পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী ছাত্র রাজনীতিতে প্রসিত চক্র (১ম অংশ)

পলাশ খীসা

হঠাৎ সেদিন ২২ সেপ্টেম্বর ২০০১ জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোর একটি খবর চমকে দিল আমাদের। আমাদের কলেজ জীবনের বন্ধু রূপক আর পৃথিবীতে নেই। খুব কাছ থেকে গুলি করে গতকাল তাকে হত্যা করা হয়েছে। চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ নেতা প্রসিত বিকাশ খীসার নির্বাচনী প্রচার কাজ করতে গিয়ে তাকে জীবন দিতে হলো। সমবেদনা, সহমর্মিতা জানাই তার বাবা-মা পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদের। নীতি-নৈতিকতায় আচার ব্যবহারে রূপক ছিল একজন চমৎকার মানুষ। তবে সে ছিল প্রসিতের অন্ধ ভক্ত। তাদের দু’জনের বাড়ী ছিল পাশাপাশি, খাগড়াছড়ির পূর্ব নারানখাইয়ায়। রূপক আমার কলেজ জীবনের ঘনিষ্ট বন্ধুদের একজন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে সে ছিল বিজ্ঞান বিভাগে, আমি মানবিকে। থাকতাম নিউ হোষ্টেলে। দুই বছর কাছাকাছি থেকেছি, বহু জায়গায় এক সাথে ঘুরেছি, তাদের বাড়ীতে খেয়েছি, থেকেছি নিজের বাড়ীর মতো। রাজনীতি থেকে শুরু করে সমস্ত বিষয়ে আলোচনা করেছি। তার কাছ থেকে প্রতিনিয়ত শুনেছি প্রসিতের প্রশংসা, বিভিন্ন সময়ে দেয়া কুবুদ্ধি বা পরামর্শ, খাগড়াছড়ি স্কুলে পড়াকালীন সময়ের নানান ঘটনার কথা। দুটো ঘটনার কথা বলি-

এক.

খাগড়াছড়িতে তৎসময়ে ‘আলম সীল’ নামে ফুটবল প্রতিযোগিতা চলতো। যোগ্যতা হলো স্কুলের পড়ুয়া ৪ ফুট ৯ ইঞ্চি লম্বা ছাত্র। নারানখাইয়া গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ করতো রূপকরাও। তাদের ওস্তাদ বা পরামর্শ দাতা ছিলেন প্রসিত। কিভাবে গোল দিতে হয় তা না শিখিয়ে তিনি শিখাতেন কিভাবে ল্যাং মারতে হয়।

দুই.

তৎসময়ে বাইরে থেকে কোনো বাঙালী ছেলে পাড়ার পাশ দিয়ে খাগড়াছড়ি-পানছড়ি রাস্তায় আসতে দিতে চাইতেন না প্রসিত। কিন্তু তারপরও দু’একজন মাঝে মধ্যে বেড়াতে যেতো। প্রসিতের পরামর্শে তাদেরকে মারতো রূপকেরা। বিনা কারণে তো কাউকে মারা যায় না, কোনো না কোনো অজুহাত সৃষ্টি করতে হয়। তাই বুদ্ধি দিতেন প্রসিত এভাবে – প্রথমে হাঁটার সময় একজন ধাক্কা মারতো, যখনি বাঙালী ছেলেটা প্রতিবাদ করবে তখনি চলতো উত্তম-মধ্যম। তাতেও কাজ না হলে বাঙালী ছেলেটাকে বলা হতো ‘ঐদিন আঙারে কি কয়স’? (ঐদিন আমাকে কী বলেছ?)। তার জবাব যাই হোক না কেন তাকে মারধর করা হতো।

উপরোক্ত বিষয়ে আলোচনা করলাম এ কারণে যে, রূপকের মৃত্যু স্বাভাবিক কোনো মৃত্যু নয় এবং এটিই প্রথম মৃত্যু নয়। এর আগেও চুক্তির পক্ষে বিপক্ষে অনেকেই নিহত হয়েছেন। রাজনৈতিক কারণে তার এই করুণ পরিণতি। বিভেদপন্থী প্রসিত-সঞ্চয়ের নেতৃত্বে চুক্তি বিরোধী চক্র সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি অনেক অনেক প্রতিভাবান, সৎ, সাহসী, দেশপ্রেমিক রূপকের মতো অকালে জীবন দিলেন যা ভাবতেও খারাপ লাগে। প্রসিত-সঞ্চয় কে, কেন চুক্তি পক্ষ-বিপক্ষ? কোন কারণে রাজপথে সাহসী লড়াকু সৈনিকেরা আজ দ্বিধাবিভক্ত এবং পরস্পরকে হত্যা করছে, এ বিষয়ে অনেক দিন ধরে লিখবো লিখবো করেও লেখা হয়নি। কিছুদিন আগে রাঙ্গামাটির কল্যাণপুরে আঞ্চলিক পরিষদের সম্মানিত চেয়ারম্যান জুম্ম জনগণের প্রিয় নেতা সন্তু লারমার বাসভবনে গিয়ে জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার বিভাগের সম্পাদক শ্রদ্ধেয় মঙ্গল কুমার চাকমা আমাকে অনুরোধ করলেন আমি যেন পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র রাজনীতি প্রসঙ্গে কিছু লিখি। তাই মঙ্গলদার অনুরোধে এবং ব্যক্তিগত জীবনে চুক্তি বিরোধীদের অনেক কাছ থেকে দেখার সুবাদে আমার এ লেখা।

একজনের প্রচেষ্টায় একদিনে যেমনি কোনো সংগঠন গড়ে উঠে না, তেমনি একটি কারণে একদিনে কোনো সংগঠন বিভক্ত হয় না। সঙ্গত কারণে চুক্তির সাথে সাথে চুক্তি বিরোধীদের উৎপত্তি হয়নি। এর পেছনে অনেক ঘটনা ও দীর্ঘ প্রচেষ্টা রয়েছে তাদের। তাই আমার এই লেখা দীর্ঘ হওয়া স্বাভাবিক। ১৯৮৮ সালের শুরুতেই আমি যখন মহালছড়ি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র তখন আমরা স্কুলের ছাত্রদের কিছু দাবীদাওয়া নিয়ে ও প্রধান শিক্ষকের বৈষম্যমুলক আচরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করি। এক পর্যায়ে প্রধান শিক্ষক আমাদের দাবী মেনে নেন। এর পরপরই তৎকালীন চট্টগ্রাম বিশ্বাবিদ্যালয়ের ছাত্র প্রজ্ঞান খীসার সাথে (বর্তমানে মুবাছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান) আমাদের পরিচয় হয়। তিনি প্রায়ই আমাদের সাথে দেখা করে জুম্ম জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে ছাত্র-যুব সমাজের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করতেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি খুবই আকৃষ্ট হতাম তার কথাবার্তায়। ভালো লাগতো, শ্রদ্ধা করতাম, এখনো করি। একদিন খবর এলো বুদ্ধ শিবিরের দুইজন ছেলে মহালছড়ি আসছে, তারা জুম্ম জাতির শত্রু, আমরা যেন রসিদ বইসহ তাদের আটকে রাখি। যথাসময়ে তারা আসলো, আমরা রসিদ বইগুলো জব্দ করে তাদেরকে প্রথম বারের মতো ছেড়ে দিলাম। কলেজে ভর্তি হয়ে বন্ধুবর রূপকের কাছ থেকে বুদ্ধ শিবির সম্পর্কে যা জানলাম তা হলো – চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) কিছু পাহাড়ী ছাত্র বুদ্ধ শিবির করে। এরা ধর্ম ব্যবসায়ী, জুম্ম জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বিপক্ষে, আর্মীর দালাল ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে বুদ্ধ শিবির সম্পর্কে একটি খারাপ ধারণা ও কৌতুহল জন্মালো। সাথে সাথে দেখার, কথা বলার আগ্রহও জন্মালো। আমরা (রূপক ও আমি) সিদ্ধান্ত নিলাম যে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয়ে ভর্তি হবো বুদ্ধ শিবির দমন করার জন্য।

অপরদিকে প্রসিত বিকাশ খীসাসহ কিছু পাহাড়ী ছাত্র জুম্ম জাতির মুক্তির জন্য লড়ছেন। প্রসিতকে ধনদা হিসেবে রূপক সম্বোধন করতো। তার মুখে ধনদার এতই প্রশংসা শুনেছি যে তাকে একনজর দেখা ও কথা বলার জন্য আগ্রহ বাড়তেই থাকলো। একদিন সেই সুযোগ সৃষ্টি হলো। ধনদাসহ তিনজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমাদের নিউ হোষ্টেলে আসলেন অল্প সময়ের জন্য। খুব সম্ভবতঃ ১৯৮৯ সালের শেষের দিকে। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) এর একটি প্রোগ্রামে আমরা যেন অংশগ্রহণ করি সেজন্য তারা এসেছিলেন। পিসিপির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমাদের ভিক্টোরিয়া কলেজসহ কুমিল্লার ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। তখন কুমিল্লার পাহাড়ী ছাত্রদের ‘হিল ষ্টুডেন্ট অর্গানাইজেশন’ নামে একটি সংগঠন ছিল।

উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর ভর্তি হলাম চবিতে। ভর্তি প্রক্রিয়া চলাকালীন সময় আমি খুঁজতে থাকি বুদ্ধ শিবিরের অস্তিত্ব। এ বিষয়ে বেশ ক’জন বড় ভাইয়ের সাথেও আলাপ করি। সবাই একবাক্যে বলেন বুদ্ধ শিবির বলতে চবিতে কোনো সংগঠন নেই। এটা প্রসিতের দেয়া একটি নাম। চবিতে পিসিপি গঠনের আগ পর্যন্ত উপজাতীয় ছাত্র পরিষদ নামে পাহাড়ী ছাত্রছাত্রীদের একটি সংগঠন ছিল। সেই সংগঠন দুটো গ্রুপে বিভক্ত ছিল। একটিতে নেতৃত্ব দিতেন প্রসিত এবং প্রতিপক্ষ গ্রুপের নাম দিতেন বুদ্ধ শিবির। উপজাতীয় ছাত্র পরিষদে নেতৃত্ব নির্ধারণের সময় প্রতি বছর সরাসরি ভোট হতো। সেই ভোটে প্রসিত গ্রুপের বিকোশিতা খীসা (প্রসিতের বোন) ছাড়া অন্য কেউ জিততে পারতো না। আবার সেই সংগঠনের নেতৃত্ব পর্যায়ে কেউ কেউ বুদ্ধ ছাত্র সংসদের সাথে জড়িত ছিল।

পাহাড়ী ছাত্রদের বুদ্ধ ছাত্র সংসদ করার ক্ষেত্রে তৎকালীন ম্যাজিষ্ট্রেট প্রকৃতি রঞ্জন চাকমার প্রভাব ছিল বলে জানা যায়। তার ভাষ্য মতে কিছু সংখ্যক বড়ুয়া ছেলে বুদ্ধ ছাত্র সংসদের নাম দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে প্রতি বছর মোটা অংকের টাকা আত্মসাৎ করে। সেই টাকা যাতে আত্মসাৎ করতে না পারে এবং সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় সেজন্যে প্রকৃতিবাবু কিছু পাহাড়ী ছাত্রকে বুদ্ধ ছাত্র সংসদ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই সুযোগে প্রসিত প্রতিপক্ষ গ্রুপকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার জন্য এদের নাম দেন বুদ্ধ শিবির। চবিতে একমাস যেতে না যেতেই খবর পেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছি। ঢাবিতে ভর্তি হতে গেলে সঞ্চয় চাকমা চবিতে পড়ার পরামর্শ দিলেন। তিনি বলেছিলেন চবিতে নেতৃত্ব পর্যায়ে আমাদের লোক তেমন নেই। তাছাড়া প্রজ্ঞান খীসাও নাকি আমাকে চবিতে রাখতে চায় বলে তিনি জানান। সবশেষে তিনি আমার উপর ছেড়ে দিলেন। তারপরও আমি ঢাবিতে ভর্তি হলাম এবং পিসিপির সাথে যুক্ত হয়ে গেলাম অধিকতর সক্রিয়ভাবে।

ভর্তি হওয়ার বছরই আমাকে পিসিপি ঢাকা মহানগর শাখার কার্যকরী কমিটির সদস্য এবং একই বছরে অর্থ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। এরপর ঢাকা মহানগর শাখার সহ সাধারণ সম্পাদক ও পরের বছর সভাপতির দায়িত্ব পালন করতে হয়। অবিভক্ত পিসিপিতে ’৯৬ এর অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে কেন্দ্রীয় সহ সাধারণ সম্পাদক এবং পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের নামে কিছু নীতিচ্যুত উচ্চাভিলাষী ছাত্র সংগঠন থেকে বের হয়ে যাবার পর সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করতে হয়। পিসিপির সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিই ২৩ মে ২০০০ সালে।

লংগদু হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ২০ মে ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের রশিদ হলে গঠিত হয় বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)। পিসিপি গঠিত হওয়ার আগে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক সংগঠন ছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপজাতীয় ছাত্র পরিষদ, ঢাকায় ট্রাইবেল ষ্টুডেন্ট ইউনিয়ন, রাজশাহীতে হিল ষ্টুডেন্ট ইউনিয়ন, কুমিল্লায় হিল ষ্টুডেন্ট অর্গানাইজেশন ইত্যাদি। ফলে ভিন্ন পথ ও মতের সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হওয়া পিসিপিতে শুরু থেকে মত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে প্রসিত বিকাশ খীসাকে প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে চবি থেকে প্রবল আপত্তি করা হয়। তারপরও ধীরাজ চাকমা বাবলি, বিধানদের অনুরোধে প্রথম কমিটিতে রাখা হয়েছে সদস্য হিসেবে। চবির ছাত্রদের যে অভিযোগ তা হলো প্রসিত যেখানে যাবেন সেখানে গ্রুপিং করবেন। তার চরিত্র হচ্ছে সামন্তীয়। তিনি মনে করেন তার মত কেউ বুঝে না। কাজেই তিনি যা বলবেন তাই হবে সিদ্ধান্ত। চবি ছাত্র সংগঠনকে দ্বিধাবিভক্ত করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা সবচাইতে উল্লেখযোগ্য। চবি ছাত্রদের যে আশংকা ছিল তার প্রতিফলন ঘটাতে প্রসিতের বেশী সময় লাগেনি। খুব দ্রুত তৃতীয় কেন্দ্রীয় কমিটিতে সভপতির পদটি দখল করে নেন গ্রুপিং-এর মাধ্যমে। গ্রুপিং-এর পাশাপাশি শান্তিবাহিনীর নামে বেশ কয়েকজন ছাত্রকে বেনামী চিঠি প্রদানের মাধ্যমে প্রাণনাশের হুমকি দেন, যাতে তারা সংগঠন থেকে সরে যায় এবং প্রসিতকে সভাপতি নির্বাচন করে। ফলে যারা প্রসিতের সমসাময়িক তারা বিতর্কে না গিয়ে নীরবে বেশীর ভাগই ছাত্র সংগঠন ছেড়ে চলে যায়।

সংগঠনের অভ্যন্তরে বড় ধরনের বিতর্ক শুরু হয় ১৯৯৩ সালের ১৭ নভেম্বর নানিয়ারচর গণহত্যার পর। এর আগেও ২০ মে ১৯৯২ রাঙ্গামাটিতে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালনের সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হলে কিছুটা বিতর্ক ও উত্তেজনা দেখা দেয়। বিশেষ করে প্রসিতের এক জঘন্য মন্তব্যকে নিয়ে। তিনি মন্তব্য করেন- ‘রাঙ্গামাটির লোকেরা সবাই সুবিধাবাদী, আপোষকামী, সরকারি দালাল। অনেক ঘর পুড়ে গেছে ভাল হয়েছে। এবার বুঝুক বাঙালীরা তাদের বন্ধু নয়।’ প্রসিতের এ মন্তব্য রাঙ্গামাটির সচেতন ছাত্র সমাজ সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি, মেনে নিতে পারেননি অভিভাবকরাও। তিনি প্রায়ই মন্তব্য করতেন, ‘What Khagrachari thinks today, Rangamati thinks tommorrow’। ’৯৩-এ নানিয়ারচর গণহত্যার পর সংগঠনের অভ্যন্তরে বড় ধরনের বিতর্ক শুরু হয় এই কারণে যে, নানিয়ারচর গণহত্যার জন্য ব্যক্তিগতভাবে অনেকাংশে দায়ী প্রসিত- এ কথা মনে করতো তৎসময়ে ঢাকাস্থ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশীর ভাগ সচেতন ছাত্ররা যারা ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানে। ব্যক্তিগতভাবে আমিও মনে করতাম, এখনো করি।

২৭ অক্টোবর’৯৩ নানিয়ারচর শাখার প্রথম কাউন্সিল সম্পন্ন করার জন্য তৎকালীন পিসিপির কেন্দ্রীয় সভাপতি প্রসিত খীসার নেতৃত্বে একদল ছাত্র নেতা নানিয়ারচর যান। ২৮ অক্টোবর কাউন্সিল সম্পন্ন করে রাঙ্গামাটি আসার উদ্দেশ্যে যাত্রী ছাউনিতে চলে আসে সফরকারী টীম। আসার সাথে সাথে প্রসিত যাত্রী ছাউনির বসার জায়গায় পা রেখে উপরে বসে যায়। সেই যাত্রী ছাউনিটি দীর্ঘদিন ধরে অর্ধেক অংশ সেনাবাহিনী চেকপোষ্ট হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। চেকপোষ্টে দায়িত্বরত সেনা সদস্যরা তা মানতে পারেনি। প্রসিতকে সেখান থেকে নেমে ভালভাবে বসার জন্য বলে সেনা সদস্যরা। প্রসিত সেনা সদস্যদের কথায় নিচে না বসে বিতর্কে জড়িয়ে যায়, সাথে সাথে সফরকারী টীমের অন্যান্য সদস্যরা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে সেনাবাহিনীর উর্ধতন এক কর্মকর্তা সেখানে এসে যায়। সফর টীমের জন্য নির্ধারিত ট্রলারের হ্যান্ডেলটি উপরে তুলে নিয়ে যায় সেনাবাহিনী। অবস্থা বেগতিক দেখে নানিয়ারচর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের খবর দেয়া হয়। ছাত্রছাত্রীদের জমায়েত বেশী হয়ে গেলে নিরাপত্তা বেষ্টনী সৃষ্টি করে মিছিল সহকারে প্রসিতকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয় এবং প্রসিত রাঙ্গামাটি না গিয়ে মহালছড়ি হয়ে খাগড়াছড়ি চলে আসে। আসার আগে নানিয়ারচর নেতৃবৃন্দকে নির্দেশ দিয়ে আসে তারা যেন যাত্রী ছাউনি সেনামুক্ত করার জন্য কর্মসূচী ঘোষণা করে। পাশাপাশি সেখান থেকে ফোনে খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও ঢাকায় জানানো হয় যে, প্রসিতকে নানিয়ারচরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে সেদিনই (২৮ অক্টোবর) বিকালে খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। সে মিছিলে পুলিশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বিনা উস্কানীতে হামলা করে। এতে বেশ কিছু পিসিপি কর্মী আহত ও গ্রেপ্তার হয়। আগের দিন আটককৃত ছাত্রদের মুক্তির দাবীতে ২৯ অক্টোবর ডিসি অফিস ঘেরাও করা হয় এবং পরের দিন ডিসি অফিসের সামনে অবস্থান ধর্মঘটের ঘোষণা দেয়া হয়। রাতে মাইকিং করতে গেলে পুলিশ মাইক জব্দ করে থানায় নিয়ে যায় এবং সংগঠনের দু’জন কর্মী রিপন চাকমা ও ধর্মজ্যোতি চাকমাকে আটকে রাখে এবং পরে ছেড়ে দেয়। ৩০ অক্টোবর ডিসি অফিসে অবস্থান ধর্মঘট পালনের লক্ষ্যে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার খেজুর বাগান মাঠ হতে মিছিল শুরু হলে পুলিশ বিনা উস্কানীতে মিছিলে হামলা চালায়। এতে বেশ কয়েকজন হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পিসিপির কর্মী মারাত্মকভাবে আহত হয়। নানিয়ারচর ও খাগড়াছড়ি ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করা হয়। প্রসিত খীসা নভেম্বরের প্রথম দিকে ঢাকায় চলে গেলে নানিয়ারচর ঘটনা ও ভুল তথ্য দিয়ে ফোন করার জন্য ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হন। ১৭ নভেম্বর নানিয়ারচরে যাত্রী ছাউনি সেনামুক্ত করার কর্মসূচীর কথা জানালে ব্যাপকভাবে আলোচনা করা হয়। তিনি অনেক যুক্তি দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করেন কেন সেই কর্মসূচী পালন করা উচিৎ।

পক্ষান্তরে যু্িক্ত দেয়া হয়, নানিয়ারচরের যাত্রী ছাউনি সেনামুক্ত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম সেনামুক্ত হবে না। তাই আমাদের আন্দোলন নির্দিষ্ট কোনো সেনা ছাউনির বিরুদ্ধে নয়, সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেনা ক্যাম্প ও সেনা শাসনের বিরুদ্ধে। তা ছাড়া ২৮ অক্টোবর ’৯৩ এর ঘটনা এবং নানিয়ারচর বাজারের অবস্থানগত কারণেও এই কর্মসূচী বাতিল করা উচিৎ বলে অনেকে যুক্তি প্রদান করেন। এছাড়াও ১৭ নভেম্বর বুধবার নানিয়ারচরের বাজার দিন। দূর-দূরান্ত গ্রাম থেকে নিরীহ মানুষ বাজারে আসবে, কোনো কারণে সংঘর্ষ বাঁধলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। যুক্তি দেয়ার পরও প্রসিত তার দেয়া সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার পক্ষে নয়। ১৫ নভেম্বর নানিয়ারচর থেকে ফোন করা হয় ঢাকায়। এতে জানানো হয় – নানিয়ারচেরর পরিস্থিতি থমথমে – ১৭ তারিখের কর্মসূচী পালন করলে সংঘর্ষ অনিবার্য, সেনাবাহিনী বহিরাগত বাঙালীদের প্রস্তুত রেখেছে হামলার জন্য। টিএনও ইতিমধ্যে নানিয়ারচর থেকে বাড়ীতে চলে গেছেন, ১৭ তারিখের আগে নানিয়ারচরে আসার কোন সম্ভাবনা নেই। এই পরিস্থিতিতে তারা কর্মসূচী বাতিল করবে কিনা জানতে চান। কিন্তু প্রসিত কোনো অবস্থায় বাতিল হবে না বলে জানিয়েছেন। কর্মসূচী পালিত হলো, পিসিপির মিছিলে বহিরাগত বাঙালীরা হামলা করলো। ফলে সংঘর্ষ বেধে যায়। বহিরাগত বাঙালীরা যখন পারছে না তখনই সেনাবাহিনী গুলি চালালো। সেনাবাহিনীর গুলি ও বাহিরাগত বাঙালীদের হামলায় গ্রাম থেকে আসা অনেক নিরীহ পাহাড়ী দিন-দুপুরে মারা গেল। পুড়িয়ে দেয়া হলো পাহাড়ীদের ঘরবাড়ী। দু’একদিনের মধ্যে লেইকের মধ্যে ভেসে উঠলো একের পর এক পাহাড়ী লাশ। রচিত হয়ে গেলো পার্বত্য চট্টগ্রামে আরেকটি জঘন্যতম গণহত্যা। সমালোচিত হলেন প্রসিত। সংগঠনের অভ্যন্তরে সমালোচনা-পর্যালোচনা হলেও নানিয়ারচর গণহত্যার প্রতিবাদ সাংগঠনিক উপায়ে অব্যাহত রাখা হয়েছিল। নানিয়ারচর গণহত্যার প্রতিবাদে ৭ ডিসেম্বর ’৯৩ ঢাকায় শোক সমাবেশ ও মিছিলের আয়োজন করা হয়, ৯ ডিসেম্বর সেনাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-সেনা সদস্যসহ তাদের মদদপুষ্ঠ বহিরাগত বাঙালীদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবীতে ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে প্রতীক অনশন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

১৭ মার্চ ’৯৪ ঢাবির জগন্নাথ হলের চায়ের দোকানের পাশে বর্তমানে স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তিটা যেখানে রয়েছে সেখানে অনানুষ্ঠানিক এক মিটিং-এ নানিয়ারচর গণহত্যা, সেনাবাহিনী ও সরকারের অব্যাহত দমন-পীড়নের প্রতিবাদে বিজু উৎসব বর্জনের প্রস্তাব করেন প্রসিত। সেদিন অনেকে এই বিজু উৎসব বর্জনের বিপক্ষে মত দেয়, অনেকে ভেবে দেখার কথা বলে। কারণ বিজু পাহাড়ীদের এমন একটা উৎসব যা বর্জন করা সহজ নয়। ’৯২ সালের ১০ এপ্রিল লোগাং গণহত্যার পর ১৩ এপ্রিল বিজু বর্জনে ছিল জনগণের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। ’৯৪-এর বিজু বর্জন নানিয়ারচর গণহত্যার প্রতিবাদে, সেটা সংঘটিত হয়েছিল প্রায় ৬ মাস আগে। ফলে বিজু বর্জন কতটুকু কার্যকরী হবে সেদিন প্রশ্ন উঠেছিল। তাছাড়া ’৯৩-এর শেষের দিকে হিন্দু সম্প্রদায় দুর্গা পূজা বর্জনের ডাক দিয়েছিল, কার্যতঃ দুর্গাপূজা বর্জন হয়নি। ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবসমূহ বর্জন করা সাধারণ মানুষের পক্ষে সহজ নয়। এছাড়াও বিজু উৎসবের প্রক্রিয়া শুরু হয় দু’এক মাস আগে থেকে। বিভিন্ন গ্রামে বিজু উৎসবকে কেন্দ্র করে ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার আয়োজন করা হয়। তাই সেদিন প্রশ্ন উঠেছিল ১৭ মার্চের পরে বিজু বর্জনের ডাক দিলে (বিজুর ২৪/২৫ দিনের আগে) কতটুকু সফল হবে? কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে প্রসিত একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত দিলেন বিজু বর্জন হবে তবে তিন পার্বত্য জেলার নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে। এছাড়াও সিদ্ধান্ত হয় যে, যদি বিজু বর্জন করা হয় তাহলে সেটি হবে পিসিপির উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজু উৎসব আগে যেভাবে পালন করা হতো সেভাবে হবে না, সাধারণ খানাপিনা ঘোরাফিরা চলবে।

’৯১ সালে আমরা যারা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছি তাদের মধ্যেকার একতা-আন্তরিকতার সম্পর্ক ছিল সবচাইতে বেশী। ’৯২ এর শেষের দিকে আমাদের ব্যাচের সবাই মিলে একটা পিকনিক আয়োজন করে। কিন্তু ’৯৩-এ বিভিন্ন সমস্যার কারণে পিকনিক বা পুনর্মিলনী করা সম্ভব হয়নি। ফলে ’৯৪-এর বিজুর সময় কেউ গ্রামের বাড়ীতে বা তিন পার্বত্য জেলার কোথাও না গিয়ে এক সাথে বিজুতে ঘুরবো এ ধরনের সিদ্ধান্ত ছিল। ব্যাচের সবাইকে সংগঠিত করাসহ পরিকল্পনা গ্রহণ করার দায়িত্ব ছিল বিপ্লব চাকমা ও জীতেন চাকমার উপর। তারা পরিকল্পনা গ্রহণ করে এভাবে- জনপ্রতি ১০০ টাকা করে চাঁদা দেবে, সেই টাকায় মাইক্রোবাস ভাড়া করা হবে। তৎসময়ে মাইক্রো ভাড়া পেট্রোল ছাড়া দৈনিক ৭০০ টাকা। ৮ এপ্রিল ’৯৪ তিন সংগঠনের (পিসিপি, পিজিপি ও এইচডব্লিউএফ) নামে ঢাকায় একটি লিফলেট বিলি করা হয়। তাতে লেখা হয়- ‘বিজু সর্বাত্মকভাবে বর্জন করা হবে। খানাপিনা ঘুরাফিরা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়।’ সমস্যায় পড়ে যায় ’৯১ ব্যাচের পরিকল্পনা। কারণ ৮ তারিখের আগে তারা অনেকের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করেছে এবং মাইক্রো ভাড়াও অগ্রিম দিয়েছে।

১০ এপ্রিল’৯৪ লোগাং গণহত্যা দিবস উপলক্ষে জগন্নাথ হল মাঠ গ্যালারীতে একটি আলোচনা সভা ও স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। স্মরণসভা শেষে বিপ্লব চাকমা ও জীতেন চাকমা তৎসময়ে পিসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদ্বয় সঞ্চয় চাকমা ও দেবাশীষ চাকমার সাথে বিস্তারিত আলাপ করে। তখন তারা বলেছিলেন যে, অসুবিধা নেই, তোমরা ঘুরতে পারবে। ফলে বিজুর সময় ৯১ ব্যাচের ৩৪ জনের অধিক ছাত্রছাত্রী দু’টো মাইক্রো বাসে করে ঘুরে বেড়ায়। বিজুর পর পরই শুরু হলো বিতর্ক। এক পক্ষ থেকে বিভিন্ন জায়গায় বলা হলো, যারা বিজুতে ঘুরেছে তারা দালাল, জুম্ম জাতির শত্রু। তৎসময়ে ঢাকা মহানগর শাখার অর্থ সম্পাদক চম্পানন চাকমা ও দপ্তর সম্পাদক মনোৎপল চাকমা (বর্তমানে প্রভাষক, মহালছড়ি কলেজ) এমন বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে যে, উভয়ের মধ্যে মারামারি হওয়ার মতো অবস্থা। তৎসময়ে ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জলিমং মারমা, সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ চাকমা এবং আমি তিনজনে চম্পানন ও মনোৎপলকে ডেকে সমাধান করে দিলাম এবং সবাইকে জানিয়ে দিলাম যে বিজু খাওয়া না খাওয়া নিয়ে আর বিতর্ক বা আলোচনা করা যাবে না। কিন্তু প্রসিত আমাদের সিদ্ধান্তের সাথে একমত না হয়ে বিজু নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে একটা আলোচনা সভা আহ্বান করার জন্য ঢাকা মহানগর শাখাকে নির্দেশ দিলেন। আমরা তাকে জানালাম যে, বিজু নিয়ে ঢাকা মহানগরে অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, এ সময়ে যদি আলোচনা-পর্যালোচনা আহ্বান করা হয় তাহলে বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে। তারপরও তিনি আহ্বান করার পক্ষে মত দিলেন এবং যে সমস্যা সৃষ্টি হবে তা তিনি সমাধান করবেন বলে জানালেন।

আমরা ৩০ এপ্রিল ’৯৪ বিজু-উত্তর পর্যালোচনা সভা জগন্নাথ হলের টেনিস কক্ষে আহ্বান করলাম। সেখানে শুরু হলো বিতর্ক-সমালোচনা। আমি ’৯১ ব্যাচের ও ঢাকা মহানগর শাখার পক্ষ থেকে (যারা বিজু খেয়েছে) বিস্তারিত আলোচনা করলাম এবং বললাম যে, বিজু বর্জনের লিফলেট পাওয়ার পরও বিজু খাওয়া আমাদের ঠিক হয়নি (যদিও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের অনুমোদন ছিল), সেজন্যে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। তবে আমরা বিজু খেয়ে যে ভুল করেছি কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি থেকে সদস্য পর্যন্ত অনেকেই সেই ভুল করেছেন। কেউ যদি প্রমাণ চান তাহলে আমি তা দিতে প্রস্তুত আছি। কারণ আমরা জানতাম প্রসিত নিজেও বিজু খেয়েছেন, ঘুরেছেন। এছাড়াও কেন্দ্রীয় কমিটির সঞ্চয়, বর্তিকা, বাঞ্ছা, দেবাশীষসহ অনেকেই বিজু খেয়েছেন, ঘুরেছেন।

কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে সেদিন কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি যে তারা বিজু খায়নি, ঘুরেনি। কিন্তু ক্যাহ্লাচিং মারমা যারা বিজু খেয়েছে তাদেরকে নানা অপবাক্য প্রয়োগ করে সমালোচনা করে। তখন অনেকে প্রশ্ন করেছিলেন, বিজু বর্জন সংগঠনের সিদ্ধান্ত নাকি ব্যক্তি প্রসিতের? সংগঠনের সিদ্ধান্ত হয়ে থাকলে তবে কখন সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে? এবং কখন তিন সংগঠনের বৈঠক হয়েছে? কোন সংগঠন থেকে কারা উপস্থিত ছিল? লিফলেট লেখার দায়িত্ব কে নিয়েছে? সেদিন এত প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, জেলা পরিষদ মেনে যারা স্বাক্ষর করেছে এবং যারা জেলা পরিষদে সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছে তাদেরকে আমরা দালাল, সুবিধাবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল বলি। আর প্রসিতের বাবা অনন্ত বিহারী খীসা ৯ দফায় স্বাক্ষরকারী খাগড়াছড়ি জেলার ৩নং ব্যক্তি এবং সে সুবাদে আর্মীদের কাছ থেকে অনেক অনেক সুবিধা নিয়েছেন, তাকে দালাল বলি না কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর সেদিন প্রসিত দিতে পারেননি। তিনি বলেছিলেন, এসব প্রশ্ন মাস্তানীসূলভ। কেন তিনি ‘মাস্তানীসূলভ’ বলেছেন সভা শেষে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি তার জবাব দেন ‘মাস্তানীসূলভ’ বলিনি, ‘মাষ্টারীসূলভ’ বলেছি। অমীমাংসিতভাবে সেদিনের আলোচনা শেষ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ছাত্র সমাজের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর শাখার পক্ষে আবারও আলোচনা সভার আহ্বান করা হয় জগন্নাথ হলের উত্তর বাড়ীর টিভি কক্ষে। সেদিন প্রসিত বা কোনো কেন্দ্রীয় নেতা উপস্থিত থাকেনি। সেদিনও প্রচন্ড বিতর্ক হয়, এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যে বিজু না খাওয়ার লোকের সংখ্যা খুবই নগণ্য। বাকীরা সবাই কোনো না কোনোভাবে খেয়েছে। সেদিন ক্যাহ্লাচিং মারমাকে অশালীন বক্তব্য রাখার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। উল্লেখ্য ক্যাহ্লাচিং মারমা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল।

(চলবে..)

লেখক: সাবেক সভাপতি, পিসিপি, কেন্দ্রীয় কমিটি

More From Author

+ There are no comments

Add yours