হিল ভয়েস, ১২ মে ২০২৪, আন্তর্জাতিক ডেস্ক, মিউনিক থেকে: পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ন বন্ধ করা এবং চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান করেছে আনরিপ্রেজেন্টেড নেশনস অ্যান্ড পিপলস অর্গানাইজেশন (ইউএনপিও)।
আজ রবিবার (১২ মে) জার্মানীর মিউনিক শহরে অনুষ্ঠিত ইউএনপিও’র ১৮তম সাধারণ পরিষদের সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি এই আহ্বান জানানো হয়েছে। ১১ ও ১২ মে ২০২৪ দুইদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত ইউএনপিও’র ১৮তম সাধারণ পরিষদের সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রামের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রীতিবিন্দু চাকমা যোগদান করেন। সাধারণ পরিষদের সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর রেজুলেশনটি উপস্থাপন করেন জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধি প্রীতিবিন্দু চাকমা।
উক্ত রেজুলেশনে বলা হয় যে, পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের অব্যবহিত পরে সরকার চুক্তির কিছু বিষয় বাস্তবায়ন করলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ সরকারব্যবস্থা, ভূমি অধিকার ও বেসামরিকীকরণ সংক্রান্ত বিধানসমূহ, বাস্তবায়ন করেনি। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতির মৌলিক কোন অগ্রগতি সাধিত হয়নি। পার্বত্য চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানও অর্জিত হয়নি।
পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরকারী আওয়ামীলীগ সরকার দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা নিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। বরঞ্চ বর্তমান সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে পূর্ববর্তী স্বৈরশাসকদের মধ্যে ব্যাপক সামরিকায়ণ করে ফ্যাসীবাদী কায়দায় দমন-পীড়নের মাধ্যমে সমাধানের নীতি গ্রহণ করেছে। সরকার চার শতাধিক ক্যাম্প স্থাপন করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বৃহত্তর সেনাছাউনিতে রূপান্তর করেছে।
রাত-বিরাতে আদিবাসী জুম্মদের গ্রামে সেনা অভিযান, নিরপরাধ ব্যক্তিদের ধরপাকড় ও মারধর, মিথ্যা মামলা জড়িত করে জেলে প্রেরণ, ঘরবাড়ি তল্লাসী, ক্রসফায়ারের নামে গুলি করে হত্যা, বেআইনীভাবে ক্যাম্পে আটক ও নির্যাতন ইত্যাদি আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, সেনাবাহিনী তথা সরকার মুসলিম বাঙালি সেটেলার লেলিয়ে দিয়ে জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, জুম্মদের জায়গা-জমি জবরদখল, পর্যটন ও নানা উন্নয়ন প্রকল্পের নামে আদিবাসীদের উচ্ছেদ, নারীর উপর সহিংসতা ইত্যাদি মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে।
জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে আদিবাসী জুম্ম জনগণের পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে নস্যাত করার জন্য এবং উপনিবেশিক নীতি মোতাবেক জুম্ম জনগণকে ভাগ করে শাসন করার লক্ষ্যে সেনাবাহিনী একের পর এক সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ সৃষ্টি করে চলেছে এবং তাদেরকে হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি ইত্যাদি সন্ত্রাসী কাজে লেলিয়ে দিয়ে চলেছে। যেমন ২০২৩ সালের এপ্রিলে বান্দরবান জেলায় তাদের লালিত সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপকে লেলিয়ে দিয়ে সেনাবাহিনী ৭ জন বম গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে। অন্যদিকে এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সাথে জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকসহ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনরত ব্যক্তি ও সংগঠনকে জড়িত করে ক্রিমিনালাইজ করে চলেছে।
২০২৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সেনা-মদদপুষ্ট সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ, মুসলিম বাঙালি সেটেলারদের দ্বারা ২৪০টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে এবং এসব ঘটনায় ১,৯৩৩ জন জুম্ম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়, ৬৪টি গ্রাম সেনাবাহিনীর অভিযানের শিকার হয় এবং ৮৪টি বাড়ি ও পরিবারের সদস্যরা সেনা তল্লাসীর মুখে পড়েছে।
এমতাবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে তথা পার্বত্য চট্টগ্রামে টেকসই শান্তি ও উন্নয়নের স্বার্থে ইউএনপিও’র ১৮তম সাধারণ পরিষদের সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারর প্রতি এই আহ্বান জানানো হয়েছে যে-
১। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক অচিরেই পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া।
২। পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ন বন্ধ করা এবং চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান করা।
৩। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের উপর সামরিক অভিযান ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত সেনা সদস্যদের/ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা।
এছাড়া ১৮তম সাধারণ পরিষদের সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ইউএনপিও ও ইউএনপিও সদস্যদের কর্তৃক জোরালো আন্তর্জাতিক জনমত গঠনের লক্ষ্যে, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘকে টার্গেট করে আন্তর্জাতিক ক্যাম্পেইন জোরদার করার উদ্যোগ; এবং ইউএনপিও’র উদ্যোগে অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠনের সহযোগে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করার কর্মপরিহল্পনা গৃহীত হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালে নেদারল্যান্টের দ্যা হেগ শহরে গঠিত ইউএনপিও হল একটি সংহতিমূলক আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম যা বিশ্বব্যাপী প্রতিনিধিত্বহীন জাতি ও জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরকে উন্নীত করতে এবং তাদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমানে ইউএনপিও’র সদস্য সংখ্যা ৩৭টি ভূখন্ড/অঞ্চল।
আজ রবিবার (১২ মে) সম্মেলনের শেষ দিনে ইউএনপিও’র ১১ সদস্য বিশিষ্ট প্রেসিডেন্সি কমিটি নির্বাচিত হয়েছে। নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন রুবিনা গ্রীনউড এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ক্যাটালনিয়ার ইলিসেন্ড্রা পালুজিই ও আফ্রিকানার ট্যামি ব্রেডট।