কল্পনা চাকমাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় হারিয়ে দেয়া হয়েছে: ঢাকা সমাবেশে ঊষাতন তালুকদার

হিল ভয়েস, ১৩ জুন ২০২৪, ঢাকা: গতকাল ১২ জুন, ঢাকায় পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীদের সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশন এর সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমার অপহরণের ২৮ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এবং নিম্ন আদালতে কল্পনা অপহরণ মামলা খারিজের প্রতিবাদে ও এ ঘটনায় অভিযুক্ত লে: ফেরদৌসসহ রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যদের শাস্তির দাবিতে এক বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে।

“পাহাড়ে সেনাশাসন নিপাত যাক, কল্পনারা মুক্তি পাক” শ্লোগান নিয়ে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে হিল উইমেন্স ফেডারেশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরাম, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক ও অন্যান্য ছাত্র-যুব ও নারী সংগঠনসমূহ।

বিকাল ৩.০০ টায় ঢাকার শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে অনুষ্ঠিত উক্ত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশন এর সাংগঠনিক সম্পাদক উলিসিং মারমা। বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মনিরা ত্রিপুরা’র সঞ্চালনায় সমাবেশে লিখিত বক্তব্য রাখেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি চন্দ্রিকা চাকমা।

এছাড়া সমাবেশে সংহতি বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র সহ-সভাপতি ও সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল এর সহ-সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য লুনা নূর, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরিণ, সাংবাদিক নজরুল কবীর, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সভাপতি খান আসাদুজ্জামান মাসুম, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মাহির শাহরিয়ার রেজা প্রমুখ। এছাড়াও সমাবেশে বক্তব্য রাখবেন বিভিন্ন সংগঠনের ছাত্র ও যুব নেতৃবৃন্দ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র সহ-সভাপতি ও সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার বলেন, কল্পনা চাকমার অপহরণ মামলা দীর্ঘ ২৮ বছর পর খারিজ করে দেয়া হল। হদিস দিতে পারলো না এই রাষ্ট্র। তাহলে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন, জাতীয় নির্বাচনের একদিন আগে কল্পনা চাকমাদের বাড়িতে অস্ত্রসহ কে গেল- ভূত না কী প্রেত? কল্পনা চাকমাকে আসলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় হারিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা উচ্চ আদালতে গিয়ে এ ঘটনার বিচার দাবি করবো।

তিনি আরো বলেন, এদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের ভাবতে হবে- পাহাড়ের সমস্যা এক রাজনৈতিক ও জাতীয় সমস্যা। পাহাড়ে অনেক রক্ত ঝরেছে। আমরা চাই না আর পাহাড়ে রক্ত ঝরুক। সরকার পাহাড়ে আমলাদের উপর নির্ভর করে অপশাসন চালাচ্ছে। এমনতর পরিস্থিতি চলতে থাকলে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে না।

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল এর সহ-সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, কল্পনা চাকমা এমন একটি নাম যার জন্ম দিবস বলতে পারলেও মৃত্যু দিবস বলা যাবে না। কল্পনা চাকমাকে এই ২৮ বছর পরও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, কল্পনা চাকমাকে রাষ্ট্র আসলে হদিস দিতে চায়নি অথবা রাষ্ট্রই কল্পনা অপহরণের সাথে যুক্ত। রাষ্ট্রের বয়স যতই হোক আমরা রাষ্ট্রকে এ অভিযোগে অভিযুক্ত করেই যাবো।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য লুনা নূর বলেন, আমরা বিগত ২৮ বছর ধরে কল্পনাকে খুঁজছি। রাস্তায় নেমে আমরা দাবি করে যাচ্ছি কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচার করতে হবে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি দেশ ও সংবিধান পেয়েছি। কিন্তু যারা যখন ক্ষমতায় এসেছে তারা তখন নিজেদের সুবিধামতো সংবিধানকে কাট-ছাট করেছে। আর সংবিধানে আদিবাসীদের বলছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। আমরা এর তীব্র বিরোধীতা করেছি। কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কথা বললে কেবল হবে না, বরং যে ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে দেশ চলছে, যেখানে সংখ্যালঘু ও আদিবাসী মানুষের অধিকার পদদলিত হচ্ছে সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরিণ বলেন, কল্পনা চাকমা অপহরণের পর পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাটি দেশ বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রসার হয়। কারণ, দেশে-বিদেশের মানুষ প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। অন্যদিকে কল্পনা চাকমার লড়াই ছিল বহুমুখী। একদিকে পাহাড়ের সেনাশাসন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে কল্পনা সংগ্রাম করেছেন, অপরদিকে নিজ জনগোষ্ঠীর মধ্যেও নারী-পুরুষের সমতার জন্যও কল্পনা লড়েছেন।

সাংবাদিক নজরুল কবীর বলেন, বহুবছর পর আমি বিগত দু’এক বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির সেই নিউলাল্যেঘোনা গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে কল্পনা চাকমার বাড়িতে গিয়ে কল্পনা চাকমা’র ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমরা কি আসলে বিচার পাবো? আমি আশা করেছিলাম, অন্তত এ সরকার বিচার করবে। কিন্তু গত দু’মাস আগে এ মামলাটি খারিজ করে দেয়া হয়। আমার মনে আছে, পার্বত্য চুক্তির আগে আমরা পাহাড়ে ঢুকতেও পারতাম না। আজকাল যেভাবে পাহাড়ে কিছুটা হলেও ঘোরাফেরা করা যায় সেটা সেসময় পারা যেত না, যা পারা যাচ্ছে পার্বত্য চুক্তির বদৌলতে। কিন্তু এখনো পাহাড়ে অনেকেই এ চুক্তির, পার্বত্য চুক্তির বিরোধীতা করছেন। পাহাড়ে একসময় মাত্র একটা রাজনৈতিক দল ছিল। কিন্তু এখন অনেক রাজনৈতিক দল তৈরী করে পরিকল্পিতভাবে অস্ত্র তুলে দেয়া হয়েছে। কাজেই বিভেদের মধ্যে যে লড়াই পাহাড়িরা লড়ে যাচ্ছে সেটা হতে হবে সুপরিকল্পিত।

বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সভাপতি খান আসাদুজ্জামান মাসুম বলেন, আমরা জানি যে কল্পনা চাকমাকে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর দ্বারা অপহরণ করা হয়নি। বরং পরিষ্কারভাবে কল্পনার দুইভাই বলেছেন, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তার নাম। সেখানে লে. ফেরদৌসের নাম এসেছে। এই ঘটনার ১০ বছর পরেই আমরা এ ঘটনার চার্জশীট হতে দেখছি। কিন্তু সেখানে সেইসব কর্মকর্তাদের নাম নেই। এখন কুকি-চিন এর নাম বলা হচ্ছে। কিন্তু এই কুকি-চিনের মদদ দাতা হচ্ছে খোদ সেনাবাহিনী। নির্বিঘেœ ব্যাংক ডাকাতির পর কুকি-চিনরা চলে গেল, পরে গ্রেপ্তার করা হল সেই এলাকার সাধারণ নিরীহ বমদের। আমরা বুঝে নিই, সেখানে সেনাবাহিনী কী ধরনের শাসন কায়েম করতে চায়। একদিন কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচার হবেই।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মাহির শাহরিয়ার রেজা বলেন, আজকে কল্পনা অপহরণের ২৮ বছর পরও ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িতে রাস্তায় নেমে প্রশ্ন করতে হচ্ছে, কল্পনা চাকমা কোথায়! আজকে কল্পনা অপহরণের বিচার হয়নি কেবল নয়, ২৬ বছর আগে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিও বাস্তবায়িত হয়নি এখনো। আজকে যে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় রয়েছে সেই পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ও একই সরকার ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু টানা সরকারে থাকার পরও এই চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বরং পাহাড়ে সেনা নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো হয়েছে এবং দাবি করা হচ্ছে, সেনাবাহিনী সরিয়ে নিলে সেখানে রাজনৈতিক গ্রুপগুলোর মধ্যে সংঘাত বাড়বে। কিন্তু আমরা দাবি করছি, পাহাড় থেকে সেনাশাসন সরিয়ে নিলে তখন সেনা মদদপুষ্ট গ্রুপগুলো পৃষ্টপোষকতা পাবে না। এতে সংঘাত শেষ হয়ে যাবে এবং আমি এ সমাবেশ থেকে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি জানাই।

এছাড়াও সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদ, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সাধারণ সম্পাদক ডা: গজেন্দ্র নাথ মাহাতো, নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ এর সংগঠক আকরামুল হক, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জগদীশ চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অলীক মৃ, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য সুজয়া ঘাগড়া, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি দীপক শীল, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি অতুলান দাস আলো, বালাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সভাপতি আন্তনী রেমা, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের ঢাকা অঞ্চলের প্রতিনিধি শান্তি সরেন প্রমুখ।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক উলিসিং মারমা’র সমাপনীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সমাবেশটি শেষ হয়। পরে শাহবাগ থেকে একটি মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি’র রাজু ভাষ্কর্যের পাদদেশে গিয়ে শেষ হয়। পরে নারী নেত্রী উলিসিং মারমা তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সমাবেশ পরবর্তী মিছিল সমাপ্তির ঘোষণা করেন।

More From Author

+ There are no comments

Add yours