তারুণ্যের প্রতি

মিতুল চাকমা বিশাল

আমরা এ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়াছি একটা উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে, একটা বাণী প্রচারের জন্য। আলোকে জগৎ উদ্ভাসিত করার জন্য যদি গগণে সূর্য উদিত হয়, গন্ধ বিতরণের উদ্দেশ্যে বন মধ্যে যদি কুসুমরাজি বিকশিত হয়, অমৃতময় বারিদান করিতে তটিনী যদি সাগরাভিমুখে প্রবাহিত হয়, যৌবনের পূর্ণ আনন্দ ও ভরা প্রাণ লইয়া আমরা মর্ত্যলোকে নামিয়াছি একটা সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য।—শ্রী সুভাষ চন্দ্র বোস।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি বর্তমান সময়ে এক নতুন রূপ লাভ করেছে। এটা সর্বস্ব প্রতীয়মান যে, পরিস্থিতি এখন আর চুক্তি পরবর্তী সময় থেকে জরুরী অবস্থার ভেতরকার বাস্তবতার মতন নেই অথবা সেই জরুরী অবস্থা থেকে ২০১৫ সালে অসহযোগ আন্দোলন ঘোষিত হবার পূর্ব সময়কার মতন নেই। এমনকি এটি সেই চুক্তি পূর্ববতী ৮৩-৮৫ পরবর্তী সময় এবং ৮৩-৮৫ পূর্ববর্তী তথা জেএসএস গঠনের সময় হতেও সম্পূর্ণ এক ভিন্ন পরিস্থিতির উপর দাঁড়িয়ে আছে। আর যে এই পরিস্থিতিকে স্বীকার করে না, সে বস্তুর পরিবর্তনকেই স্বীকার করে না। কেননা বস্তু পরিবর্তনশীল, আর সে কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিও নিয়ত পরিবর্তনশীল।

আর আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি বলতে এটাই বলতে চাই যে, এর অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ষাট-সত্তর দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক আর শিক্ষার যে বাস্তবতা ছিল, তা একজন ব্যক্তিকে আত্মকেন্দ্রিক করে তুলতে যথেষ্ট ছিল না। বর্তমান সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার, পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রবেশ মানুষকে দিন দিন আত্মকেন্দ্রিক আর সুবিধাবাদীতে পরিণত করতে ব্যস্ত। কেননা একটি রাষ্ট্রের অর্থনীতির ধরন কিরূপ, সেই অনুসারেই সেই রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা নির্ধারিত হয়। তাছাড়াও সেই চুক্তি পূর্ববর্তী সময়ে আন্দোলনের একটা জোয়ার ছিল, যেটা অবশ্যই সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের জোয়ার। অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। বর্তমানে সেই প্রক্রিয়া নেই বললেই চলে, উদারনৈতিক মুক্তবাজার অর্থনীতি সেটিকে প্রায় রুদ্ধ করে দিয়েছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানও সাংবিধানিক গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য ‘বাকশাল’ গঠন করেছিলেন, যদিও তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। বর্তমান সময়ে সেই সুযোগ এবং বাস্তবতা কোনটাই নেই। সা¤্রাজ্যবাদ আরো হিং¯্র আর নগ্ন হয়ে তার উপনিবেশিকতার শৃঙ্খল বিছিয়ে চলেছে। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রও তার উলঙ্গ চরিত্র নিয়ে ক্রমঅগ্রসরমান। এমনই সংকটময় মুহূর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতীয় ঐক্য ও সংহতি আরো জোরদার করা প্রয়োজন।

এখন বিবেচনা করা দরকার, প্রকৃত ঐক্য কী? কার্যত এই ঐক্যের ভিত্তিইবা কী? কী প্রকারে এটি অর্জিত হয়?

ঐক্য শব্দের অর্থ হচ্ছে মিল, একতা, অভিন্ন, একাত্ম, একাত্মতা, অভেদ, সংহতি, একভাব ইত্যাদি। অতএব সমাজে বসবসাকারী মানুষের মধ্যে পরস্পরের প্রতি মিল, একতা, অভিন্নতা, অভেদ প্রভৃতিই হচ্ছে ঐক্য এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিকভাবে। আর এই সমস্ত কিছুর মধ্যে থাকে একটি সাধারণ উদ্দেশ্য-লক্ষ্য, পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস এবং একটি সুনির্দিষ্ট আদর্শ। পশুদেরও একতা আছে, তারাও ঐক্যবদ্ধ, তবে তাদেরকে আদর্শিকভাবে ঐক্যবদ্ধ কখনও বলা যায় কি! নিঃসন্দেহে না।

তাহলে কার্যত এই ঐক্যের ভিত্তিইবা কী? কী প্রকারেই বা এটি অর্জিত হয়? এটির ব্যাখ্যা সময়, পরিবেশ এবং পরিস্থিতি অনুসারে ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। ভিন্ন হওয়াটা স্বাভাবিক এই কারণেই বলছি যে–

(ক) ধর্মীয় ভিত্তিতেও ঐক্য প্রতিস্থাপিত হয়,

(খ) ভাষার ভিত্তিতেও ঐক্য প্রতিস্থাপিত হয়,

(গ) ভূমি ও রক্তসম্পর্কের ভিত্তিতেও ঐক্য প্রতিস্থাপিত হয় এবং

(ঘ) একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে ঐক্য স্থাপিত হয় ইত্যাদি।

ধর্মীয় ভিত্তিতে ঐক্যর বিষয়টা হরহামেশাই আমাদের দৃষ্টির মধ্যেই ঘটে। এবং যার প্রকৃষ্ট এক উদাহরণ হচ্ছে তথাকথিত জাতিরাষ্ট্রের নাম দিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত এবং পাকিস্তান বিভাজনের ঘটনাটি। দেশভাগের পূর্ববর্তী বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাগুলো সম্পর্কে আমরা কমবেশি সকলেই জানি। আর এ সমস্ত কিছুই ঘটেছিল তাদের পরস্পরের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ধর্মীয় ঐক্যবদ্ধতা থেকে। বর্তমান সময়েও আমরা বহু ধর্মের বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক সংগঠন দেখতে পাই, যাদের প্রকৃত লক্ষ্য হচ্ছে নিজ ধর্মের অনুসারী এবং বিশ্বাসীদের একাত্মতাকে ধরে রাখা। বর্তমান সময়ে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন রাষ্ট্রের কথাও আমরা জানি।

অন্যদিকে ভারতের হিন্দু মহাসভা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ইত্যাদির কথা আমরা জানি, বৌদ্ধদের রয়েছে ওয়ার্ল্ড বুড্ডিষ্ট সংঘ কাউন্সিল, ওয়ার্ল্ড বুড্ডিষ্ট ফোরাম, ওয়ার্ল্ড বুড্ডিষ্ট এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি ইত্যাদি, খ্রীস্টান ধর্মের খ্রীস্টান মিশনারীর কথা আমরা জানি, এবং ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন সংগঠনের কথাও আমরা জানি, যাদের সর্ববৃহৎ সংগঠন হচ্ছে ওআইসি।

ভাষার ভিত্তিতে ঐক্যের ভিত্তিটা আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসটা পর্যালোচনা করলেই দেখতে পাই। ধর্মীয় একতা এবং মিল থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছেদ করতে বাংলাদেশ দ্বিধাবোধ করেনি, আর এর মূলে ছিল প্রধানত ভাষাগত ভিন্নতা। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে উপনিবেশ হিসেবেই শাসন করেছিল, রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাই বাংলাদেশের আপামর জনগণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধাবোধ করেনি।

এভাবেই আমরা ভূমি ও রক্ত সম্পর্কের ভিত্তিতে ঐক্য, সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ ও উদ্দেশ্য-লক্ষ্যের ভিত্তিতে ঐক্যর কথাও বলতে পারি। বর্তমান বিশ্বে একক কোন জাতিরাষ্ট্রের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। তবুও রাষ্ট্রের মানুষ স্বরাষ্ট্রের অখন্ডতা আর সার্বভৌমত্বকে রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চালায়। ধর্ম, জাতি, ভাষা প্রভৃতির ভিন্নতা সত্ত্বেও ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রয়াস করে কেবল ভূমি আর একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শের ঐক্যের ভিত্তিতে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের ঐক্যও নিঃসন্দেহে ভূমি এবং রাজনৈতিক আদর্শ থেকে উদ্ভূত ঐক্য। ভাষাগত ভিন্নতা, ধর্মীয় ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চলে বসবাস করে আসছে বলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ ঐক্যবদ্ধ। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিকে ঘিরেই আমাদের সাংস্কৃতিক ঐক্যও পরিলক্ষিত হয়। ভূমি থাকলেই বন-জঙ্গল থাকে, বন-জঙ্গল থেকেই আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরির সাজ-সরঞ্জাম (ব-হাদি, তাগলক, চুচ্চেক বাঁশ, তুলা, বিয়োং ইত্যাদি) আমরা পাই, এই ভূমিকে ঘিরেই আমাদের খাদ্যভ্যাস, আমাদের জীবিকা (জুম)। অভিন্ন উৎপাদন ব্যবস্থার দ্বারা সৃষ্ট জুমনির্ভর এক সংস্কৃতির ধারক-বাহক আমরা।

সর্বোপরি আমাদের মধ্যে এক আত্মিক মিল রয়েছে, যা আমাদেরকে এক অন্যমাত্রায় বিকশিত করে। অন্যদিকে যুগ যুগ ধরে পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসী জুম্ম জনগণ রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়নের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে আসছে আমাদের জীবন। স্বভাবতই প্রতিটি জুম্ম জাতীয় মুক্তির কামনা করে, বিজাতীয় শোষণ আর শাসনের অবসান চায় এবং আমাদের শত্রু এক, বিজাতীয় শাসক, সা¤্রাজ্যবাদের দালাল, উগ্র জাতীয়তাবাদী, সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র। সুতরাং, আমরা যখনই এই বিজাতীয় শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির আকাঙ্খা প্রকাশ করি, তখন আমাদের লক্ষ্য এক এবং আমরা যখন সেই লক্ষ্যের জন্য কর্মপ্রয়াস করি তখন আমরা ঐক্যবদ্ধ। এখানে ভিন্ন কিছু থাকতে পারে না।

বর্তমান সময়ে জুম্ম জনগণের মধ্যে হতাশা আর নিরাশার বাণী প্রায়শই মুখে মুখে শোনা যায়। বিশেষ করে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতির কথা। বলা হয় স্বল্প সংখ্যার জুম্ম জাতির এত বিভাজন হলে কি চলে?

স্বভাবতই এর স্বপক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি খাড়া করা যায় বটে, তবে বাস্তব সত্যকে তো আমরা অস্বীকার করতেই পারি না। সেটা কি? বাস্তব সত্য এই যে, বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন জাতীয় মুক্তির আন্দোলন কিংবা বুর্জোয়া বিপ্লব অথবা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সমুহে আমরা দেখেছি যে স্ব-শ্রেণির, স্ব-জাতির একটি অংশ বরাবরই সেই আন্দোলন বা বিপ্লবের বিরোধিতা করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামেও তার ব্যতিক্রম ঘটছে না, এখানেও একটি অংশ জুম্ম জনগণের জাতীয় মুক্তির সংগ্রামকে ব্যাহত করতে শাসকগোষ্ঠীর ফাঁদে পা দিয়েছে। তারা বরাবরের মতন জুম্ম জনগণের একটি অংশকে আন্দোলন সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন করে আন্দোলন বিমুখ করে রেখেছে, তবে সেটি কোন মতেই আমাদের জুম্ম জনগণের অধিকাংশ অংশ নয়, আর সেটি কেবল সাময়িকভাবেই তারা করতে পারে এবং এটাই বাস্তব সত্য।

এখানে অনেকেই সংখ্যাগত দিকটি বিচারে আনেন। আন্দোলন কি আসলেই সংখ্যাগত দিক দিয়েই বিচার্য হয় কেবল? অথবা কেবল কি শক্তি বা সামর্থ্য দিয়েই আন্দোলন বা বিপ্লবের সফলতা-বিফলতা নির্ধারিত হয়?

উত্তর না। যদি তাই হতো, তবে ভিয়েতনামের আন্দোলন সফল হতো না, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সা¤্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তারা বিজয় লাভ করতে পারতো না। আমরা কথায় কথায় চে গুয়েভারার কথা বলি, কিন্তু সেই চে গুয়েভারার কিউবা কি আমেরিকার তূলনায় বড় কোন ভূ-খন্ড ছিল? অথবা জনসংখ্যার বিচারে কি মার্কিনীদের চাইতে অধিক ছিল! না।

তাই বাংলাদেশের জনসংখ্যার বিচারে আমরা সংখ্যালঘু হলেও, আমাদের ভূমিতে, আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে, আমরা জুম্ম জনগণই ঐতিহাসিকভাবে সংখ্যাগুরু। পাহাড় ডিঙানোর সামর্থ্য কেবল আমাদেরই রয়েছে। এই বন-পাহাড়-নদী, ঝিড়ি-ঝর্ণা সমস্ত কিছুই আমাদের অনুকূলে, এগুলোই আমাদের ঢাল, আমাদের রক্ষাকবচ।

শুরুতেই ঐক্য সম্পর্কে বলেছিলাম, এখন দেখা যাক আমাদের জুম্ম জনগণের মধ্যে ভাতৃপ্রেম আর ঐক্যর বীজ কতটুকু রোপিত আছে। আমরা সকলেই চাই, পাহাড় থেকে সেনাশাসন প্রত্যাহার হোক। আমরা চাই, পর্যটনের নামে, উন্নয়নের নামে ভূমি দখল বন্ধ হোক, বহিরাগতদের পূনর্বাসন বন্ধ হোক, পাহাড়ে শিক্ষার প্রসার ঘটুক, স্থানীয় প্রশাসন আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকুক এবং পাহাড়িদের জীবন-মান উন্নত হউক। সর্বোপরি আমরা চাই, পাহাড়ে জুম্মদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক এবং সাংবিধানিকভাবে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। তাহলে এ নিয়ে আমাদের কোন দ্বিধা, সংশয়, দ্বিমত থাকারও কোন প্রশ্ন নেই এবং থাকতেও পারে না। আপনারা এমন একটি সকালের কথা চিন্তা করে দেখুন তো, যে সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখবেন পাহাড়ে সেটেলার নেই, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে গেছে, ভূমি দখল নেই, পুলিশগুলো সব স্থানীয় পাহাড়ি-বাঙালি, পাহাড়ে শিক্ষার বিস্তার হচ্ছে এবং ধীরে ধীরে পাহাড়ের জীবন-মান উন্নত হচ্ছে! ভাবতেই হৃদয় শিহরিত হয়ে ওঠার কথা। তাহলে এই যে সমস্যাগুলো এগুলোর সমাধান কিভাবে হবে?

তাহলে দেখা যাক, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী ১৪ টি জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের জন্য ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সেই থেকে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দীর্ঘ দুই দশকের অধিক সশস্ত্র সংগ্রামের ফসল হিসেবে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে পেয়েছি। যে চুক্তিতে স্বীকৃত আছে জুম্মদের রাজনৈতিক অধিকার। তাই এটি এমন একটি আইনী দলিল, যেখানে রাষ্ট্র জুম্মদের রাজনৈতিক অধিকারকে স্বীকার করে নিয়ে পাহাড়ে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থার স্বীকৃতি দিয়েছে। আর কিছু না হোক পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ চায়, এই চুক্তি বাস্তবায়ন হোক এবং তা অতিদ্রুত করা হোক। কেননা এই পার্বত্য চুক্তিই আমাদের জাতীয় মুক্তির প্রথম পদক্ষেপ। সেনাশাসন প্রত্যাহার, ভূমি দখল বন্ধ, সেটেলার/বহিরাগত পুনর্বাসন ও পুনর্বাসিত সেটেলারদের সম্মানজনকভাবে সমতলে পূনর্বাসন, স্থানীয় পুলিশ, কোটা, উন্নয়ন সমস্ত বিষয়াদির যত সমস্যা, সেগুলো এই পার্বত্য চুক্তি সমাধান দিতে পারে।

অতএব, আমরা যখনই সেনাশাসন প্রত্যাহার, ভূমি দখল কিংবা জেলা পরিষদ ইত্যাদি নিয়ে কথা বলছি, তখনই আমরা অবচেতন মনেই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য দাবি করছি। আর জনসংহতি সমিতি সেই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য বিগত ২৭টি বছর ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছে এবং ২০১৫ সালে এই লক্ষ্যে ১০ দফা ভিত্তিক অসহযোগ আন্দোলনও ঘোষণা দিয়েছে। তাহলে আমাদের মধ্যে বিভাজন হতে পারে কোন যুক্তিতে? আদৌ কি মনে হয় আমরা ঐক্যবদ্ধ নয়?

সুতরাং আমরা যখনই সেনাশাসন প্রত্যাহার, ভূমি দখল বন্ধ, সেটেলারদের সমতলে পূনর্বাসন তথা চুক্তির পক্ষ নিয়ে কথা বলি, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ যখন এই চুক্তির পক্ষ নিয়ে কথা বলে তখন আমাদের লক্ষ্য এক এবং যখনই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়াস চালায় তখন আমরা ঐক্যবদ্ধ। অপরপক্ষে, যারা এই চুক্তি বাস্তবায়নের বিপক্ষে এবং চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে যারা নস্যাৎ করতে চায়, তারা আমাদের শত্রুরূপেই পরিগণিত। যেমনটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র, সেনাবাহিনী, বহিরাগত সেটেলার, অসাধু আমলাতন্ত্র এবং সেনাবাহিনীর লেজুর করা জুম্ম দালাল। এটিও বাস্তব সত্য। সুতরাং আমাদের লক্ষ্য এক, শত্রুও এক, আর আমরা সেই লক্ষ্য পূরণে অবিচল এবং শত্রুকে উৎখাত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তাই আমরা ঐক্যবদ্ধ। অতএব, আমাদের ঐক্যের প্লাটফর্মটা হবে চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন করা এবং সে অনুযায়ী কর্মসূচি ঘোষণা করা। এখানেও ভিন্ন কিছু থাকতে পারে না।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি, সংগ্রামের ইতিহাস এবং আন্দোলনের গভীর উপলব্ধি সম্পর্কে বর্তমান তরুণ সমাজের কাছে ধারণা থাকা আবশ্যক এবং কেবল আবশ্যকই নয়, এটা অত্যন্ত জরুরীও বটে। অনেক মিডিয়া, সংবাদমাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে উদ্ভট যত সব তথ্য উপস্থাপন করে জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে এক ভিন্নরূপে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। রাষ্ট্রযন্ত্রের পা চাটা বাহিনীর দ্বারা তারুণ্যকে বিভ্রান্ত করে তাদেরকে বিপদগামী করে তোলা হচ্ছে। তাই সত্যকে জানার প্রয়াস করা তারুণ্যের একান্ত কর্তব্য। কেননা, যে লোক তার চোখ কান বন্ধ রাখে এবং সম্পূর্ণভাবে নিজেকে বাস্তব বহির্জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে, তার জন্যে জ্ঞান বলে কিছু থাকতে পারে না।

অভিজ্ঞতা থেকেই জ্ঞানের সূচনা- এই হল জ্ঞানতত্ত্বের বস্তুবাদ। দ্বিতীয় বিষয়টি হল এই যে, জ্ঞানকে গভীরতর করা দরকার, জ্ঞানের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পর্যায়কে যুক্তিসহ পর্যায়ে উন্নীত করা প্রয়োজন- এটাই হল জ্ঞানতত্বের দ্বন্দ্ববাদ।

যুক্তিসহ জ্ঞান নির্ভর করে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানের উপর এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানকে উন্নীত করতে হয় যুক্তিসহ জ্ঞানে- এটাই হচ্ছে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্ব। জুম্ম জনগণের আন্দোলন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার কোন অবকাশ নেই, সেই আন্দোলনে নিজেকে সঁপে দিয়ে এক নতুন মাত্রায় বিকশিত করা দরকার। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে, সেই জ্ঞানকে আরো গভীর থেকে গভীরতর করতে সমাজের বাস্তব অনুশীলনে অংশগ্রহণ করাও জরুরী। নিজের উপর অর্পিত ঐতিহাসিক দায়িত্বকে বহন করার সামর্থ্য অর্জন করতেই হবে এবং সেটা অবশ্যই এই জুম্ম জনগণের স্বার্থে, পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বার্থে।

সুভাষচন্দ্রের ভাষায় যেটা শুরুতেই বলেছি, আমরা এ পৃথিবীতে আসিয়াছি এক উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে। সেই উদ্দেশ্যকে পূরণ অবশ্যই করতে হবে। যারা আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করছে, তাদের বিরুদ্ধে নামতে হবে, তাদেরকে প্রতিরোধ করতে হবে। প্রতিরোধের সেই শক্তিকে জাগ্রত করতে হবে, সুপ্ত আগ্নেয়াগিরিকে প্রজ্জ্বলিত করতেই হবে এবং এই সময়ে তারুণ্যের কর্তব্য সেটাই হওয়া উচিত।

More From Author

+ There are no comments

Add yours