হিল ভয়েস, ৮ মে ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক: রাঙ্গামাটি জেলার জুরাছড়ি উপজেলায় অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সরকারি দলের চেয়ারম্যান প্রার্থীর পক্ষাবলম্বন করে সেনাবাহিনীর সদস্যরা বেপরোয়া ও জোরজবরদস্তিমূলকভাবে হস্তক্ষেপ এবং বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটারদের ভোট দানে বাধা সৃষ্টি করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এছাড়া সেনাবাহিনী নিজেরা ও মুখোশ পরিহিত সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়ে একাধিক বাড়িতে ভাঙচুর, নিরীহ জুম্মকে মারধর করেছে বলেও খবর পাওয়া গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আজ (৮ মে) সকাল আনুমানিক ৬ টার দিকে সুবেদার মাসুদ এর নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি দল ১নং জুরাছড়ি সদর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের সোহেল পাড়া ভোট কেন্দ্রে গিয়ে জনসংহতি সমিতি সমর্থিত চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী সুরেশ চাকমা, ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী কামিনী চাকমা ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী অনিতা দেবী চাকমার নিয়োজিত কেন্দ্র এজেন্টদেরকে প্রায় ১ ঘন্টা থেকে দেড় ঘন্টা নিজেদের হেফাজতে আটক করে রাখে। পরে ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর যথারীতি ভোট গ্রহণ শুরু হলে বেশ কয়েকজন ভোটারকে ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা প্রদান করে সেনা সদস্যরা।
সকাল ৮ টার দিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা জুরাছড়ির ৩নং মৈদুং ইউনিয়নের কেন্দ্র থেকে সরকারি দল আওয়ামীলীগের প্রার্থী জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমার আনারস প্রতীকের এজেন্টদের রেখে অন্যান্য প্রার্থীর সকল এজেন্টদের জোর করে বের করে দেয়।
সকাল ৭:৩০ টা হতে ক্যাপ্টেন সাইম এর নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি দল জুরাছড়ির ৪নং দুমদুম্যা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের ভুয়াতলীছড়া কেন্দ্রে আগত ভোটারদের সরকারি দলের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর আনারস প্রতীকে ভোট প্রদানের জন্য জোরজবরদস্তি শুরু করে এবং আনারস প্রতীকে ভোট না দিলে অসুবিধা হবে বলে হুমকি প্রদান করে। সেনাবাহিনী এই কেন্দ্রে প্রায় দেড় থেকে দুই ঘন্টা যাবৎ ভোটারদের ভোট প্রদান বন্ধ রাখে বলে জানা যায়। তবে সকাল ১০ টার দিকে স্বাভাবিকভাবে ভোট গ্রহণ শুরু হয় এবং সেনাবাহিনী যথারীতি ভোটারদের আনারস প্রতীকে ভোট দিতে চাপ অব্যাহত রাখে।
আনুমানিক ৮ টার দিকে ফকিরাছড়ি সেনা ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডার সুবেদার জাফর এর নেতৃত্বে ১৪/১৫ জনের একটি সেনাদল ৪নং দুমদুম্যা ইউনিয়নের ৭/৮/৯ ওয়ার্ডের বস্তিপাড়া কেন্দ্রে গিয়ে আনারস প্রতীকের এজেন্ট বাদে অন্য সকল প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়। দীর্ঘক্ষণ যাবৎ ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা প্রদান করে, সকল ভোটারদের দোকানের প্রাঙ্গণে বসিয়ে রেখে ভোট দানে বাধা সৃষ্টি করে। এছাড়া এসময় কেন্দ্রে আগত সকল ভোটারদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় সেনাবাহিনী।
সকাল ১০ টার দিকে সেনাবাহিনীর একটি দল ৩নং মৈদুং ইউনিয়নের ফকিরাছড়া কেন্দ্রে গিয়ে ভোটারদের ভোট কেন্দ্র থেকে তাড়িয়ে দেয় বলে জানা যায়। একই সময়ে ৪নং দুমদুম্যা ইউনিয়নের ৭/৮/৯ নং ওয়ার্ডের বস্তিপাড়া কেন্দ্রেও সেনাবাহিনী ভোটারদের কেন্দ্র থেকে তাড়িয়ে দেয়। ভয়ে ভোটাররা কেন্দ্রে যেতে পারছিল না বলে খবর আসে।
আরো জানা গেছে, আজ ভোররাত আনুমানিক ৩ টার দিকে বনযোগীছড়া সেনা জোনের পাশর্^বর্তী বনযোগীছড়া সদর ইউনিয়নে অবস্থিত জলেন্টু চাকমা, পীং-মৃত সুরেন্দ্র লাল চাকমার বাড়িতে ৫ জন মুখোশ পরিহিত সন্ত্রাসী গিয়ে জলেন্টু চাকমাকে ব্যাপক মারধর করে। এছাড়া সন্ত্রাসীরা জলেন্টু চাকমার ঘরের প্রয়োজনীয় মূল্যবান বিভিন্ন জিনিসপত্র ভাঙচুর করে।
উল্লেখ্য, নির্বাচনের কয়েকদিন আগে থেকে সেনাবাহিনী জুরাছড়িতে সরকারি দলের প্রার্থী জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমার আনারস প্রতীকের পক্ষে প্রচারণা এবং জনগণ ও অন্যান্য প্রার্থীর কর্মীদের উপর চাপ শুরু করে।
গত ৪ মে ২০২৪ জুরাছড়ি সদর এলাকা থেকে জুরাছড়ির অন্তর্গত বনযোগীছড়া সেনা জোনের নিয়ন্ত্রণাধীন যক্ষা বাজার সেনা ক্যাম্পের সেনা সদস্য কর্তৃক পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)’র তিন নেতা রূপম চাকমা, সুরেন চাকমা ও রনি চাকমাকে কোনো অভিযোগ ও ওয়ারেন্ট ছাড়া আটক করা হয়। সেসময় তারা চলমান ৫ম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী সুরেশ কুমার চাকমার পক্ষে প্রচারণা কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। এর পরের দিন (৫ মে) সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে উক্ত তিন ছাত্রনেতা সহ ১৬ জন নিরীহ গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা মামলাও দায়ের করা হয়।
গত ৭ মে ২০২৪ রাত আনুমানিক ২:৩০ ঘটিকার সময়ে জুরাছড়ির বনযোগীছড়া বাজারের পাশে জ্ঞান জ্যোতি চাকমার বাড়ি ঘেরাও করে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে টিভি, মোবাইল ফোন, আলমারি, ওয়ারড্রব সহ জিনিসপত্র ভাঙচুর করে বনযোগীছড়া সেনা জোনের একটি সেনাদল। জ্ঞান জ্যোতি চাকমা সেসময় বাড়িতে ছিলেন না। সেনা সদস্যদের কর্তৃক এসময় স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী সুরেশ কুমার চাকমাকে ভোট না দিতে জ্ঞানজ্যোতি চাকমার পরিবারের লোকদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়। এই মর্মে হুমকি দেয়া হয় যে, কালকে যদি বাড়ি থেকে জ্ঞান জ্যোতি চাকমা বের হয়, তাহলে তাকে মেরে ফেলা হবে।
গত ৫ মে ২০২৪ দুপুর ১:০০টা থেকে ২:০০টা সময়ে বনযোগীছড়া জোনের অধীন শালবাগান ক্যাম্পের সুবেদার মাসুদ-এর নেতৃত্বে ২৫/৩০ জনের একটি সেনাদল জুরাছড়ি সদর ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের থাচি পাড়ায় গিয়ে কয়েকটি বাড়ি ঘেরাও করে ভিতরে থাকা লোকজনদেরকে আনারস মার্কায় ভোট দিতে নির্দেশ দেন। সেই সাথে সুবেদার মাসুদ হুমকি দেন যে, “আনারস প্রতীকের জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা যদি ভোট না পান, তাহলে আল্লাহর কসম কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।”