হিল ভয়েস, ১৭ মে ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক: গত সপ্তাহে বাংলাদেশের বান্দরবান পার্বত্য জেলা থেকে আরও ৩২টি আদিবাসী বম পরিবারের অন্তত ১২৭ জন শরণার্থী ভারতের মিজোরাম রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। গত এপ্রিল মাসের প্রথমদিকে সেনা সৃষ্ট বম পার্টি খ্যাত কেএনএফ সন্ত্রাসীদের কর্তৃক বান্দরবানে ব্যাংক ডাকাতি এবং অতঃপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআইয়ের নেতৃত্বে কেএনএফের বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর অভিযানের নামে সাধারণ বম জনগণকে নির্বিচারে গ্রেপ্তার, আটক, হত্যা, তল্লাসি শুরু হলে বহু বম গ্রামবাসী ভয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। ফলে তাদের একটি অংশ আবারও মিজোরামে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন।
একাধিক মাধ্যমে প্রাপ্ত মিজোরামের সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত শিশু ও নারী সহ ১,৩৬৮ জন বম সম্প্রদায়ের মানুষ মিজোরামের অন্তত ৬টি গ্রামে শরণার্থী হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। গ্রামগুলি হল- খমই, রুইতেজল, মংবু, বুংত্লাং সাউথ, ভাটুয়ামপুই ও চামদুর প্রজেক্ট। তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র অনুযায়ী উক্ত হিসাবের বাইরেও ৭-৮ শ’ শরণার্থী রয়েছেন। ফলে বর্তমানে বম শরণার্থীর সংখ্যা অন্তত ২,০০০ জন।
জানা গেছে, গত ১০ মে ২০২৪, শুক্রবার, রাত আনুমানিক ২টার দিকে প্রথম দফায় ১২৪ জনের বম জনগোষ্ঠীর একটি দল সীমান্তবর্তী বান্দরবান থেকে মিজোরামের লংত্লাই জেলায় প্রবেশ করেন। একইদিন বিকেলে ৩ জনের একটি দল অন্যদের সাথে যোগ দেন।
জানা গেছে, নতুন আগত শরণার্থীদের মধ্যে ২১ জন খমই, রুইতেজল, মংবু, বুংত্লাং সাউথ ও ভাটুয়ামপুই গ্রামে আশ্রয় নেন। অন্যান্যরা সবাই চামদুর প্রজেক্ট গ্রামে একটি কমিউনিটি হলে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
একটি সূত্র জানায়, নতুন আগত বম শরণার্থীদের মধ্য থেকে ১১৮ জনকে গতকাল (১৬ মে) চামদুর প্রজেক্ট থেকে চামদুরত্লাং-এ স্থানান্তর করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের নভেম্বর থেকেই বম জনগোষ্ঠীর মানুষ শরণার্থী হিসেবে ভারতে আসতে শুরু করে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এই শরণার্থী আসার তারিখ নির্ধারণ করা হয় ডিসেম্বরের ১২ তারিখ। প্রথমদিকে মিজোরামের কর্তৃপক্ষ শরণার্থীদের কয়েক দফা পুশব্যাক করে। পরে ওয়াইএমএ (ইয়ং মিজো অ্যাসোসিয়েশন) এর দাবির প্রেক্ষিতে শরণার্থীদের গ্রহণ করা হয়।
ইতিপূর্বে মিজোরামে আগত শরণার্থীদের মধ্যে শিশুসহ অন্তত ১৫/১৬ জন মারা গেছেন বলে খবর পাওয়া যায়। এছাড়া বৈধ দলিলপত্রের অভাবে শরণার্থীদের ছেলেমেয়েরা শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে এবং বম জনগোষ্ঠীর এই শরণার্থীরা অত্যন্ত অমানবিক ও মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, কেএনএফ সন্ত্রাসীরা গত ২ এপ্রিল, রুমায় সোনালী ব্যাংকে এবং ৩ এপ্রিল, থানচিতে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকে পরপর ডাকাতি করে ১৪টি সরকারি আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি সহ বিপুল পরিমাণ অর্থ লুট করে এবং ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণ করে। উক্ত ঘটনার পর ৭ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই এর নেতৃত্বে সরকারের যৌথ বাহিনী বান্দরবান এলাকায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে।
জানা গেছে, নিরাপত্তা বাহিনীর চলমান কেএনএফ বিরোধী অভিযানে গত ৭ এপ্রিল থেকে গত ২২ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ১১১ জনকে গ্রেপ্তার ও আটক করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে কেএনএফের সাথে ৬ জন সম্পৃক্ত থাকলেও বাকিরা সকলেই শিশু, নারী সহ নিরীহ সাধারণ নাগরিক। এছাড়া সেনাবাহিনী কর্তৃক একজন বম ছাত্রকে ক্রসফায়ারের নামে ঠান্ডা মাথায় গুলি হত্যা করা হয়েছে এবং একজন নারী মর্টারশেলের আঘাতে জখম হয়েছে।
যৌথ অভিযানের পরপরই নিপীড়ন ও হয়রানির ভয়ে ইতোমধ্যে বান্দরবানের মুননোয়াম পাড়া, বেথেলপাড়া, হ্যাপিহিল পাড়া, বাচত্লাং পাড়া, আর্থা পাড়া ইত্যাদি বম গ্রামের লোকজন গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে গেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
আরো উল্লেখ্য, সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআইয়ের সহায়তায় ২০০৮ সালে নাথান বম ও ভাংচুনলিয়াম বমের নেতৃত্বে কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলাপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) গঠন করা হয়। পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে এবং চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে ২০১৯ সালে সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআইয়ের ইন্ধনে কেএনডিও-এর নাম পরিবর্তন করে বম পার্টি খ্যাত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নাম রেখে সশস্ত্র কার্যক্রম শুরু করা হয়।
পরে একটি ইসলামী জঙ্গী গোষ্ঠীকে অর্থের বিনিময়ে আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের খবর প্রচার হলে আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে সেনাবাহিনী কেএনএফের বিরুদ্ধে অপারেশন চালাতে বাধ্য হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই কৌশলে কেএনএফকে মদদ দিতে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।