হিল ভয়েস, ১৮ মে ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক: গতকাল (১৭ মে) বাংলাদেশের অন্যতম মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক তার স্বাগত বক্তব্যে বলেন, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও আদিবাসী সম্প্রদায় অধিকতর সংকুচিত হয়ে পড়েছে এবং তারা আজ অস্তিত্বের সংকটে। আজ থেকে তিন দশকের ঊর্ধ্বকাল আগে পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হলেও অদ্যাবধি তা বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্যাঞ্চলে শান্তির দেখা এখনও মেলেনি।
তাঁর বক্তব্যের উল্লেখযোগ্য অংশ নিম্নে উল্লেখ করা হল-
“স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে জেনারেল এরশাদের আমলে তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকার কর্তৃক ১৯৮৮ সালের ২২ মে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী রাষ্ট্রধর্ম বিল পার্লামেন্টে উত্থাপিত হয়। এরই প্রাক্কালে এ সর্বনাশা উদ্যোগের প্রতিবাদে ২০ মে মহান মুক্তিযুদ্ধের ৪ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্ত বীর উত্তমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গঠিত হয়। তিনি বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রধর্মের জন্যে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করি নি।’ এ বিল যেদিন পার্লামেন্টে উত্থিত হয় সেদিন এ সংগঠনের পক্ষ থেকে এক স্মারকলিপি প্রদান করা হয় জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পীকার জনাব শামসুল হুদার কাছে।…
এ সংগঠন গঠনের পর ইতোমধ্যে ৩৫টি বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। গত ২১ নভেম্বর ১৯৯০ ইং তারিখে ১৫,৭ ও ৫ দলীয় জোটের যুক্ত ঘোষণায় স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী সকল আইন বাতিলের কথা উল্লেখ থাকলেও আজও রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানে বিদ্যমান। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ রাষ্ট্রীয় মৌলনীতি হিসেবে ফিরে এলেও এর সাথে সাংঘর্ষিক রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানে বহাল থাকার ফলশ্রুতিতে এ দেশের সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তিসমূহ অনেক বেশী উৎসাহিত হয়েছে, হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলের সরকার সুদীর্ঘ দেড় দশক ধরে একটানা ক্ষমতায় থাকা স্বত্ত্বেও রাষ্ট্র, প্রশাসন, সমাজ সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের দখলে চলে গেছে। ব্যতিক্রমবাদে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলসমূহের অনেকেই সাম্প্রদায়িক মানসিকতায় দুষ্ট হয়ে পড়েছেন। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা মুখে বলা হলেও অন্তরে, রাজনীতিতে ও জীবনের চর্চায় ক’জন প্রকৃত অর্থে ধারণ করেন তা আজ বিশাল প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা সরকারের প্রগতিশীল শিক্ষানীতি বানচালের আস্ফালন শুরু করেছে। বাঙালীর সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ আজ তাদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে।
এহেন বিরাজিত রাজনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতিতে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও আদিবাসী সম্প্রদায় অধিকতর সংকুচিত হয়ে পড়েছে এবং তারা আজ অস্তিত্বের সংকটে। ধর্মীয় বিদ্বেষপ্রসূত কারণে এরা দৈহিক আক্রমণের শিকার হচ্ছে, অমর্যাদকর শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করে তাদের অবমাননা করা হচ্ছে, ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন অব্যাহতভাবে চলছে, ধর্মীয় ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত উপাসনালয় ও নানান প্রতিষ্ঠানাদি ছাড়াও সংখ্যালঘুদের বাসভবন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুটপাট, ধ্বংস ও অগ্নিসংযোগে ভষ্মিভূত করা হচ্ছে। তাদের জায়গা-জমি থেকে তাদের উচ্ছেদ শুধু নয় কুমারী মেয়েদের অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও ধর্মান্তরিত করে সংখ্যালঘু পরিবারসমূহের মানসিক নির্যাতনের কারণ ঘটানো হচ্ছে। এদের দেশছাড়ার হুমকি অব্যাহতভাবে দেয়া হচ্ছে, ধর্মীয় কিংবা জাতিগত পরিচয়ের কারণে গ্রেফতারপূর্বক কারাগারে আটক রেখে নানান ঘৃণাত্মক অপরাধের মুখোমুখি করা হচ্ছে। জনসমক্ষে ধর্মীয় বিদ্বেষপ্রসূত হিংসাত্মক এমন ধরণের বক্তব্য প্রদান করা হচ্ছে যা সংখ্যালঘু জনগণের ওপর সহিংস আচরণে অনেককে উদ্বুদ্ধ বা প্ররোচিত করছে। সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী দ্বারা একই প্রতিষ্ঠানের সংখ্যালঘু পুরুষ কি নারী অন্যায় ও অসম আচরণের শিকার হচ্ছে। চাপ প্রয়োগ করে, ভয়ভীতি দেখিয়ে, ফুসলিয়ে বা মিথ্যা প্রলোভনে বা আশ্বাসে ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যদের ক্ষতি করার হুমকি দিয়ে বা জোর জবরদস্তিক্রমে স্বধর্ম পরিত্যাগ বা ভিন্নধর্ম গ্রহণে এমনকি অপ্রাপ্ত বয়স্কদেরও জোরপূর্বক বিবাহে বাধ্য করা হচ্ছে। অথচ এহেন অপরাধে কাউকেও বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে না। শাস্তি দেয়ার বিষয় ত’ অনেক দূর। লক্ষ্য করার বিষয়, কথিত ধর্মঅবমাননার বিষয়ে শুধুমাত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে, শাস্তি দেয়া হচ্ছে, গণপিটুনির শিকার হচ্ছে। আমরা মনে করি, অপরাধী যে-ই হোক তার অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু তা-ই বলে তা একতরফা হচ্ছে কেন? এতে সাম্প্রদায়িকতাবাদী ও মৌলবাদীদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।
তথাকথিত শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি আইন বাতিল করে আজ থেকে ২৩ বছর আগে ২০০১ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন পার্লামেন্টে গৃহীত হলেও তা পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে আমলাতান্ত্রিক বাধার আজও অবসান হয় নি। পূর্বেকার মতোই আর্থিক ও মানসিক হয়রানির হাত থেকে ভুক্তভোগীদের এখনও মুক্তি মেলেনি। ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা ও চা বাগানে কর্মরত শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর ওপর সন্ত্রাস ও বৈষম্যমূলক আচরণ চলছে। সমাজে চরমভাবে অবহেলিত, বিচ্ছিন্ন, উপেক্ষিত, দলিত ও অবহেলিত জনগোষ্ঠী। আজ থেকে তিন দশকের ঊর্ধ্বকাল আগে পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হলেও অদ্যাবধি তা বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্যাঞ্চলে শান্তির দেখা এখনও মেলেনি।
এবারকার নির্বাচনী ইশতেহারে সরকারি দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘু জনজীবনে বিদ্যমান পরিস্থিতিকে স্বীকার করে নিয়ে তা থেকে উত্তরণে বেশ কয়েকটি অঙ্গীকার করেছে। এসব অঙ্গীকারের মধ্যে রয়েছে- অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন প্রয়োগে বাধা দূর করা, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন ও সংখ্যালঘু বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা, সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা ও চা বাগানে কর্মরত শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর ওপর সন্ত্রাস ও বৈষম্যমূলক আচরণের নিরসন করা, বিএনপি-জামাত জোট সরকারের ‘এথনিক ক্লিনজিং’ অপনীতির কবলে পড়ে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উপরে পরিচালিত হিংস্র আক্রমণ ও বৈষম্যের শিকার হয়ে যেসব নর-নারী নিহত হয়েছে, ধর্ষণের শিকার হয়েছে, ঘরবাড়ি-জমি-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখল ও লুণ্ঠিত হয়েছে সেসব অমানবিক ঘটনাগুলোর বিচার সম্পন্ন করা। এ প্রসঙ্গে বলতে চাই, কেবল বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমল অর্থাৎ ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত নয় বরং বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে ক্ষমতায় আসীন সরকারগুলো পাকিস্তানী আমলের ‘সংখ্যালঘু সংকোচন নীতি’ বা ‘এথনিক ক্লিনজিং’ অপনীতি গ্রহণ করে।
১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে Martial Law Proclamation -এর অধীনে ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু সরকারের পার্লামেন্টে বিলোপকৃত তথাকথিত শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি আইনকে পুনরুজ্জীবিত করে সংখ্যালঘুদের বিশেষ করে হিন্দুদের জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদের মাধ্যমে দেশত্যাগে বাধ্যের প্রক্রিয়া শুরু হয়। একই ঘটনা সংঘটিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামসহ আদিবাসী এলাকাসমূহে। সমতল থেকে বাঙালীদের পার্বত্য এলাকায় নিয়ে গিয়ে সেখানকার বিশেষ বাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় আদিবাসীদের তাদের জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদ করে দেশান্তরিত করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যাগুরু পাহাড়ী জনগোষ্ঠী আজ সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে।
ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জনজীবনের বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আজ ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়াজ তোলা প্রয়োজন সরকারি দলের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুত সংখ্যালঘু স্বার্থবান্ধব অঙ্গীকারসমূহ যথার্থ অর্থে বাস্তবায়নের। এসব অঙ্গীকারসমূহ নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণার জন্যে আমরা সরকারি দলের প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তবে একই সাথে উল্লেখ করতে চাই, গত ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেও এসব অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও তা বাস্তবায়িত হয়নি, যা নিঃসন্দেহে সংখ্যালঘু জনমনে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি করেছিল। আমরা জানি, গত ৫ বছরে দেবোত্তর সম্পত্তি আইন বিল ও বৈষম্যবিলোপ আইন বিল প্রণীত হওয়া সত্ত্বেও তা পার্লামেন্টে আজও উত্থাপিত হয়নি। এবারে তা উত্থাপিত হবে এ আশা ব্যক্ত করছি।
মানবিক বাংলাদেশ, অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ বিনির্মাণে যেসব চ্যালেঞ্জ সামনে রয়েছে তা মোকাবেলা করে শান্তি, সমৃদ্ধি, সম্প্রীতি ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এখনই সময়।”