আজ ১৫ সেপ্টেম্বর, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগণের জুম্ম জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত, নিপীড়িত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা, মহান বিপ্লবী, সাবেক গণপরিষদ ও সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ নারায়ণ লারমার (এম এন লারমা) ৮৫তম জন্মদিবস। তাঁর জন্ম ১৯৩৯ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি জেলার নান্যাচর উপজেলার বুড়িঘাট মৌজার মাউরুম (ছোট মহাপুরম) নামক স্থানে। তিনি শহীদ হন ১৯৮৩ সালের ১০ই নভেম্বর। মহান এই নেতার জন্মদিন উপলক্ষে নিবেদিত এই কবিতাগুচ্ছ। লিখেছেন জড়িতা চাকমা, শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা ও কাঞ্চনা চাকমা।
তোমার জন্মদিনে
জড়িতা চাকমা
আজ থেকে পঁচাশিটি বছর আগে লারমা তুমি, জন্মেছিলে
সবুজে সবুজে ভরা এই পার্বত্য চট্টলা, মোদের জন্মভূমিতে।
উচুঁ-নীচু পাহড়ে ঘেরা, বর্ধিষ্ণু গ্রাম মাওরুম তার নাম
তুমি জন্মেছিলে, রচিতে ইতিহাস গড়িতে নুতন গ্রাম।
কাপ্তাই বাঁধে, মাওরুম ডুবেছে, কর্ণফুলীর তলদেশে,
জন্মভূমি-মাতৃভূমি, শস্যভূমি হলো ছাড়খার সব শেষে।
শাসন-শোষণ করে ব্রিটিশ, তুলে দিয়ে গেলো জুম্মদের পাকিস্তানের হাতে,
পার্বত্য চট্টলায় থামাতে পীড়ন-নির্যাতন, তুমি এসেছিলে ১৯৩৯ সালে ।
দুটো বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে, বিশ্ব হয়েছে মুক্তিকামীদের সূর্যোদয়,
তারি সাথে জুম্মদের মুক্তির বার্তা নিয়ে, হলো তোমারো উদয়।
পার্বত্য চট্টলায়, উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে আদরের দুলাল হয়ে,
তুমি এসেছো শিক্ষা-দীক্ষা, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির ধ্বজা নিয়ে।
সুভাষিণী মায়ের সোহাগভরা হৃদয়, আর অতিথি পরায়ণতা,
ঐতিহ্যবাহী পরিবারের কর্মসাধনায় তুমি, হয়ে উঠলে স্বাধীনচেতা।
শাসকের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে, ১৯৬৩ সালে করেছো কারাবরণ,
পাকিস্তানি শাসকের ভয়ে হওনি পিছ পা, করেছো মরণ-পণ।
কাপ্তাই বাঁধের প্রতিবাদ করে, অগ্রযাত্রা সূচিত হলো তোমার,
কন্ঠরাধ কেউ করতে পারেনি, ৭০’র নির্বাচনে জিত হলো তোমার।
তুমি নির্ভীক, তুমি দুঃসাহসী, তোমার গতিরোধ কেউ করিতে পারেনি,
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জাতি মুক্তি চাই, তোমাকে আজো ভুলেনি।
ছাত্র জীবনে অবিচল পথচলায় থেকেছো তুমি জন্মভূমির স্বাধিকার তরে,
সাথে দিশা রেখে গেছো, বাংলাদেশের সংবিধান রচনাকালে আলোচনা করে।
স্বার্থক জনম তোমার, এদেশের সংবিধান তোমাকে স্মরণ করে যাবেই,
তোমার জন্মভূমিতে, ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন হবেই।
আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি কেন?
শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা
আমার বোনের পিনন-খাদি ধরে টানা-হেঁচড়া হচ্ছে
আমার বোনকে অপমান করা হচ্ছে
পাহাড়ে এখনো বাড়ি পোড়ানো হচ্ছে, অপহরণ হচ্ছে, কখনো কখনো খুন হচ্ছে।
এখনোতো পাহাড়ে লেঃ ফেরদৌস আর কখনো মেজর মেহবুব হয়ে জলপাই পোশাকটি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এখনো এত কিছুর পরও কেন শূন্য হাতে দাঁড়িয়ে আছি?
আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি কেন?
পাহাড়ে এখনো গা শিউরে ওঠার মতন অজস্র নিষ্ঠুরতার রাত্রি পোহাতে হচ্ছে
পাহাড়ের মানুষকে প্রতিটা দিন মিথ্যা আশ্বাস, সংশয়, ভয়, উপবাসের কালযাপন করতে হচ্ছে
প্রতিটা মূহূর্তে হাঁপিয়ে ওঠা ঘন অন্ধকার নামছে মনে হচ্ছে।
আমরা কেন এমনটা?
যেন কিছু ভাবার ইচ্ছে নেই, প্রয়োজন নেই।
আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি কেন?
পাহাড় আমাদের নিঃশ্বাস, ধীরে ধীরে এই নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে
কেন আওয়াজ তুলতে পারছি না দু’হাত তুলে?
তোমার কি সেই লংগদুর গণহত্যার কথা মনে পড়ে না?
মনে পরে কি সেই নান্যাচর, ভূষণছড়া গণহত্যার কথা?
তোমার কি মনে পড়ে না ঘন কালো রাত্রির অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া পাহাড়ের বারুদের মতো বজ্রকন্ঠ কল্পনা চাকমাকে?
মনে আছেতো পাকদের কথা? যারা শত শত ভিটেমাটি ডুবিয়ে, চাকমা রাজার রাজপ্রাসাদের অনেক ঐতিহ্য, ইতিহাসকে মুছে দিয়ে তারা বাতি জ্বালিয়েছে,
তোমার কি হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় না?
সেটেলার যখন পাহাড় গলিয়ে বসতি করে অবাধ উল্লাসে মেতে উঠে।
তোমরা কেন বুঝে উঠতে পারোনি এখনো
ফুরমোন, আলুটিলা, জাজিংডং, চিম্বুক পাহাড়ের প্রাণবায়ুও যেন নিঃশেষ হতে যাচ্ছে
পাহাড়ের সবুজ পাতাও যেন ফ্যাকাশে রক্তাভ লাল হয়ে উঠেছে..
আমি চিৎকার করে বলছি……
চুপটি মেরে বসে থাকার দিনগুলো মৃত্যু ঘোষণা করো
গোমড়া মুখে থাকা মুখটি চিতায় তুলে দাও
এসো… লড়াইয়ের মাঠটি সাজাই
চিৎকার করি, শ্লোগান ধরি, উল্লাস করি, গান করি, কবিতা শোনাই।
শুনছো তো আবার চিৎকার করে বলছি…..
সূর্য অস্ত যাবে ভোর হবে, অন্ধকার শেষে আলো আসবে,
বাঁধ দিতে হবে, আটকাতে হবে আমাদের দিকে তেড়ে আসা নোংরা জটলা
বর্ষাতে কেলাস বানিয়ে সেই স্রোতে ধুয়ে দিতে হবে সমস্ত অন্ধকার।
তারুণ্যের শক্তি
কাঞ্চনা চাকমা
আমরা তরুণ, আমাদের শক্তিও দ্বিগুন,
আমরা স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন বুনি;
অগ্নিস্ফুলিঙ্গ থেকে শুরু হবে- আমাদের হাতে নতুন পৃথিবী,
পাহাড় রক্ষায় এই আমরাই উদ্দীপ্ত তারুণ্য।
কণ্ঠে দ্রোহে হাঁকছি শ্লোগান,
অন্যায়ে মাথা নোয়াবার নয়;
আমরাই পদধ্বনি শোনাবো- রাজপথে,
অধিকারের মশাল জ্বলবেই জ্বলবে- তারুণ্যের হাতে।
আমরা চঞ্চল, আমরা দুর্বার
আমরা যেন এক গ্লাডিয়েটর;
নবশিশুদের কাছে রেখে যাবো ইতিহাস,
দিয়ে যাবো শান্তির সুবাতাস।
নতুন সূর্যোদয় এনে বাঁচার লড়াইয়ে ছিনিয়ে আনবো- মোরা অধিকার।
আমরা নির্ভীক, যোদ্ধাও হতে পারি;
এখন আমাদের নেই ভয় বিন্দুমাত্র, পারি যেকোনো গন্ডি ভেঙে চুর্ণ করতে।
অধিকারের মশাল জ্বলবেই জ্বলবে- তারুণ্যের হাতে।
আমরা চাইলে হতে পারি দুর্বিনীত, হতে পারি যেন ঘূর্ণি,
ভেঙে দিতে পারি পাহাড়ের যত অনিয়ম, আইন
দিতে পারি ভেঙে শাসন, শোষণ, সংহার।
আঁধার রাতে যখন এক ঝাঁক আলো এলো তারার বেশে,
অধিকারের মশাল জ্বলবেই জ্বলবে- তারুণ্যের হাতে।
+ There are no comments
Add yours