকায় গিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে লিখিত আকারে জানাবো। এমন সময় আমাকে একজন জিজ্ঞাসা করলেন ভাত খেয়েছি কিনা? তাকে বললাম ভোরে চবিতে নাস্তা করেছি, খুব বেশী খিদে নেই (যদিও ২/৩ ঘন্টা আগে থেকে খিদে শুরু হয়ে গ্যাষ্টিকের অসহ্য যন্ত্রণায় ভিতরে ভিতরে জ্বলে যাচ্ছি)। সমাবেশের পরে ভাত খেয়ে এসে শুনি প্রদীপবাবুর কথাবার্তায় অসংলগ্নতা। তিনি বলেন, নিকোলাস’দা আজ আমাদের কাউখালী পৌঁছতে অনেক রাত হবে, রাস্তাগুলো খারাপ, সরু পথে যেতে হবে, পথে জোকের উপদ্রব বেশী। নিকোলাস বলল দেশ-জাতের স্বার্থে সবকিছু করতে হবে। কথাগুলো আমাদের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে এটা স্পষ্ট বুঝা যায়। নিকোলাস আমাদের বলল তোমরা থাকবে নাকি চলে যাবে? আমি বললাম যাওয়ার মতো অবস্থা থাকলে চলে যেতাম। রাস্তায় গাড়ী পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই, পথে কোনো পাহাড়ী ঘর বা গ্রামও নেই যে অর্ধেক রাস্তায় থাকা যাবে। তাই এখানেই থাকতে হবে। হাজার হোক এই পাহাড়ীরা তো বাঙালীদের চাইতে খারাপ হবে না। এরপর সবাই হাটা শুরু করলাম। বর্মাছড়ি বাজার থেকে যেতে প্রথম যে পাহাড়ী গ্রামটা ছিল সে গ্রামে রবি চেয়ারম্যানের বাসায় আমাদেরকে নিয়ে যাবার জন্য একজন ছাত্রকে দায়িত্ব দেয়া হলো। সে একমাত্র ছেলে যে সেই গ্রাম থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে বা দেবে। ছেলেটাকে বলা হলো সে যেন নিকোলাসদের জুতাগুলো নিয়ে যায়। আমাদেরকে যে বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সে বাড়ীতে নিকোলাসরা তার আগের রাতে ছিল এবং জুতাগুলো রেখে গিয়েছিল। রাতে ছেলেটাকে বেড়াতে আসার জন্য বলেছিলাম। রাতে তার সাথে কথার এক পর্যায়ে জিজ্ঞাসা করলাম, সে জুতাগুলো কখন দিয়ে আসবে, কারণ তারা সেদিন রাতে চলে যাবার কথা বলেছিল। ছেলেটি বলল, আগামীকাল সকাল ১০টায় একটা কর্মী সভা আছে, তখন নিয়ে যাবো। এরপর সে জানতে চাইলো আমরা যাবো কিনা কর্মী সভায়? আমরা যা বুঝার বুঝেই তাকে বললাম আমাদের কিছু কাজ আছে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। সকালে এখান থেকে ঢাকায় চলে যাবো। আমরা যাতে কর্মী সভায় থাকতে না পারি সে কারণে নিকোলাসরা আমাদেরকে মিথ্যে বলেছিল যে তারা রাতে কাউখালী চলে যাবে।
ঢাকায় ফিরে আমি টিএসসি’র দিকে যাওয়ার পথে জগন্নাথ হলের উত্তর গেইটে বড় ভাই প্রবীন খীসা তাতু (পিসিপির দলীয় পতাকার ডিজাইনার এবং বর্তমানে ইঞ্জিনিয়ার), বাঞ্ছানিধি খীসা, দীপেন চাকমা (উন্নয়ন বোর্ডের কর্মরত)সহ দু’এক জনের সাথে দেখা হয়। আমার সাথে কথা আছে বলে তারা আমাকে জগন্নাথ হলের মাঠের দোকানগুলোতে নিয়ে আসে। টেনিস মাঠের উত্তর দিকে বসে চা খাচ্ছিলাম, সূর্য ডুবে গেছে, সন্ধ্যা হয়েছে। ঠিক সেই সময় টেনিস মাঠের দক্ষিণ সাইডে গাছের নীচে মারামারি হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি না কাকে কে মারছে। কারণ হলে সেই সময়ে ছাত্র লীগের দু’টো গ্রুপের মধ্যে প্রায় মারামারি হতো। একজনকে মারতে মারতে মাঠের মাঝখানে নিয়ে এসেছে। যে মার খাচ্ছে সে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছে। আমি উঠে গেলাম। মাঠে নাস্তা খাওয়া ছাত্ররাও উঠে বাঁচাতে গেলো। ফলে যারা মারছে তারা দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়। গিয়ে দেখি সে ছাত্রলীগের কেউ নয়, আমাদের পাহাড়ী ছেলে চম্পানন চাকমা। আমরা যেখানে বসেছিলাম তাকে সেখানে নিয়ে আসলাম। মুখের কয়েকটা জায়গায় ফুলে গেছে। কে মেরেছে জিজ্ঞাসা করলে সে নাম জানে না বলল, তবে চেহারা চেনে। ট্রাইবেল হোষ্টেলে থাকে ছেলেগুলো। তাকে কেমন আছেন বলে হ্যান্ডসেক করার পর আমাদের সিটগুলো হারিয়েছি তোমাকেও ছাড়বো না বলে তাকে মারতে শুরু করল। চম্পাননকে নিয়ে হলের রুমে রুমে এবং আশেপাশে ছেলেগুলোকে খুঁজলাম। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না। তাকে নিয়ে নীলক্ষেতে ডাক্তারের কাছে গেলাম। হলে এসে দেখি চোখের পাশে বড় করে ফুলে যাচ্ছে। খুব কষ্ট পাচ্ছে সে। তখন আমাদের তৎকালীন ঢাকা মহানগর শাখার সহ সভাপতি বঙ্গরতœ চাকমা তাকে নিয়ে আবারও ডাক্তারের কাছে যায়। পরে জানলাম চম্পাননকে যারা মেরেছে তারা পাহাড়ী হোষ্টেলের ছাত্র ছিল এবং চম্পাননের কারণে তারা তাদের সিটগুলো হারিয়েছে। ফলে প্রতিশোধ হিসেবে চম্পাননকে মেরেছে তারা। কোনো রাজনৈতিক কারণ সেখানে ছিল না। রাতে জরুরী ভিত্তিতে ঢাকা মহানগর শাখার সভা আহ্বান করলাম। মিটিংয়ে বর্মাছড়িতে মহানগর নেতৃবৃন্দকে অবমাননা করা, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক নিকোলাস চাকমার অসৌজন্যমূলক আচরণ ও মিথ্যা কথা বলা এসব বিষয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির বরাবরে লিখিতভাবে জানানোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু জানানোর পরেও তার কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি।
(চলবে)
লেখক: সাবেক সভাপতি, পিসিপি, কেন্দ্রীয় কমিটি