হিল ভয়েস, ১০ জুলাই ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক: গতকাল (৯ জুলাই) পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি (সিএইচটি রেগুলেশন) ১৯০০ বাতিল করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এবং উক্ত শাসনবিধি রক্ষার স্বপক্ষে অবস্থান গ্রহণ, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া ও বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার আবেদন জানিয়ে তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে মানববন্ধন ও প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলিপি প্রেরণ করা হয়েছে।
‘চাকমা সার্কেল, বোমাং সার্কেল ও মং সার্কেলের প্রথাগত নেতৃবৃন্দ ও সর্বস্তরের জনগণ’ এর ব্যানার ছাড়াও তিন পার্বত্য জেলার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের, এলাকার ও পেশার মানুষের ব্যানার নিয়ে সর্বস্তরের আদিবাসী নারী ও পুরুষ এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
সকাল ১০টা-১১টা’র দিকে প্রায় একযোগে রাঙ্গামাটি জেলা সদর, বান্দরবান জেলা সদর ও খাগড়াছড়ি জেলা সদরে এই মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। মানববন্ধনে নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে বক্তব্যও প্রদান করা হয়।
মানববন্ধনের শেষ দিকে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে রিভিউ মামলায় অ্যাটর্নি জেনারেলের রীতি-বিরুদ্ধ ভূমিকার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০-এ অন্তর্ভুক্ত আদিবাসীদের বিশেষ অধিকার হরণের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে একটি স্মারকলিপিও প্রেরণ করা হয়।
রাঙ্গামাটিতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দক্ষিণ ফটকে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান। এছাড়া অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন এম এন লারমা মেমোরিয়েল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও হেডম্যান চিংকিউ রোয়াজা, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল শাখার সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা (অব:উপসচিব), সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক শান্তি বিজয় চাকমা প্রমুখ। মানববন্ধনে স্মারকলিপি পাঠ করেন নিরুপা দেওয়ান এবং মানববন্ধনে সঞ্চালনা করেন কাপ্তাই উপজেলার ভাজ্যাতলী মৌজার হেডম্যান থোয়াই অং মারমা।
বান্দরবানে জেলা প্রেস ক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন জেলা হেডম্যান-কারবারী কল্যাণ পরিষদের সভাপতি ও তারাছা মৌজার হেডম্যান হ্লথোয়াইহ্রী মারমা, বান্দরবান হেডম্যান এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হেডম্যান উনিহ্লা মারমা, দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অংচমং মারমা, ছাত্রনেতা মংচসিং মারমা ও তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থার জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক বীর লাল তঞ্চঙ্গ্যা প্রমুখ। এতে আরো উপস্থিত ছিলেন ৩১৬নং বেতছড়া মৌজার হেডম্যান হ্লা থোয়াই হ্রী মারমা, ৩২৪নং চেমী মৌজার হেডম্যান পুলু মারমা, ৩০৯নং দক্ষিণ হাঙ্গর মৌজার হেডম্যান পারিং ম্রো, ৩০৭নং চাম্বি মৌজার হেডম্যান টিমং প্রু মারমা সহ বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক ও ছাত্র-যুব সংগঠনের কর্মীবৃন্দ ও সাধারণ জনগণ।
খাগড়াছড়িতেও জেলা প্রেস ক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও এলাকার বিভিন্ন স্তরের জনগণ স্ব স্ব ব্যানার নিয়ে মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করেন।
প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে লিখিত স্মারকলিপিতে বলা হয়, “আপনি অবগত আছেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ – যা হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়াল নামেও পরিচিত, যেটি কিনা ১৯ জানুয়ারি ১৯০০ সালে কার্যকর হয়। তারপর থেকে এটি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রশাসন সংক্রান্ত প্রধান আইনী দলিল হিসেবে কাজ করে চলেছে। পাশাপাশি এই প্রবিধানে বিভিন্ন বিধানসমূহ রয়েছে যা এই অঞ্চলের সুশাসন, ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ এবং এই অঞ্চলের জনগণের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সুরক্ষা এবং আন্তঃপ্রজন্মগত চর্চার জন্য অপরিহার্য।
বলাবাহুল্য ২০০৩ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল এ. এফ. হাসান আরিফের আবেদনের ভিত্তিতে হাইকোর্টের একটি বিভাগীয় বেঞ্চ ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনকে একটি ‘‘মৃত আইন’’ হিসাবে ঘোষণা করেন ( Rangamati Food Products v. Commissioner of Customs & Others, 10 BLC (২০০৫), ৫২৫)। পরবর্তীকালে এই প্রেক্ষিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। ২০১৭ সালে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ শুনানি শেষে “পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০”-কে একটি সম্পূর্ণ “জীবিত ও বৈধ” আইন হিসেবে বলবৎ রাখেন [ Wagachara Tea Estate Ltd. v. Muhammad Abu Taher & Others, 16 BLD (AD) (২০১৬), ৩৬]।
কিন্তু ২০১৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি এবং খাগড়াছড়ি জেলার বসতি স্থাপনকারী যথাক্রমে আব্দুল আজিজ আখন্দ এবং আব্দুর মালেক নামের দুই ব্যক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, ১৯০০ বিষয়ক সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে দুটি রিভিউ পিটিশন দাখিল করেন (যার সিভিল পিটিশন নম্বর যথাক্রমে ৫৪/২০১৮ এবং ১৯২/২০১৮)। তাদের পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী ছিলেন তৎকালীন বিএনপি সরকারের পূর্বেকার নিয়োগপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল জনাব এ. এফ. হাসান আরিফ। উল্লেখ্য যে, রিভিশনকারী ব্যক্তিদ্বয় এই রেগুলেশন সংক্রান্ত উপরোক্ত মামলা সমুহে কোন পক্ষভুক্ত ছিলেন না।”
স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়, “সাধারণ রীতি অনুসারে সরকারের অনুকূলে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া উক্ত রায়ের পক্ষে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের অবস্থান গ্রহণ করার কথা। কিন্তু তার পরিবর্তে তিনি ‘‘Raja’’, ‘‘Indigenous Peoples’’ শব্দসহ আরো কিছু শব্দ ও বাক্যাংশ বাদ দেওয়াসহ প্রথাগত আইনের ( Customary Law) বিস্তারিত ব্যাখ্যা সম্বলিত সর্বমোট দশটিরও অধিক অনুচ্ছেদ বাদ দেয়ার জন্য আদালতের কাছে মৌখিক ও লিখিতভাবে প্রার্থনা করেছেন।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে, বিগত ২৬ জুলাই ২০২৩ তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি নাগরিক সমাজের ৩২ (বত্রিশ) জন বিশিষ্ট ব্যক্তি, যাদের মধ্যে ছিলেন চাকমা সার্কেলের প্রধান রাজা দেবাশীষ রায় এবং প্রাক্তন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সমীপে স্মারকলিপি প্রদান করেন। সেই স্মারকলিপিতে তাঁরা মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট এর আপিল বিভাগে পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ সংক্রান্ত চলমান দুটি রিভিউ মামলায়, রেগুলেশন ও এতে স্বীকৃত আদিবাসীদের অধিকার সম্বলিত প্রচলিত আইন, প্রথা ও রীতির জোরালো ও চলমান কার্যকারিতার পক্ষে অবস্থান গ্রহণের জন্য বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলকে যথাযথ নির্দেশের প্রার্থনা জানান।”
এতে আরও বলা হয়, “..সংশ্লিষ্ট রিভিউ মামলায়, বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের অবস্থান, যা ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিধান এবং বহু সাংস্কৃতিক, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা সংক্রান্ত সাংবিধানিক বিধানেরও পরিপন্থী।
বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল লিখিতভাবে যে শব্দসমূহ, বাক্যাংশ ও প্রথাগত আইনের অনুচ্ছেদসমূহ বাদ দেয়ার জন্য মহামান্য সুপ্রিম কোর্টকে আবেদন করেছেন, তা আবেদনকারীগণের দাবী অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বহু সাংস্কৃতিক ও ধর্ম নিরপেক্ষ অভিমুখিতাকে দুর্বল করবে যার দ্বারা বাংলাদেশ সংবিধানের ২ক, ১২ ও ২৩ক অনুচ্ছেদে নিহিত মৌলিক অভিপ্রায়ের পরিপন্থী হবে।”
স্মারকলিপিতে বলা হয়, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা আপনার কাছে বিনীতভাবে আবেদন জানাচ্ছি, যাতে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলকে এই মর্মে নির্দেশ ও পরামর্শ প্রদান করা হয়, যাতে তিনি সংশ্লিষ্ট মামলাসমূহে পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ এর পক্ষ অবলম্বন করেন, যার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনমানুষের অধিকার রক্ষিত হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৯৭ এর শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়া যায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ সমগ্র দেশের বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করা হয়।”
মানববন্ধনে নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে আগামী ১১ জুলাই ২০২৪ এর পরে পরবর্তী কর্মসূচি প্রদান করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়। উল্লেখ্য যে, উক্ত রিভিউ মামলার শুনানি আগামী ১১ জুলাই ২০২৪ তারিখে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
+ There are no comments
Add yours