হিল ভয়েস, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক: সংবিধান সংস্কারের প্রশ্নে বিপ্লবী লারমার ১৯৭২ সালের গণপরিষদ বিতর্ক অবশ্য একটি পাঠ্য বিষয় বলে ঢাকায় বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত সভায় বক্তারা অভিমত ব্যক্ত করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ১৫ই সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন কমিটি কর্তৃক এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবু সাঈদ খানের সভাপতিত্বে এবং আদিবাসীদের অনলাইনভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আইপিনিউজ এর উপ-সম্পাদক সতেজ চাকমার সঞ্চালনায় আলোচনা সভার শুরুতে গণঅভ্যুত্থান, রাষ্ট্র সংস্কার ও সংবিধান বিতর্র্ক: মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জরুরি জিজ্ঞাসা শীর্ষক এক প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ।
প্রবন্ধে রাষ্ট্র সংস্কার ও সংবিধান তৈরীতে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ভূমিকা নিয়ে আলোকপাত করা হয়। প্রবন্ধে বলা হয়, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সংবিধান সংস্কারের প্রশ্নে বিপ্লবী লারমার ১৯৭২ সালের গণপরিষদ বিতর্ক একটি অবশ্য পাঠ্য বিষয়। তিনি এমন একটি দেশের স্বপ্ন বুনেছিলেন যেখানে সকল শ্রেণি, সকল সম্প্রদায়, সকল জাতিগোষ্ঠী সমমর্যাদায় বসবাস করবে। সে লক্ষ্যে সংবিধানে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে আলোকপাত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রবল জাত্যাভিমানী জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় ও জাতীয়তার প্রশ্নে গণপরিষদের সংবিধান বিতর্কে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী জাতীয়তাবাদ কর্তৃক তাঁকে সেদিন প্রবলভাবে অবজ্ঞার শিকার হতে হয়েছিল। তবুও তিনি সর্বদা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন।
প্রবন্ধে আরো বলা হয়, এম এন লারমা শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতা নয়, তিনি বাংলাদেশের একজন জাতীয় নেতা। জাতীয় বাজেট আলোচনায় তিনি যুগ যুগ ধরে সমাজে অবহেলিত নিচু শ্রেণি মেথর, বেদে, রিকশাওয়ালাদের অন্তর্ভুক্তির কথা বলেছিলেন। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে মেহনতি মজদুরদের সাম্য ও ন্যায্যতা আনয়ণের জন্য তিনি আজীবন লড়াই করে গেছেন। শুধু তাই নয়, বিপ্লবী লারমা নারী অধিকার, পরিবেশের প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষার কথাও বলেছেন। প্রবন্ধতিতে অসাম্প্রদায়িক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সংবিধান রচনায় এবং সমতা ও ন্যায্যতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জীবন ও সংগ্রাম বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করার ব্যাপারেও আলোকপাত করা হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্নিগ্ধা রেজওয়ানা তার আলোচনায় বলেন, এম এন লারমা একজন দূরদর্শী নেতা ছিলেন। আজকের বিশ্বে জাতিসংঘের ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অর্জনে কাউকে পেছনে না ফেলে সকলকে সাথে নিয়ে এগিয়ে চলার যে আহ্বান জানানো হচ্ছে সেটি প্রয়াত লারমা ৪০-৫০ বছর আগে বলে গিয়েছিলেন। তিনি বিনাসি উন্নয়ন নিয়ে কথা বলেছিলেন, কথা বলেছেন নারী অধিকার নিয়ে, নিম্নবর্গের মানুষদের নিয়ে। শুধু তাই নয়, তিনি সংবিধানে ঘুষখোর, দুর্নীতিপরায়ণদের বিরুদ্ধে নীতি গ্রহণের কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমরা যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি সেখানে যদি উচ্চ শ্রেণীর ঘুষখোর, দুর্নীতিপরায়ণরা আবারো মাথাছাড়া দিয়ে ওঠে তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সংবিধান প্রণেতাদেরকে বিশ্বাসঘাতক বলে আখ্যায়িত করবে।
তিনি আরও বলেন, সংবিধানের শুরুতে রাষ্ট্র বাঙালি বনাম আদিবাসীর বির্তক তৈরী করে রেখেছে যা একটি জাতিরাষ্ট্রের উন্নয়ন সাধনের অন্যতম অন্তরায়। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্র দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে, জুলাই বিপ্লবে আদিবাসীদের ভ‚মিকাকে স্বীকৃতি দিতে চায় না। বরং নিপীড়কের ভূমিকা নিয়ে আদিবাসীদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক আলতাফ পারভেজ বলেন, “মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা মারা গেছেন ১৯৮৩ সালে। কিন্তু উনার রাজনৈতিক জীবনের সফলতা এসেছে ২০২৪ এর জুলাই ও আগষ্টে। কেন সেটা বলছি। কারণ এখনকার রাজনীতির মূল আলোচনা হলো সংবিধান সংস্কার এবং আপনারা তরুণরা মাস্টারমাইন্ড খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আমার দৃষ্টিতে সংবিধান সংস্কারের রাজনীতিতে মাস্টারমাইন্ড দু’জন। তাঁর মধ্যে একজন হলে বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতেও ছিলেন এবং একজন বিপ্লবী। আমি একটি পান্ডুলিপি তৈরি করেছি তাঁকে নিয়ে যেটা এখনও প্রকাশিত হয়নি। সেটার নাম দিয়েছি ‘ফার্ষ্ট ডেমোক্র্যাট” অর্থাৎ, বাংলাদেশের প্রথম গণতন্ত্রী। সংবিধান বিতর্কের সময় তিনি যে বিতর্কগুলো করেছিলেন সেগুলোই মূলত তার প্রমাণ যেটা আজকের আলোচনার মধ্যে মোটামুটি উঠে এসেছে।”
তিনি আরো বলেন, “মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মধ্যে অনেকগুলো গুণের সম্মিলন আছে। তিনি যখন গেরিলা ছিলেন তখন তাঁর সহকর্মীরা একটি বড় কাছিম নিয়ে এসেছে ব্যারাকে। সেখানে তিনি আপত্তি করলেন এই বলে যে, এটি মা কাছিম। একজন গেরিলা নেতার অনেক ভাবনা থাকে। কিন্তু উনার মাথায় এটাও ছিল যে, এই কাছিমকে মেরে ফেলছি মানে বিরল প্রজাতির একটা প্রাণিকে আমরা শেষ করে দিচ্ছি। কাজেই ব্যক্তি লারমা আমাদের কাছে দারুণ এক বিষ্ময়কর চরিত্র।”
তিনি আরো বলেন, ”মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি বেশী আকৃষ্ট ছিলেন। তিনি তার সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকার নিয়ে সেসময় রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছে স্মারকলিপি দিচ্ছেন এবং প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। কিন্তু তারপরও তিনি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির বাইরেও যাননি। পরে তিনি সংবিধান বিতর্কের সভায় যেভাবে অপমানিত হয়েছেন সেরকম হলে আমিও গেরিলা হতাম।”
আমাদের আগে শ্রীলংকার দুবছর আগে প্রায় একই ধরণের একটি গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, কিন্তু সেটাও কাঙ্খিত সফলতা নিয়ে আসতে পারেনি। কারণ আমলাতান্ত্রিক কৌশল অবলম্বন করায় রাজনীতিবিদদের আস্থা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। আমাদের এখানেও সেটা যেন না হয়। কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি প্রধান উপদেষ্টা (ড. মুহম্মদ ইউনূস) পাহাড়ে রাজা দেবাশীষ রায়ের নেতৃত্বে সুশীল সমাজের একটি প্রতিনিধিদলের সাথে দেখা করেছেন। কিন্তু প্রথম দেখা করা উচিত পাহাড়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে যারা সবসময় জনগণের কাছাকাছি থাকেন। সিভিল সোসাইটির সাথে পরে দেখা করলেও চলবে। অন্যদিকে পাহাড়ে একটি চুক্তি হয়েছিল। সেখানে অনেক কিছু না থাকলেও বিভিন্ন অধিকার সন্নিবেশিত আছে। কিন্তু সেগুলোরও অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি। রাষ্ট্র যে তাদের প্রতি রাখা প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি তারই প্রমাণ সেটি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্যরিস্টার সারা হোসেন বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংবিধান বিতর্কের সময় যে চিন্তাগুলো তুলে ধরেছিলেন সেগুলো মূলত বাংলাদেশকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক দেশ করার জন্য। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। একই সাথে প্রতিবছর আমরা পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়েও কথা বলি। কিন্তু সে চুক্তির অধিকার বিষয়ই সমাধান করা হূয়নি আজ অবধি। এখন প্রায় ২৫/২৬ বছর পার হয়ে গেছে এই চুক্তির। কিন্তু এসময়েও এ চুক্তি নিয়ে আসলে কতটুকু অগ্রসর হতে পারবো তা নিশ্চিত না। পার্বত্য চুক্তির সেটুকু অর্জন হয়েছে সেগুলো যেন ভেস্তে না যায় তা নিয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। এর কয়েকদিন আগেও আমাদের কোর্টে একটি বিষয় এসেছে সেটি হলো ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি। এই বিধির অনেক ধারায় বাতিল করতে চেয়েছি বিগত সরকারের এটর্নি জেনারেল। এই মামলাটিও এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। এসময়ে তাড়াহুড়ো করে এসব নিস্পত্তি করতে যেয়ে যেন আমরা ভুল করে না বসি সেব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে।
সভাপ্রধানের বক্তব্যে বিশিষ্ট কলামিস্ট ও সাংবাদিক আবু সাঈদ খান বলেন, পাকিন্তান রাষ্ট্র মুসলমান রাষ্ট্র ছিল। আমরা বলেছি এটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। কাজেই মুসলমান রাষ্ট্র যদি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হয় তবে বাঙালির রাষ্ট্রও সাম্প্রদায়িক। কেননা, এখানে আরো চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সান্তাল, ওরাওসহ বিভিন্ন জাতির মানুষ বাস করেন। আমরা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র করতে চাইনি। একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধ কেবল বাঙালি করেনি। সেখানে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাও, গারো, মুনিপুরি অংশ নিয়েছিল। কাজেই আমাদের রাষ্ট্র হওয়ার কথা ছিল। যার কারণে আমাদের দেশের নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
তিনি আরো বলেন, পাহাড়কে বাদ দিয়ে কেবলমাত্র বাংলাদেশের অপর অংশকে যদি উন্নত করা হয় তবে বাংলাদেশটা সম্পূর্ণতা পাবে না। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা যে কথাগুলো গণপরিষদ বিতর্কের সময় উত্থাপন করেছিল সেগুলো যদি রাখা হতো তবে কীই বা হতো। হয়ত কিছু লাইন বা বাক্য যুক্ত হতো সংবিধানে! কিন্তু তার বদৌলতে সংবিধানটি আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দেশটা আরো সুন্দর হতো।
আলোচনায় আরো অংশ নেন লেখক ও এক্টিভিস্ট সারোয়ার তুষার, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এর ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক হরেন্দ্র নাথ সিং। সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হিরণমিত্র চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জগদীশ চাকমা, বিশিষ্ট লেখক ও কথা সাহিত্যিক ওয়াসী আহমেদ, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এর সহ-সাধারণ সম্পাদক ডা: গহেন্দ্র নাথ মাহাতো, জনসংহতি সমিতির স্টাফ সদস্য অনন্ত বিকাশ ধামাই, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মনতুষ চাকমাসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃত্ববৃন্দ।
+ There are no comments
Add yours