বৈষম্য নিরসনের কাজ করতে চাই, এটিই আমাদের অঙ্গীকার: সংখ্যালঘু নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময়কালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস

হিল ভয়েস, ১৩ আগস্ট ২০২৪, ঢাকা: ঢাকার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বাংলাদেশের ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সাথে আজ (১৩ আগস্ট) বিকেলে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, সংবিধানে যে অধিকার দেয়া আছে তা ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে সব নাগরিকেরই প্রাপ্য। এহেন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জাগে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপাসনালয় কেন পাহারা দিতে হবে? এর মধ্য দিয়ে এটি সুস্পষ্ট যে, সংখ্যালঘুরা ভালো ও নিরাপদ নেই। একে অস্বীকার করার আজ কোন কারণ আছে বলে মনে করি না।

তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা যে ঘটছে এটি বাস্তব সত্য। আজকের প্রেক্ষিতে এমন বাংলাদেশ চাই যেখানে নাগরিকদের মধ্যে কোন বিভেদ ও বৈষম্য থাকবে না। আমাদের সংবিধানে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্বেও বাস্তবিক অর্থে অতীতে কেউ-ই এর আলোকে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করে নি। বর্তমান নির্দলীয় সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণে বদ্ধপরিকর। প্রধান উপদেষ্টা আরো বলেন, গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক অধিকার ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হলেই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তুলে ধরেন এবং অনতিবিলম্বে সাম্প্রদায়িক হামলা ও সহিংসতা বন্ধ, সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত করে অনতিবিলম্বে তাদের গ্রেফতার ও বিচার, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুণর্বাসন এবং আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থার পাশাপাশি যারা ইতোমধ্যে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন তাদের জায়গা-জমি, বসতভিটা, উপাসনালয় তাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। তিনি সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও অস্তিত্ব রক্ষায় সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন ও সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন, জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে সরকারে, সংসদে, জনপ্রতিনিধিত্বশীল সকল সংস্থায় অংশীদারিত্ব ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণ, দেবোত্তর সম্পত্তি সংরক্ষণ আইন ও বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দূর্গাপূজায় অষ্টমী থেকে দশমী এ ৩ দিন, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রবারণা পূর্ণিমায় ১ দিন ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ইস্টার সানডে’তে ১ দিন সরকারী ছুটি ঘোষণার পদক্ষেপ নেয়ার জন্যে প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আবেদন জানান।

এ্যাডভোকেট দাশগুপ্ত বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ পুণর্গঠনে আরও কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরেন, যার মধ্যে রয়েছে, ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণ, সংবিধানে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণ, ধর্মীয় শিক্ষায়তনের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণ, ধর্মীয় বাজেটের বৈষম্য দূরীকরণ, সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও কটুক্তির প্রতিকার বিধানে আইন প্রণয়ন এবং পাঠ্যপুস্ত ও শিক্ষা ব্যবস্থায় অসাম্প্রদায়িকতাকে অগ্রাধিকার প্রদান করা।

প্রধান উপদেষ্টা রাণা দাশগুপ্তর বক্তব্য ধৈর্য্য সহকারে শ্রবণ করে বলেন, আমাদের সুযোগ দিন। আমরা বৈষম্য নিরসনের কাজ শুরু করতে চাই এবং এটিই আমাদের অঙ্গীকার। মতবিনিময় সভায় উপদেষ্টাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, আদিলুর রহমান খান, সাবেক এ্যাটর্নী জেনারেল এ.এফ. হাসান আরিফ, ড. আ.ফ.ম. খালিদ হোসেন, ফরিদা আখতার, মো: নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। এতে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের কয়েকজন নেতা বক্তব্য রাখেন।

সংখ্যালঘু নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার বরাবরে লিখিত আবেদনপত্রে উত্থাপিত প্রস্তাবসমূহ নিম্নরূপ:

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও অস্তিত্ব রক্ষায় অনতিবিলম্বে-

১. সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হউক;

২. জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন ও সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন করা হউক;

৩. অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের যথাযথ প্রয়োগে যাবতীয় আমলাতান্ত্রিক বাধা অপসারণ করে ট্রাইব্যুনালের রায়ের আলোকে জমির মালিকানা ও দখল ভুক্তভোগীদের বরাবরে অনতিবিলম্বে প্রত্যর্পণ করা হউক;

৪. জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে সরকারে, সংসদে, জনপ্রতিনিধিত্বশীল সকল সংস্থায় অংশীদারিত্ব ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হউক;

৫. দেবোত্তর সম্পত্তি সংরক্ষণে আইন প্রণয়ন করা হউক (ইতোমধ্যে খসড়া বিল চূড়ান্তকৃত);

৬. বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন করা হউক (ইতোমধ্যে খসড়া বিল চূড়ান্তকৃত);

৭. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনের যথাযথভাবে কার্যকর করা হউক;

৮. হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দূর্গাপূজায় অষ্টমী থেকে দশমী-এ ৩ দিন, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রবারণা পূর্ণিমায় ১ দিন ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ইস্টার সানডে’তে ১ দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হউক।

বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ পুনর্গঠনে প্রস্তাবনা-

ক. ধর্মগ্রস্থ থেকে পাঠের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণ:

সকল রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ও সংসদের প্রতিটি অধিবেশনের সূচনায় পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করে সকল ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হউক।

খ. সংবিধানে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণ:

সংবিধানে বিদ্যমান সাংবিধানিক বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষে ১২ক অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক রাষ্ট্রধর্ম সম্বলিত ২ক অনুচ্ছেদের বিলোপ করা হউক;

গ. ধর্মীয় শিক্ষায়তনের বৈষম্য দূরীকরণ:

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় শিক্ষায়তনের উন্নয়ন ও বিকাশে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ধর্মীয় শিক্ষকদের বেতন কাঠামোর বৈষম্য দূর করা হউক;

ঘ. ধর্মীয় বাজেটের বৈষম্য দূরীকরণ:

ধর্মীয় বাজেটে বিরাজিত বৈষম্য দূর করে আমানতের সুদের টাকায় পরিচালিত ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টসমূহকে ফাউন্ডেশনে রূপান্তর করা হউক;

ঙ. সাম্প্রদায়িক উস্কানী ও কটুক্তির প্রতিকার বিধান:

সাম্প্রদায়িক উস্কানী ও কটুক্তির প্রতিকারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হউক।

চ. পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা ব্যবস্থায় অসাম্প্রদায়িকতাকে অগ্রাধিকার প্রদান:

পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা ব্যবস্থায় যাবতীয় ধর্মীয় বৈষম্যের অবসান করা হউক।

More From Author

+ There are no comments

Add yours