হিল ভয়েস, ১৮ মে ২০২৪, ঢাকা: বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের জন্মের দিনটিকে ‘জাতির জন্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন’ হিসেবে অভিহিত করে ভূমিমন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দ এম.পি বলেছেন, ধর্মান্ধ ও মৌলবাদিরা সমাজকে পেছনের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতা যেখানে চলে গেছে তার বিরুদ্ধে লড়াই একাত্তরের চেয়েও কঠিন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক শক্তিকে আজ ঐক্যবদ্ধভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশকে পুনঃপ্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ আজ খোলা নেই।
গতকাল (১৭ মে) বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) মিলনায়তনে ঐক্য পরিষদের ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, সরকারী দল নির্বাচনী ইশতেহারে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনে যে সব বাধা রয়েছে তা অবসানের অঙ্গীকার করেছে। এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ভূমি মন্ত্রণালয় তার উদ্যোগ ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছে। মন্ত্রী অর্পিত সম্পত্তি আইনের বাস্তবায়নে বাধা হিসেবে প্রশাসনের নিম্ন পর্যায়ে আন্তরিকতার অভাবকে দায়ি করেন। তিনি বলেন, দেবোত্তর সম্পত্তি আইন সংক্রান্ত বিল ইতোমধ্যে প্রণীত হয়েছে। বর্তমানে তা আইন মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। আশা করা যায়, এ বিলটিকেও দ্রুত আইনে পরিণত করার জন্যে পার্লামেন্টে পেশ করা হবে। সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্যে জাতীয় পর্যায়ে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার ওপর মন্ত্রী জোর গুরুত্ব আরোপ করেন।
আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক সংসদীয় ককাসের সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. মেজবাহ কামাল উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সরকারে ও দলে বঙ্গবন্ধু কন্যার অবস্থান ও তাঁর দলের অবস্থান এক নয়। স্বাধীনতার ইতিহাস যথার্থ অর্থে তুলে ধরার দায়িত্ব সরকারি দলকেই গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু এ দায়িত্ব পালনে তাদের অনীহায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ক্রমশঃ পেছনের দিকে হঠছে। দল ক্ষমতায় থাকলে বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের কন্ঠস্বর রুদ্ধ থাকে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের খপ্পর থেকে দেশকে উদ্ধার করতে হলে তাঁদেরও দল ও সরকারকে পথ দেখাতে হবে। তিনি চৈতন্যের শক্তিকে জাগ্রত করার ওপর জোর গুরুত্ব আরোপ করেন। ড. মেজবাহ কামাল এ মর্মে শংকা প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় টিকে থাকবে না কি আরেকটি পাকিস্তান তৈরী হবে- এ নিয়ে গোটা জাতি আজ দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে। তিনি সংখ্যালঘু স্বার্থবান্ধব অঙ্গীকারসমূহ বাস্তবায়নে সরকারের কাছে জোর দাবি জানান।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ঐক্য পরিষদের জন্মের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে বলেন, এ প্লাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করা না গেলে আজকে সংখ্যালঘুরা তাদের সমস্যা দেশ ও জাতির সামনে তুলে ধরতে পারত না এবং এরা হয় দেশ থেকে ইতোমধ্যে হারিয়ে যেতো নয়তো বা অধিকতর অনগ্রসর জনগোষ্ঠীতে পরিণত হতো। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতা, রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক সাম্প্রদায়িকতা, প্রশাসনিক সাম্প্রদায়িকতায় দেশ আজ ছেয়ে গেছে। তিনি সংখ্যালঘুদের তাদের অস্তিত্ব রক্ষার লক্ষে অধিকতর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ওপর জোর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, এ দেশের শতকরা ১০ ভাগ জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে রাজনীতির মাঠে নামার সময় এসেছে।
নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার সংবিধান ও রাজনীতির সাথে ধর্মকে যুক্ত করায় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ পরিপুষ্ট হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, রাজনীতিতে, প্রশাসনে, সরকারে সাম্প্রদায়িকতা বিরাজ করছে। শিশুকাল থেকে ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ সরকারের আমলে পাঠ্যসূচীতে পরিবর্তন হয়েছে যাতে মৌলবাদীরা খুশি হয়েছে। নতুন শিক্ষানীতি বলবৎ করা গেলে দেশটা অন্ততঃ এক জায়গায় ফিরে আসবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সাংসদ ও প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী ড. বীরেন সিকদার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ‘ক্ষয়িষ্ণু’ সম্প্রদায় হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, আবেদন নিবেদন করে অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণে তিনি ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, অন্যান্য দেশ থেকে সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগ করে না। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে কেন করছে তা রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজকে বিবেচনায় নিতে হবে জাতীয় স্বার্থে। তিনি সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, পার্বত্য শাস্তিচুক্তির বাস্তবায়নের জন্যে সরকারের কাছে জোর দাবি জানান।
পংকজ নাথ এম.পি বলেন, ১০% সংখ্যালঘুকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ থাকবে না। তিনি ইশতেহারে প্রদত্ত সংখ্যালঘু অঙ্গীকারসমূহ বাস্তবায়নে জোরদার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার ওপর জোর গুরুত্ব আরোপ করেন।
আদিবাসী নেতা, ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক এতে আলোচনায় অংশ নেন। সভার শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত বলেন, ‘মানবিক বাংলাদেশ, অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ বিনির্মাণে যেসব চ্যালেঞ্জ সামনে রয়েছে তা মোকাবেলা করে শান্তি, সমৃদ্ধি, সম্প্রীতি ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এখনই সময়।’