আদিবাসী জুম্মদের উপর সহিংস আক্রমণের বিরুদ্ধে পার্বত্য কমিশন ও ইবগিয়া’র যৌথ বিবৃতি

হিল ভয়েস, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, আন্তর্জাতিক ডেস্ক: গত ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন ও ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্ক গ্রুপ অন ইন্ডিজেনাস অ্যাফেয়ার্স (ইবগিয়া) বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জুম্ম জনগণের উপর সহিংস আক্রমণের বিরুদ্ধে একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছে।

বিবৃতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি, সহিংস আক্রমণের বিষয়ে জাতিসংঘের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন এবং অপারেশন উত্তরণ’ সম্পর্কিত নির্বাহী আদেশ প্রত্যাহার, ১৯৯৭ সালে চুক্তির নীতিমালা অনুযায়ী ছয়টি সেনানিবাস বাদে পার্বত্য চট্টগ্রামের সব সামরিক এবং নিরাপত্তা বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প তুলে নেওয়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেটেলারদের মর্যাদাপূর্ণ পুনর্বাসনের পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানানো হয়।

বিবৃতির মূল অংশটি নিম্নরূপ:
“আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি, গত ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জুম্ম জনগণের ওপর ধারাবাহিক আক্রমণ চলছে। এই অস্থিরতা শুরু হয় গত ১৮ সেপ্টেম্বর একজন বাঙালিকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার অভিযোগের পর থেকে। যথাযথ তদন্ত ছাড়াই বাঙালি সেটেলার সংগঠনগুলো সম্পূর্ণরূপে এই ঘটনার জন্য জুম্ম সম্প্রদায়কে দোষারোপ করে, যদিও খাগড়াছড়ি থানার অফিসার্স-ইন-চার্জ নিশ্চিত করেছেন যে, এই অভিযোগটি সঠিক নয়। এই অজুহাতে বাঙালি সেটেলাররা ১৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় প্রথমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলায় জুম্মদের ওপর আক্রমণ চালায় এবং তাদের সম্পত্তি পুড়িয়ে দেয়।

সেই সন্ধ্যায় দীঘিনালা আক্রমণের প্রতিবাদে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার স্বনির্ভর, নারাঙহিয়া এবং উপালীপাড়া এলাকায় জুম্ম শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তবে রাত ৯টার দিকে সামরিক বাহিনীর গাড়ি এসে পৌঁছায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচারিত লাইভ ভিডিওতে দেখা যায় যে, সামরিক বাহিনী জুম্ম জনগণের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে, যা হতাহতের এবং গুরুতর আহতের ঘটনা ঘটায়। প্রথম আলো নিশ্চিত করেছে যে, দীঘিনালা এবং খাগড়াছড়িতে কমপক্ষে তিন জন জুম্ম নিহত হয়েছে এবং আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

এই আক্রমণের প্রতিবাদে ২০ সেপ্টেম্বর সকালে রাঙামাটি শহরে জুম্ম শিক্ষার্থীরা একটি মিছিল বের করে। মিছিলটি যখন বনরূপা বাজার এলাকায় পৌঁছায়, লাইভ ভিডিওতে দেখা যায়, বাঙালি সেটেলাররা তাদের দিকে পাথর ছুঁড়তে শুরু করে। একই সময়ে বনরূপা বাজার জামে মসজিদ থেকে লাউডস্পিকারে মিথ্যা ঘোষণা দেওয়া হয় যে, জুম্মরা মসজিদ আক্রমণ করতে আসছে এবং প্রতিরোধ করার আহ্বান জানানো হয়। এই ভুল তথ্য দ্রুত সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে, যা এখনও চলমান, এবং এর ফলে শত শত বাঙালি সেটেলার রাস্তায় নেমে জুম্মদের আক্রমণ শুরু করে। ঠিক একই ধরনের ঘটনা দীঘিনালায়ও ঘটে, যেখানে মসজিদের লাউডস্পিকার ব্যবহার করে জনতাকে জড়ো করে আক্রমণ চালানো হয়।

রাঙামাটিতে বাঙালি সেটেলারদের আক্রমণে এক আদিবাসী ছাত্রের মৃত্যুও বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে, এবং বহু আদিবাসী ছাত্র ছাত্রী আহত হয়েছেন। বনরূপা, চম্পকনগর এবং বিজন সরণী এলাকায় বেশ কয়েকটি জুম্ম বাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের অফিস এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, পাশাপাশি কাঠালতলী মৈত্রী বিহার বৌদ্ধ মন্দিরে লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয়েছে। অগ্নিসংযোগের ঘটনা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য এখনো পাওয়া যাচ্ছে।

এই আক্রমণগুলির সময় সামরিক বাহিনীর প্রশ্নাতীত ভূমিকা গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাইভ ফুটেজে দেখা যায়, রাঙামাটির ফিসারী ঘাট এলাকায় দুপুরের দিকে লাঠি এবং দেশিয় অস্ত্র নিয়ে সজ্জিত বাঙালি সেটেলারদের একটি দল তিনটি সামরিক পিক-আপের পেছনে হাঁটছে এবং সামরিক বাহিনী তাদের কোনোভাবে প্রতিহত করেনি। এই জনতাই পরবর্তীতে জুম্ম জনগণের উপর আক্রমণ চালায় এবং তাদের সম্পত্তি ধ্বংস করে।

আওয়ামীলীগ ও শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, আমরা আশা করেছিলাম যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগণও অবশেষে প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ পাবে। এই আশা আরও জোরদার হয়েছিল, যখন মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা গত ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন, ‘আদিবাসীরাও এই দেশের নাগরিক এবং তারা সমান আইনের সুরক্ষার অধিকারী’। সেই ভাষণের পর থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ঢাকার সেটেলার সংগঠনগুলো প্রধান উপদেষ্টার ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে। বিক্ষোভকারীরা প্ল্যাকার্ড বহন করে, যেখানে লেখা ছিল: ‘প্রধান উপদেষ্টার দেশ বিরোধী ভাষণ প্রত্যাহার করতে হবে’, ‘প্রধান উপদেষ্টা হয় ক্ষমা চান, নয়তো পদত্যাগ করুন’, এবং ‘বাঙালিরাই বাংলাদেশের আদিবাসী’। আমরা মনেকরি, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সহিংসতা চলছে, তা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ইতিবাচক অবস্থানের প্রতি সেটেলারদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, ১৮ তারিখে কথিত হত্যাকান্ডটি এই অস্থিরতা সৃষ্টির একটি অজুহাত হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

আমরা জোরালোভাবে বাংলাদেশ সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছি, যাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আমরা জাতিসংঘের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটির গঠনের দাবি জানাই, যাতে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ, সহিংসতার মূল কারণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা তদন্ত করা যায়। সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের সময় নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর গুলি চালানো নিরাপত্তাকর্মীদের যদি বিচারের আওতায় আনা যায়, আমরা বিশ্বাস করি যে, গতকাল (১৯ সেপ্টেম্বর) নিরস্ত্র জুম্ম জনগণের উপর গুলি চালানো সামরিক বাহিনীর সদস্যদেরও বিচার করা হবে। আমাদের সংগ্রহ করা ভিডিও ফুটেজ এই তদন্তের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে। আমরা আরও দাবি জানাই, ‘অপারেশন উত্তরণ’ সম্পর্কিত নির্বাহী আদেশ প্রত্যাহারের, যার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক কর্তৃপক্ষকে সাধারণ প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, ১৯৯৭ সালের চুক্তির নীতিমালা অনুযায়ী ছয়টি সেনানিবাস বাদে পার্বত্য চট্টগ্রামের সব সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প তুলে নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। অবশেষে, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেটেলারদের মর্যাদাপূর্ণ পুনর্বাসনের পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানাচ্ছি।”

More From Author