হিল ভয়েস, ১৩ মে ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক: পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগণের ঐতিহাসিক, ঐতিহ্যগত, প্রথাগত ও বিশেষ অধিকারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি’ বা ‘সিএইচটি রেগুলেশন ১৯০০’-কে মৃত আইন ঘোষণা করা কিংবা বাতিল বা অকার্যকর আইনে পরিণত করার জোর ষড়যন্ত্র চলছে। জুম্ম বিদ্বেষী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কর্তৃক এই ষড়যন্ত্র চললেও খোদ বর্তমান সরকারের এ্যাটর্নি জেনারেলের নেতিবাচক ও বিরোধী ভূমিকার কারণে সেই ষড়যন্ত্র এখন বিপদজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে বলে জানা গেছে।
গত ৯ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগের ফুল বেঞ্চে এই আইনকে মৃত আইন মর্মে ঘোষণা সংক্রান্ত রিভিউ শুনানি শুরু হয়েছে। ফুল বেঞ্চে প্রধান বিচারপতি সহ মোট আট জন বিচারপতি উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে। আগামী ১৬ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার মামলাটির চূড়ান্ত শুনানি হবে বলে জানানো হয়েছে।
জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবারের ফুল বেঞ্চের শুনানিতেও এ্যাটর্নি জেনারেল তার সাবমিশনে (বক্তব্যে) ‘সিএইচটি রেগুলেশন ১৯০০’-এর মৌলিক বিষয়বস্তু সুরক্ষার পক্ষে অবস্থান না নিয়ে উল্টো ষড়যন্ত্রকারী সেটেলারদের ‘রাজা’, ‘ইন্ডিজেনাস’ ও কতিপয় বাক্যাংশ সহ অন্তত ১০টির অধিক গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ বাদ দেওয়ার জন্য তার বক্তব্যসমূহ মেনে নিয়ে রিভিউ শুনানি সমাপ্ত করার প্রস্তাব দিয়েছেন।
আদালত এ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য মেনে নিয়ে মামলাটি খারিজ করলে ‘সিএইচটি রেগুলেশন ১৯০০’ কার্যত একটি মৃত, বাতিল বা অকার্যকর আইনে পরিণত হবে বলে অভিজ্ঞ মহলের অভিমত।
উক্ত শুনানিতে রিভিউকারীদের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এফ হাসান আরিফ এবং এরপর এ্যাটর্নি জেনারেলের সাবমিশনের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের পক্ষ হওয়ার জন্য আবেদনকারী জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট প্রবীর নিয়োগী বক্তব্য প্রদান করেন।
অ্যাডভোকেট প্রবীর নিয়োগী বলেন, ‘আমারা এখনো এই রিভিয়ের কোনো পক্ষ না বা আমাদের আবেদন গ্রহণ করা হবে কিনা তাও জানি না, যার কারণে রাষ্ট্র পক্ষের দেওয়া বক্তব্যের জবাবও দিতে পারছি না। মাই লর্ড, হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়েল আইনটি ঐতিহাসিক একটি আইন যা ১৯০০ সালে প্রণীত এবং সর্বশেষ পার্বত্য চুক্তির পরে ২০০৩ সালে মহান সংসদ কর্তৃক সংশোধিত হয়ে পার্বত্য অঞ্চলে প্রয়োগ করা হয়েছে এবং এটি একটা চলমান আইন। পার্বত্য অঞ্চলের অতীত এবং বর্তমান ইতিহাস আমরা সবাই জানি, কাজেই এব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা করে এগুনো উচিত। তাই আমরা হুট করে এক কলমের খোচায় চার দেয়ালে বসে কিছু করতে পারি না।’
এরপর মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেন, রাষ্ট্র জাজমেন্টের কয়েকটি শব্দ বাদ দিতে বলেছে, এর বাইরে কিছু নয় আর, এগুলো বাদ দিলে কি এমন ক্ষতি হবে বলেন মি. নিয়োগী?
প্রধান বিচারপতিতে উদ্দেশ্য করে অ্যাডভোকেট নিয়োগী আরো বলেন, ‘মাই লর্ড, কয়েকটি শব্দ নয়, জাজমেন্টের ৬৫ টি ধারা (ক্লজ) থেকে ৩৭ টি ক্লজ বাদ দিতে বলেছে রাষ্ট্র, তাহলে এতগুলো ক্লজ বাদ গেলে একটা জাজমেন্টে কী থাকে! যেই শব্দগুলো বাদ চেয়েছে রাষ্ট্র, সেইগুলো পাহাড়ের সামাজিক প্রথা, ট্রাডিশনের সাথে সম্পৃক্ত। আর রাষ্ট্র নিজের জাজমেন্ট এভাবে মোডিফাই করতে চাইতে পারি কিনা তাও একটা বিষয়। আদালত কিন্তু আইন প্রণয়নকারী সংস্থা না, আদালত আইনের অনুসরণকারী, রাষ্ট্রে কী কী আইন চলবে থাকবে তা দেখবে রাষ্ট্রের আইন বিভাগ।’
উল্লেখ্য যে, ২০০৩ সালে Rangamati Food Product Ltd. V. Commissioner of Customs and others মামলায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে তৎকালীন বিএনপি সরকারের এ্যাটর্নি জেনারেলের আবেদনের প্রেক্ষিতে ‘সিএইচটি রেগুলেশন ১৯০০’-কে মৃত আইন ঘোষণা করা হয়। তবে এর পরবর্তীতে সরকার পরিবর্তন হলে, আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক হাইকোর্ট ডিভিশনের উক্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে আপীল করা হলে তৎকালীন এ্যাটর্নি জেনারেলের ইতিবাচক অবস্থানের কারণে সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগ ‘সিএইচটি রেগুলেশন ১৯০০’ এর বৈধতা বজায় রাখেন এবং এই রেগুলেশন একটি সম্পূর্ণ ‘জীবিত ও বৈধ আইন’ বলে ঘোষণা করেন। তৎসময়ে একইভাবে আরেকটি আলোচিত Wagachara Tea Estate Ltd. V. Muhammad Abu Taher and Others মামলায়ও ‘সিএইচটি রেগুলেশন ১৯০০’ উক্ত স্বীকৃতি বজায় রাখা হয়।
কিন্তু ২০১৮ সালে সাম্প্রদায়িক ও জুম্ম বিদ্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় বসবাসকারী সেটেলার আব্দুল আজিজ আকন্দ Rangamati Food Product Ltd. V. Commissioner of Customs and others মামলার রায়ের বিরুদ্ধে সিভিল পিটিশন নং-৫৪/২০১৮ মূলে এবং একইভাবে খাগড়াছড়ি নিবাসী সেটেলার আব্দুল মালেক Wagachara Tea Estate Ltd. V. Muhammad Abu Taher and Others মামলার রায়ের বিরুদ্ধে সিভিল পিটিশন নং-১৯২/২০১৮ মূলে রিভিউ মামলা দায়ের করেন।
উক্ত মামলাদ্বয়ে সরকারের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগের প্রদত্ত রায়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে রীতি অনুসারে বর্তমান এ্যাটর্নি জেনারেলের অবস্থান গ্রহণ করার কথা থাকলেও তিনি উল্টো উক্ত রায় রিভিউ তথা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০’ এর মৌলিক সংশোধনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, যাতে আইনটি অকার্যকর বা মৃত আইনে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
গত ২৬ জুলাই ২০২৩ পার্বত্য চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে চাকমা সার্কেল চীফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান, শিক্ষাবিদ মংসানু চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মহাপরিচালক উক্য জেন, নিরূপা দেওয়ান, ড. সুধীন কুমার চাকমা, জুয়ামলিয়ান আমলাই বম সহ ৩২ জন বিশিষ্ট নাগরিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরাবরে এ বিষয়ে একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন। স্মারকলিপিতে সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিধিবদ্ধ ও প্রথাগত আইন বিষয়ে এ্যাটর্নি জেনারেলের ভূমিকাকে ‘রীতি-বিরুদ্ধ আচরণ’ বলে অভিহিত করেন।
স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, ‘বিষয়টি অবহিত হওয়ার পরে ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ এমপি, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি, প্রাক্তন মন্ত্রী জনাব মহিউদ্দিন খান আলমগীর এবং তিন পার্বত্য জেলার সংসদ সদস্যগণ আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক-এর সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে মিলিত হয়ে এ্যাটর্নি জেনারেলকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের জন্য অনুরোধ করেন যেন তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’র সাথে সঙ্গতি রেখে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কিন্তু আইন মন্ত্রীর নির্দেশনা সত্ত্বেও এ্যাটর্নি জেনারেল-এর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী অবস্থান অব্যাহত রয়েছে।’
এতে আরও বলা হয়, ‘বিজ্ঞ এ্যাটর্নি জেনারেল-এর উপস্থাপনা, বিশেষত বিশদ ব্যাখ্যা সম্বলিত প্রথাগত আইন, মহামান্য আদালত কর্তৃক গৃহীত হলে তা পার্বত্য চট্টগ্রামের বহুসংস্কৃতির গঠন বিন্যাস ও এই অঞ্চলের ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্যকে দুর্বল করে ফেলবে। …বিজ্ঞ এ্যাটর্নি জেনারেল-এর উপস্থাপনা গৃহীত হলে তা ১৯৯৭ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির প্রস্তাবনায় বর্ণিত “অনগ্রসর উপজাতি অধ্যুষিত এলাকা” সম্বলিত বিধানসমূহের উপর সরাসরি আঘাত করবে এবং এগুলোর ভিত্তিতে প্রণীত পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের আইন ১৯৮৯ (আইন নং ১৯, ২০ ও ২১) এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮-এর উপর সরাসরি আঘাত করবে। এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ভাবাবেগকে গভীরভাবে আহত করবে, এই অঞ্চলে অসন্তুষ্টি, অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে এবং ..শান্তিপ্রক্রিয়াকে তীব্রভাবে বিঘ্নিত করবে।’
উল্লেখ্য যে, স্মরণাতীত কাল থেকে স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে বসবাসকারী জুম্মদের আবাসভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম ১৮৬০ সালে জেলা হিসেবে ঘোষিত হওয়ার মাধ্যমে সরাসরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও ব্রিটিশ প্রশাসন পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ শাসিত এলাকার মর্যাদা দিয়ে ১৯০০ সালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০’ প্রণয়ন করে। তৎসময় থেকে আজ অবধি এই রেগুলেশন পার্বত্যাঞ্চলের প্রশাসনের অন্যতম মূল আইন হিসেবে বলবৎ হয়ে রয়েছে।