জুরাছড়িতে পুলিশের উপর সেনাবাহিনীর হামলা, থানায় অগ্নিসংযোগ: সেনাশাসনেরই জ্বলন্ত প্রমাণ

হিল ভয়েস, ২৮ আগস্ট ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক: গতকাল (২৭ আগস্ট) রাঙ্গামাটি জেলার জুরাছড়ি উপজেলা সদরে জোন কমান্ডারের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর সদস্যদের কর্তৃক পুলিশের উপর হামলা, জনসাধারণকে মিছিল করতে বাধ্য করা এবং সশস্ত্রভাবে থানায় আক্রমণ, থানাসহ দোকানপাটে অগ্নিসংযোগের ঘটনা যে পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান সেনাশাসনেরই এক নগ্ন ও জ্বলন্ত প্রমাণ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

কয়েকজন চাকমা পুলিশ সদস্য অনিচ্ছাকৃতভাবে হোক বা ইচ্ছাকৃতভাবে হোক পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় জোন কমান্ডারকে সালাম দেয়নি- এমন তুচ্ছ অভিযোগ থেকেই সেনা সদস্যরা কেবল সেই চাকমা পুলিশ সদস্যদেরকেই অমানবিকভাবে মারধর করেনি, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সহ পাহাড়ি-বাঙালি সব পুলিশ সদস্যকেই মারধর করে এবং থানায় অগ্নিসংযোগ সহ এমন তুলকালামকান্ড ঘটায়।

সেনাবাহিনীর নির্বিচার মারধরের কারণে তিন চাকমা পুলিশ এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: আব্দুস সালাম গুরুতর জখম হয়েছেন বলে জানা গেছে। তারা বর্তমানে জুরাছড়ি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আহত চাকমা পুলিশদের মধ্যে দয়াল চাকমা ও তুহিন চাকমার পরিচয় পাওয়া গেলেও আরেকজনের নাম পাওয়া যায়নি।

ঘটনার বিবরণে জানা যায়, গতকাল বিকাল ৫ টার দিকে জুরাছড়ি উপজেলার বনযোগীছড়া সেনা জোনের জোন কমান্ডার জুলফিকলী আরমান বিখ্যাত তার দুই সৈনিক নিয়ে সাদা পোশাকে উপজেলা সদরে হাঁটতে বের হন। হাঁটতে হাঁটতে তারা জুরাছড়ি থানার সামনের পথ দিয়ে হেঁটে যান। এসময় থানার সামনে পথের পাশে থাকা একটি চায়ের দোকানে বসে অন্যান্যদের সাথে চা খেতে খেতে গল্পগুজব করছিলেন তিন চাকমা পুলিশ সদস্য।

জোন কমান্ডার চায়ের দোকানটি অতিক্রম করার পরপরই জোন কমান্ডারের সাথে থাকা রানার হিসেবে পরিচিত সার্জেন্ট মঞ্জু পেছনে ফিরে চায়ের দোকানে প্রবেশ করে জোন কমান্ডারকে কেন সালাম দেয়নি- এই অভিযোগ তুলে তিন চাকমা পুলিশ সদস্যকে থাপ্পর ও ঘুষি মারতে থাকে। এক পর্যায়ে সেনা সদস্যের আচমকা আক্রমণে হতবুদ্ধি পুলিশরাও সেনা সদস্যের সাথে হাতাহাতি করে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে হাতাহাতি থামিয়ে সেনা সদস্য উপজেলা সদরের যক্ষাবাজার সেনা ক্যাম্পে এবং পুলিশ সদস্যরাও থানায় ফিরে যায়।

এর কিছুক্ষণ পরে সন্ধ্যা আনুমানিক ৬ টার দিকে জোন কমান্ডার জুলফিকলী আরমান বিখ্যাত এর নেতৃত্বে ২০-২৫ জনের একটি সেনাদল যুদ্ধংদেহী ভঙ্গীতে অস্ত্রশস্ত্র ও লাঠি-সোটা নিয়ে থানার দিকে ছুটে আসে। থানার উঠোনে পৌঁছেই সেনা সদস্যরা প্রথমে আকাশের দিকে এক রাউন্ড এবং এরপর মাটিতে দুই রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে থানার ভেতরে প্রবেশ করে যাকে যেখানে পেয়েছে সেখানে নির্বিচারে সকল পুলিশকে লাঠিসোটা ও কিল-ঘুষি দিয়ে মারধর করে। এদের মধ্যে স্বয়ং ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও তিন চাকমা পুলিশ সদস্য সবচেয়ে বেশি মারধরের শিকার হন। কোনো কোনো পুলিশ যে যেদিকে পারে পালিয়ে যান।

এরপর সেনা সদস্যরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও তিন চাকমা পুলিশ সদস্যকে বেঁধে বনযোগীছড়া সেনা জোনের অধীন উপজেলা সদরের যক্ষা বাজার সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যান।

শুধু তাই নয়, থানায় পুলিশ সদস্যদের হামলার পাশাপাশি একই সময়ে সেনাবাহিনী থানার পার্শ্ববর্তী বাজার ও বসতির দোকানদার ও পাহাড়ি-বাঙালি জনসাধারণকে পুলিশের দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ তুলে তাৎক্ষণিকভাবে মিছিল করতে বাধ্য করে।

একই সাথে সন্ধ্যা আনুমানিক ৬:৩০ টা-৭ টার দিকে সেনা সদস্যরা নিজেরাই থানায় অগ্নিসংযোগ করে এবং থানার একটি সরকারি গাড়ি, থানার সামনে থাকা কয়েকটি চায়ের ও মুদির দোকান জ্বালিয়ে দেয়। পরে সেনাবাহিনী ‘বিক্ষুব্ধ জনতা পুড়িয়ে দিয়েছে’-এমন প্রচার করেছে বলে জানা যায়।

এসময় থানার পুলিশরা ছত্রভঙ্গ হয় এবং উপজেলা সদর সহ আশেপাশের পাহাড়ি গ্রামে ব্যাপক আতঙ্ক ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়।

এসময় বাংলাদেশ পুলিশের সদস্য পরিচয়দানকারী মোঃ এমরান হোসেন ( BP Md Amran Hosen ) নামের এক ফেসবুক পেইজ থেকে আতঙ্ক প্রকাশ করে লেখেন, “আমি এসআই রিয়াদ জুরাছড়ি থানা, রাঙ্গামাটি থেকে। আজ বিকেলে আমাদের থানার ০৩ জন চাকমা কং থানার পাশে যক্ষাবাজারে চা পান করতে যায়। ওখানে আর্মির সিও স্যার ওনার পরিবার সহ ছিলো, কিন্তু চাকমা কংরা সালাম না দেওয়ায় ওদের অনেক মারছে এবং হাটুর কাছে তিনটা ফায়ার করছে এবং ধরে ক্যাম্পে নিয়ে গেছে। ওসি সহ আমরা সবাই ঘটনা এসপি স্যারকে জানালে স্যার ক্যাম্পে যেতে বলে। আমরা যেতে চাইলে ক্যাম্পের সামনে আটকে দেয় এবং ওসি সহ সবাইকে মারতে শুরু করে। আমি কোনো রকমে একটা ঘরে আশ্রয় নিছি।..”

পরে একের পর এক সামাজিক মাধ্যমে থানায় অগ্নিসংযোগ, সেনাবাহিনী কর্তৃক পুলিশ সদস্যদের মারধর, আহত পুলিশ সদস্যদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ভিডিও ও ছবি প্রকাশ পায় এবং ঘটনার নিন্দা জানিয়ে ও উদ্বেগ প্রকাশ করে অনেকে লেখালেখি শুরু করেন।

সর্বশেষ, রাত ১২ টা/সাড়ে ১২ টার দিকে রাঙ্গামাটি থেকে পুলিশ সুপার এবং কয়েকটি স্পীড বোটে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা জুরাছড়িতে যান বলে খবর পাওয়া যায়।

তবে রাতে বিষয়টি কিভাবে সূরাহা করা হয়েছে এবং উর্ধতন কর্তৃপক্ষ থেকে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা এখনো পর্যন্ত জানা যায়নি।

আজ (২৮ আগস্ট) এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জানা গেছে, এস আই মোরশেদ এর ডান পা ভেঙে দিয়েছে, এস আই নাছির উদ্দীন এখনও জ্ঞান ফেরেনি, ওসি আব্দুস সালাম এর বাহু ভেঙে দিয়েছে এবং ৩ জন অফিসার ও ৩ জন চাকমা কনস্টেবল সহ মোট ১২ জন পুলিশ সদস্যকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাঙ্গামাটি প্রেরণ করা হয়েছে। এদের মধ্যে কনস্টেবল রাব্বি নামের এক পুলিশ সদস্য আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে। বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার ও এস পি রাঙামাটি থেকে এসে জুরাছড়ি উপজেলার ইউ এনও সহ আলোচনায় রয়েছেন। আর রাঙ্গামাটি থেকে আজ সকালে ২টি ট্রলার বোট যোগে পুলিশ সদস্য আনা হয়েছে বলে জানা গেছে।

স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, জোন কমান্ডার জুলফিকলী আরমান বিখ্যাত কোনো কারণে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার উপর নাখোশ ছিলেন। জোন কমান্ডার কর্তৃক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দুর্নীতিতে জড়িত বলে অভিযোগ করার কথা শোনা যায়।

তবে, এব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অধিকার কর্মী বলেন, শোনা যায় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিভিন্ন ব্যবসায় বা উন্নয়ন খাত থেকে একটি অংশ আদায় করে দুর্নীতি করেন, কিন্তু জোন কমান্ডার জুলফিকলী আরমান বিখ্যাত তো তার চেয়ে ১০ গুণ দুর্নীতি করে থাকেন। তিনি বলেন, জুরাছড়িতে গাছ, বাঁশ, ফসল, ব্যবসায়িক মালামাল সহ একটি পাতাও এদিক থেকে ওদিকে যেতে পারে না জুলফিকলী আরমান বিখ্যাত’কে তার ভাগের অংশ না দিয়ে।

এছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে, এই জোন কমান্ডারের বিরুদ্ধে এলাকায় সাধারণ জুম্মদের নানা অজুহাতে মারধর, আটক, হয়রানি, তল্লাসি ইত্যাদি মানাধিকার লংঘন করা, জুরাছড়ি সদরে বাঙালি ব্যবসায়ী ও স্থানীয় জুম্মদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির জন্য একাধিক ষড়যন্ত্র সহ সাম্প্রদায়িক উস্কানি এবং স্থানীয় নির্বাচনে নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ রয়েছে। একবার তিনি যাবার আগে কোনো ঘটনা ঘটিয়ে যাবেন বলেও প্রকাশ্যে হুমকি প্রদানের কথা জানা যায়।

জানা গেছে, কয়েক মাস আগে জোন কমান্ডার জুলফিকলী আরমান বিখ্যাত এর অন্যত্র বদলির আদেশ এলেও রহস্যজনক কারণে তিনি এখনো সেখানে বহালতবিয়তে রয়েছেন।

More From Author

+ There are no comments

Add yours