জুম্ম জনগণের জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ়করণ প্রসঙ্গে

উদয়ন তঞ্চঙ্গ্যা

 

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন তথা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে জুম্ম জাতীয় ঐক্য ও সংহতি অধিকতর সুদৃঢ় করার আহ্বান অব্যাহতভাবে জানিয়ে আসছে। জনসংহতি সমিতি তার প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনে জুম্ম জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করার রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারী, প্রতিক্রিয়াশীল ও সুবিধাবাদী মহল বরাবরই গোড়া থেকে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে গলাটিপে হত্যা করার এবং জুম্ম জনগণের জাতীয় ঐক্য ও সংহতির উপর আঘাত করার ষড়যন্ত্র করে আসছে। সত্তর দশকের গোড়াতেই পাহাড়ি যুব সংঘ, ট্রাইবাল পিপলস পার্টি (টিপিপি), বামাঞাতা গ্রুপ, পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি ও এর সহযোগী সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম গণমুক্তি পরিষদ ইত্যাদি সশস্ত্র সংগঠনের প্রতিবিপ্লবী অপতৎপরতার মাধ্যমে জুম্ম জনগণের ঐক্য-সংহতিতে বিভাজন তৈরীর অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল। এসব অপতৎপরতার বিরুদ্ধে বিচক্ষণতার সাথে সুসংহত নেতৃত্বের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই-সংগ্রাম করে জুম্ম জনগণ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে এগিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।

এমনকি সরকারের মদদপুষ্ট ট্রাইবাল কনভেনশনের মতো সুবিধাবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র সফলভাবে মোকাবেলা করে জুম্ম জনগণের ঐক্য-সংহতি অবিচল রেখে জনসংহতি সমিতি গণমানুষের আন্দোলনকে বেগবান করতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে আশি দশকে গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের সুবিধাবাদী, ক্ষমতালিপ্সু ও উচ্চাভিলাষী গোষ্ঠীর চক্রান্ত, বিভেদপন্থী অপতৎপরতা ও পার্টি-শৃঙ্খলা পরিপন্থী আত্মঘাতি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বিচক্ষণতার সাথে মোকাবেলা ও নিষ্পত্তি করে জনসংহতি সমিতি জুম্ম জনগণের ঐক্য-সংহতি বজায় রেখে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে, যদিও উপদলীয় চক্রান্তে বিভেদপন্থীদের বিশ্বাসঘাতকতামূলক অতর্কিত সশস্ত্র আক্রমণে জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে হারাতে হয়েছিল। এসব ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে জোরালো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনসংহতি সমিতি এক পর্যায়ে ১৯৯৭ সালে সরকারকে বাধ্য করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে উপনীত হতে, যে চুক্তিতে জুম্ম জনগণসহ পার্বত্যবাসীর স্বশাসনের অধিকার, ভূমিসহ অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম-অধ্যুষিত বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের অধিকারের ভিত্তি রচিত হয়েছে।

অত্যন্ত দু:খজনক যে, সেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে বিরোধিতা করে তরুণ প্রজন্মের একটি গোষ্ঠী ‘ইউপিডিএফ’ নামে একটি স্বতন্ত্র সংগঠন গড়ে তোলে। যার ফলে জুম্ম জনগণ কিছু মাত্রায় দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং জুম্ম জনগণের ঐক্য ও সংহতির উপর এক ধরনের সংকট তৈরী হয়। সেই সংকটের উপর মরার উপর খাড়ার ঘা-এর মতো ২০০৭-২০০৮ সালে জরুরী অবস্থা চলাকালে ১/১১-এর তথাকথিত সংস্কারের জোয়ারে সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্রে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বের মধ্যে কিছু মাত্রায় বিভেদ ও বিভাজন সৃষ্টি হয়। জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বের প্রতি এখনো আপামর জনগণের বিপুল আস্থা-বিশ্বাস ও সমর্থন সত্ত্বেও একথা নি:সন্দেহে বলা যায় যে, বর্তমান সময়ে জুম্ম জনগণের আন্দোলন ছোট-বড় কয়েকটি ধারায় বিভক্ত যা জুম্ম জনগণের একমুখী আন্দোলন ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে অন্যতম একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে জুম্ম স্বার্থ বিরোধী জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সুবিধাবাদী ও সুযোগসন্ধানী কতিপয় পাহাড়ির যোগদান, যা জুম্ম জনগণের দ্বিধা-বিভক্তিকে আরো ত্বরান্বিত করে চলেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে নস্যাৎ করা এবং জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়ার জন্য সেনাবাহিনী কর্তৃক আরো একের পর এক সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ সৃষ্টি ও আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া হয়। এসব গ্রুপের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাজার পার্টি খ্যাত ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), মগ পার্টি খ্যাত মারমা ন্যাশনাল পার্টি এবং বম পার্টি খ্যাত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। এসব গ্রুপের কোন রাজনৈতিক চরিত্র নেই। তাদের মূল কাজ হলো সেনাবাহিনীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা।

বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রয়েছে। আপামর জুম্ম জনগণসহ দেশে-বিদেশে প্রবল দাবি সত্ত্বেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো বাস্তবায়নে শেখ হাসিনা সরকার চরম উদাসীনতা ও নির্লিপ্ততা প্রদর্শন করেছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নকে সম্পূর্ণ বন্ধ রেখে বা এক পাশে রেখে শেখ হাসিনা সরকার অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার হীন উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরিপন্থী ও জুম্ম স্বার্থ বিরোধী কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে জুম্মদের জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করেছিল। দেশের শাসকগোষ্ঠী একদিকে ‘ভাগ করো শাসন করো’ এই নীতির ভিত্তিতে জুম্ম জনগণের আন্দোলন ও নেতৃত্বকে দ্বিধাবিভক্ত করে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির উপর আঘাত হেনেছিল, অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের ব্যানারে সেটেলার বাঙালিসহ সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তিকে লেলিয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি বেদখল, জুম্ম নারীর উপর হত্যা ও ধর্ষণ, অবাধে অব্যাহত অনুপ্রবেশ ইত্যাদির মাধ্যমে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব ধ্বংসের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করেছিল।

পূর্বের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল ক্ষেত্রে এখনো সেনা কর্তৃত্ব এবং বৈরী জেলা ও উপজেলা প্রশাসন যৌথভাবে ইসলামিকরণের ষড়যন্ত্র অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। নানা কলাকৌশলের মাধ্যমে অতি সুক্ষ্ম উপায়ে দেশের সমতল অঞ্চল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে। প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে জুম্ম জায়গা-জমি জবরদখলের প্রক্রিয়া জোরদার করা হয়েছে। জুম্মদের প্রথাগত ভূমি অধিকারকে পদদলিত করে জুম্মদের মৌজা ও জুম ভূমির উপর সেনাবাহিনীর কতৃত্বে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। বহিরাগত প্রভাবশালীদের কাছে শত শত একর ভূমি ইজারা প্রদান করে এবং পদ্ধতি-বহির্ভুতভাবে রিজার্ভ ফরেষ্ট ঘোষণা করে জুম্মদেরকে তাদের গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ এক নিরাপত্তাহীন ও অনিশ্চিত জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হচ্ছে। জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব আজ বিলুপ্তির দাঁড়প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।

এমনিতর পরিস্থিতিতে আজ প্রশ্ন উঠে এসেছে যে, জুম্ম জনগণের এ সংকট থেকে উত্তরণের উপায় কি? এটা নি:সন্দেহে বলা যায় যে, এই জাতীয় সংকট থেকে উত্তরণের অন্যতম উপায় হচ্ছে জুম্ম জাতীয় ঐক্য ও সংহতি অধিকতর সুদৃঢ় করা। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এই জাতীয় ঐক্য ও সংহতি কিভাবে সুদৃঢ় হতে পারে। কিভাবে গড়ে তোলা যেতে পারে জুম্ম জনগণের ইস্পাত-কঠিন ঐক্যে অধিকতর সুদৃঢ় জাতীয় নেতৃত্ব। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অধিকতর সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্য ও সংহতি ব্যতীত কোন আন্দোলন-সংগ্রাম সফল হতে পারে না তা বিশ্বের দেশে দেশে সংগ্রামী ইতিহাসে দেখা গেছে। যে কোন আন্দোলন-সংগ্রামে বিভেদ-বিভাজন দেখা দিলে এবং আন্দোলনের নেতৃত্ব যদি একাট্টা না হয়ে খন্ড খন্ড হয়ে পড়ে তাহলে সে আন্দোলন-সংগ্রাম কখনোই সফল হতে পারে না।

পক্ষান্তরে দেখা গেছে যে, যে সকল নিপীড়িত জাতি তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন, আন্দোলনের কর্মসূচি ও নেতৃত্বকে অবিচলভাবে ইস্পাত-কঠিন ঐক্যে সুদৃঢ়, একমুখী ও একাট্টা রাখতে সক্ষম হয়েছে সে সকল জাতি তাদের আন্দোলন-সংগ্রামে জয়ী হয়েছে। জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনেও দেখা গেছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির উপর হানিকর নানা ঘটনা-প্রবাহ উপস্থিত হলেও সেসব পরিস্থিতিকে সফলভাবে মোকাবেলা করে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় রেখে আন্দোলন, আন্দোলনের কর্মসূচি ও নেতৃত্ব একমুখী ছিল বলে জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু চুক্তি পরবর্তী সময়ে চুক্তিকে কেন্দ্র করে এবং সর্বোপরি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের ফলে এই একমুখী আন্দোলন, কর্মসূচি ও নেতৃত্বের ব্যত্যয় ঘটে এবং এর ফলে জুম্ম জনগণের জাতীয় আন্দোলনে এক চরম সংকট তৈরী হয় যা জুম্ম জাতির অস্তিত্ব ও নিরাপত্তাকে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে নিক্ষেপ করে। তাই জুম্ম জাতির আসন্ন এই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হচ্ছে চুক্তি-পূর্ব সময়ের মতো জুম্ম জনগণের আন্দোলনকে, আন্দোলনের কর্মসূচিকে এবং জাতীয় নেতৃত্বকে একমুখী করা এবং ইস্পাত-কঠিন ঐক্যে একাট্টা করা। প্রশ্ন হলো- কি ও কিভাবে অর্জিত হতে পারে সেই একমুখী আন্দোলন, নির্ভুল ও বাস্তব-সম্মত একমুখী কর্মসূচি এবং ইস্পাত-কঠিন ঐক্যে সুদৃঢ় একমুখী নেতৃত্ব?

বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বহুধা বিভক্ত কর্মসূচির ভিত্তিতে জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে কালো চুক্তি আখ্যায়িত করে ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন’ আদায়ের নামে ইউপিডিএফ আন্দোলন পরিচালনা করে চলেছে। সংস্কারপন্থী গোষ্ঠীও ভিন্ন ধারায় বাহ্যত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনের বুলি তুলে ধরছে। রাজনৈতিক কর্মসূচিগত ঐক্য ও সংহতি যদি না থাকে তাহলে কখনোই সেই আন্দোলন সুসংগঠিত ও একাট্টা হতে পারে না। কর্মসূচিগত ভিন্নতা আন্দোলনকে দুর্বল ও বিভক্ত করতে বাধ্য। তাই জুম্ম জনগণের এই আন্দোলনকে অবশ্যই নির্ভুল ও বাস্তবোপযোগী একমুখী কর্মসূচিতে রূপান্তর করতে হবে। তবেই এই আন্দোলন শক্তিশালী ও জোরদার হতে পারে এবং জুম্ম জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় হতে পারে। তাহলে কি হতে পারে সেই নির্ভুল ও বাস্তব-সম্মত একমুখী কর্মসূচি?

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি আজ জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক দলিল ও হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এই চুক্তিকে কেন্দ্র করে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে লড়াই-সংগ্রাম ও জনমত গঠনের আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে। জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম ও এমরিপ, ইকোসক, মানবাধিকার পরিষদ, আইএলও ও ইউএনডিপিসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিভিন্ন মানবতাবাদী রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার রয়েছে যা আন্দোলনের অন্যতম সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। জুম্ম জনগণ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে একাট্টা রয়েছে যা আন্দোলনের আভ্যন্তরীণ ভিত্তি হিসেবে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করছে। সুতরাং জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের আশু কর্মসূচি হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিকে কেন্দ্র করে জুম্ম জনগণের আন্দোলন সুসংহত ও একমুখী করা অপরিহার্য বলে বিবেচনা করা যায়। ভিন্ন ভিন্ন একাধিক কর্মসূচি ভিত্তিতে পৃথক পৃথক আন্দোলন বজায় রাখলে কখনোই জুম্ম জনগণের আন্দোলন একমুখী হতে পারে না, শক্তিশালী হতে পারে না, সর্বোপরি জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় হতে পারে না।

১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব টিকে থাকার মতো ভিত্তি বা অধিকার স্বীকৃত হয়েছিল। চুক্তিতে আইন পরিষদ সম্বলিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের অধিকার অর্জিত না হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের মর্যাদার স্বীকৃতি ও সেই বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ; পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন যার উপর সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি, বন, পরিবেশসহ ৩৩টি বিষয় অর্পিত; পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকরিতে জুম্মদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ; বেদখলকৃত জুম্মদের ভূমি ফেরতদানসহ ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি; শরণার্থী ও উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন; সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার; স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও বহিরাগতদের জায়গা-জমি মালিকানায় বাধা-নিষেধ; জাতীয় পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন ইত্যাদি অধিকারগুলো স্বীকৃত হয়েছে। সুতরাং চুক্তির মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের অধিকারগুলো নিহিত রয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় স্বশাসনের অধিকারগুলো নিশ্চিত করা যায় বলে বলা যেতে পারে। সুতরাং চুক্তি বাস্তবায়নের কর্মসূচির ভিত্তিতে জুম্ম জনগণের আন্দোলনের কর্মসূচিকে একমুখী করার যুগোপযোগী বাস্তবতা রয়েছে বলে বিবেচনা করা যায়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিকে কেন্দ্র করে জুম্ম জনগণের আন্দোলনকে কেবল একমুখী করলে হবে না, তার সাথে জুম্ম জনগণের জাতীয় নেতৃত্বকেও ইস্পাত-কঠিন ঐক্যে একাট্টা করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি-পূর্ব সময়ের মতো জুম্ম জনগণের নেতৃত্বকে একাট্টা করা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। এক মুষ্টিতে আঘাত করলে আঘাত যত তীব্র ও শক্তিশালী হবে, দুই মুষ্টিতে আঘাত করলে তা তত জোরালো হতে পারে না। এক মুষ্টিতে আঘাত করলে শরীরের সর্বশক্তি একত্রিত হয়ে আঘাত তীব্রতর হয়ে থাকে। কিন্তু দুই মুষ্টিতে আঘাত করলে শরীরের শক্তি বিভক্ত হয়ে আঘাতের জোরও দুর্বল হয়ে পড়ে। এজন্য এক মুষ্টিতে আঘাত করার মতো জুম্ম জনগণের সর্বশক্তিকে একত্রিত করে শাসকগোষ্ঠীর উপর তীব্রতর আঘাত হানার নিমিত্তে জুম্ম জনগণের আন্দোলন ও আন্দোলনের নেতৃত্বকে একমুখী ও একাট্টা করার কোন বিকল্প নেই।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বর্তমানে জুম্ম জনগণের আন্দোলন বহুধা বিভক্ত। যার ফলশ্রুতিতে জুম্ম জনগণের নেতৃত্বও বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত। আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও জুম্ম জনগণের কতিপয় সুবিধাবাদী ও সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে বা হচ্ছে। এধরনের বহুধা বিভক্ত ঝোঁকগুলো জুম্ম জনগণের জাতীয় ঐক্য ও সংহতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে যা শাসকগোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। এখন প্রশ্ন হতে পারে– এই বহুধা বিভক্ত জুম্ম নেতৃত্বকে কিভাবে ইস্পাত-কঠিন ঐক্যে সুদৃঢ় ও একাট্টা করা যায়? কার নেতৃত্বে ও কোন পতাকাতলে কিভাবে ও কি উপায়ে সুসংহত নেতৃত্ব গড়ে তোলা যায়?

এটা অনস্বীকার্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির দীর্ঘ চার দশকের অধিক গৌরবময় সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। ১৯৭২ সাল থেকে এখনো পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার গৌবরময় সংগ্রামের নেতৃত্বশীল ভূমিকা পালন করে চলেছে। চারদফা সম্বলিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ১৯৭২ সালে জুম্ম জনগণের স্বাধিকার আন্দোলনের যে নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটেছিল তা আজো পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে অব্যাহত গতিতে বেগবান রয়েছে। জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে ১৯৯৭ সালে জুম্ম জনগণের অধিকারের সনদ — ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি — স্বাক্ষরিত হয়েছিল যা দেশে-বিদেশে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষরকারী রাজনৈতিক দল হিসেবে সকল ক্ষেত্রে তার একটা স্বীকৃতি রয়েছে। দেশে-বিদেশে এখনো জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বের গ্রহণযোগতা ও পরিচিতি রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী হিসেবে জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার গ্রহণযোগ্যতা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও নেতৃত্বের প্রশ্নে সাধারণ মানুষ এখনো আস্থাশীল। তাই জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে জুম্ম জনগণের আন্দোলনকে একমুখী করার পাশাপাশি জনসংহতি সমিতির পতাকাতলে জুম্ম জনগণের জাতীয় নেতৃত্বকে একাট্টা করা জরুরী ও অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে বিবেচনা করা যায়। জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে সকল প্রকার দল-মত-চিন্তাধারার উর্ধ্বে উঠে এই বাস্তবতাকে গ্রহণ করে জুম্ম জনগণকে অগ্রসর হওয়ার ভিত্তি বিরাজ করছে বলে বিবেচনা করা যায়। এক্ষেত্রে অবশ্যই বিভিন্ন দল-মত-চিন্তাধারার কর্মীবাহিনীকে পদ্ধতিগতভাবে জনসংহতি সমিতির রাজনৈতিক ধারায় সংহতিকরণে জনসংহতি সমিতিকে যেমনি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক পরিবেশ তৈরী করতে হবে, তেমনি অন্যান্য ভিন্ন দল-মতালম্বী কর্মীবাহিনীকে জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

অবশ্য অনেকে মনে করেন যে, একমুখী কর্মসূচি ও নেতৃত্বের পরিবর্তে বিভিন্ন দল-মত অক্ষুন্ন রেখে যৌথ কর্মসূচির মাধ্যমেও আন্দোলনকে শক্তিশালী ও জোরদার করা যায়। আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর যৌথ কর্মসূচির মাধ্যমে একযোগে আন্দোলন পরিচালনার যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার চিন্তা-ভাবনা তা জাতীয় ঐক্য ও সংহতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে ভাবা যেতে পারে। জাতীয় ঐক্য-সংহতি সুদৃঢ়করণের স্বার্থে তথা জুম্ম জনগণের আন্দোলনকে একমুখী ও নেতৃত্বকে একাট্টা করার ক্ষেত্রে এ ধরনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সাময়িক কর্মসূচি হিসেবে হয়তো গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে এটা স্বীকার করতে হবে যে, এ ধরনের ঐক্য-সমঝোতা আপাত সময়ের জন্য গ্রহণযোগ্য হলেও চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কখনোই কার্যকর ও ফলপ্রসু নয় বলে বিভিন্ন দেশের আন্দোলন-সংগ্রামে তার উদাহরণ রয়েছে।

ইস্যু ভিত্তিক বা কর্মসূচি ভিত্তিক যুগপৎ আন্দোলন জাতীয় ঐক্য-সংহতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বরাবরই বিভেদ রেখাকে জিইয়ে রাখে। যৌথ কর্মসূচি ভিত্তিক সম্মিলিত আন্দোলন বরাবরই আন্দোলনকে বহুধা বিভক্ত ও নেতৃত্বকে দুর্বল করে রাখে। পৃথক পৃথক দল ও মত বজায় রেখে যে কোন জোটবদ্ধ আন্দোলন কখনোই দীর্ঘমেয়াদে শক্তিশালী থাকতে ও ইস্পাত-কঠিন ঐক্যে টিকে থাকতে পারে না। তাই যে কোন আন্দোলন-সংগ্রামকে তার বিজয়ের দাঁড়প্রান্তে নিতে হলে অবশ্যই একমুখী হতে হয়, একক সংগঠনের নেতৃত্বে সকল প্রকার ও সকল পক্ষের শক্তিকে সুসংহত করতে হয়, সর্বোপরি একই ধারার নেতৃত্বের অধীনে জাতীয় ঐক্য ও সংহতিকে একাট্টা করতে হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দল ও মতের স্বতন্ত্র কার্যক্রম, কর্মসূচি ও সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনাকে বিসর্জন দিয়ে জাতীয় ঐক্য ও সংহতিতে অবদান রাখতে হবে।

এধরনের ঐক্য-সংহতি হয়তো কেউ কেউ অসম্ভব বলে বিবেচনা করতে পারে, তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে, সর্বোপরি জাতীয় অস্তিত্বের বিদ্যমান চরম সংকটের বাস্তবতাকে জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হলে তা কখনোই অসম্ভব বলে বিবেচনা করা যায় না। জুম্ম জনগণের আন্দোলন-সংগ্রামের গোড়া থেকে যেভাবে সকল প্রকার বিভেদকামীতাকে বিচক্ষণতার সাথে মোকাবেলা করে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি অটুট রাখা সম্ভব হয়েছে সেই গৌরবময় সফলতা ও অর্জনকে যদি দ্বিধা-বিভক্ত শক্তিগুলো বিবেচনায় রাখে এবং প্রকৃত রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসে তাহলে তা সহজেই অর্জন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে অবশ্যই সংকীর্ণ ও ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে সকল পক্ষকে সাহসিকতার সাথে জাতীয় সংহতি বিনির্মানে এগিয়ে আসতে হবে।

More From Author