হিল ভয়েস, ২০ মে ২০২৪, রাঙ্গামাটি: আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) ৩৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সংগঠনটির উদ্যোগে রাঙ্গামাটির কুমার সুমিত রায় জিমনেসিয়ামে এক ছাত্র-যুব সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
সংগঠনটির সভাপতি নিপন ত্রিপুরার সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক থোয়াইক্যজায় চাক এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশটিতে উদ্বোধক হিসেবে ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য মাধবীলতা চাকমা। এছাড়া প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও কবি শিশির চাকমা, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি দীপক শীল, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি মুক্তা বাড়ৈই, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি’র রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সুমিত্র চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন এর সভানেত্রী শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা প্রমুখ। সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যা।
সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঊষাতন তালুকদার উপস্থিত সমাবেশের উদ্দেশ্যে বলেন, আমাদের জ্ঞান, মেধা, বিদ্যা ছাড়া এই অসম লড়াইয়ে জয়যুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। তাই আমাদের ছাত্র বন্ধুদের আরো অধিকতর জ্ঞান অর্জনে মনোনিবেশ করতে হবে। জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে আমাদেরকে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সময়কে গুরুত্ব দিয়ে যথাযথ ও গণমুখী শিক্ষা লাভ করে আমাদেরকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। শিক্ষা নিতে হবে আমাদের লড়াইয়ের জন্য, নেতৃত্ব বিকাশের জন্য।
সাবেক এই সাংসদ আরো বলেন, আমাদের মধ্যে এখন অনেক হতাশা। যেমন ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিকে মৃত আইন ঘোষণার জন্য ষড়যন্ত্র চলছে। অন্যদিকে গ্রামে যখন ঘোর অন্ধকার নামে, ঝিঁঝি পোকারা ডাকে তখন সাধারণ পাহাড়ি জনগণ ভয়ের মধ্যে থাকে কখন কাকে গ্রেফতার করা হয়। সাধারণ মানুষ একা অনুভব করেন। মনে রাখবেন আপনারা কেউ একা নন। এদেশের আপামর নিপীড়িত মানুষ ও প্রগতিশীল ব্যক্তি ও সংগঠন আমাদের পাশে আছে। আমাদের আন্দোলন রাষ্ট্রবিরোধী নয়। আমাদেরকে নিপীড়ন করা হচ্ছে। কাজেই এ নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনসংহতি সমিতির কর্মতৎপরতায় আন্দোলনের ফলে সরকারের উপর মহলের কাছে এসব পৌঁছে দেয়া হয়েছে। যদি আমাদের কথা শোনা না হয় তবে এই ছাত্র সমাজকে প্রস্তুত হয়ে লড়াই চালিয়ে নিতে হবে। পার্টি নেতৃত্ব দিবে আর জনগণ বিপ্লব পরিচালনা করবে।
যারা নীতি নির্ধারক, রাষ্ট্র পরিচালনায় আছে তাদেরকে বুঝতে হবে দাবি করে সাবেক গেরিলা নেতা ঊষাতন তালুকদার আরো বলেন, বেইলী রোডে কমপ্লেক্স করে দেয়া আর পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন এক নয়। সরকার বলে থাকে- আমরা এই করেছি, সেই করেছি। জাতিসংঘে গিয়ে মিথ্যাচার করে থাকে। আমাদের জনগণ শেখ হাসিনার উপর আস্থা রেখে তৃতীয় পক্ষ ছাড়া চুক্তি করেছে। কিন্তু এখন আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছে। আপনাদের কাঁধে যে জাত্যভিমান ভর করেছে তা নামিয়ে ফেলুন। বড় জাতি হিসেবে আপনাদের বড় মনের অধিকারী হতে হবে কারণ আপনারাও তো নিপীড়িত হয়েছিলেন। সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তা, আতংক, ভয় থেকে মুক্তি দিয়ে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করুন।
উদ্বোধনী বক্তব্যে মাধবীলতা চাকমা বলেন, এম এন লারমার দেখানো পথে আমদের এগোতে হবে। পাহাড়ের যুগপৎ আন্দোলনে যুব সমাজের কোনো বিকল্প নেই। চুক্তি করলেও আমাদের কাজ শেষ হয়নি। চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে পাহাড়ে আজো শান্তি ফিরেনি। আত্মমুখহীনতা, সুবিধাবাদ ও দোদুল্যমানতা পরিহার করে ছাত্র যুব সমাজকে এগিয়ে যেতে হবে।
শিশির চাকমা বলেন, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের লড়াইয়ের ৩৫ বছর প্রমাণ করে তারা জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের ভ্যানগার্ড। সামনের রাজপথ সমৃণ নয়, যেভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা করা হচ্ছে সেই সকল বাধাকে প্রতিহত করে ছাত্র সমাজকে সম্মুখে অগ্রসর হতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত থাকলে বাংলাদেশ শান্ত থাকতে পারে না। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না, আদিবাসী মানুষ সাধারণভাবে বাঁচতে চায় তাদের সমুন্নত মান সম্মান নিয়ে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সুমিত্র চাকমা বলেন, পাহাড়ে যখন একের পর এক গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছিলো তখন লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ১৯৮৯ সালের ২০ মে ঢাকার রাজপথ কাঁপিয়ে পিসিপির জন্ম হয়। তারই ধারাবাহিকতায় পিসিপি আপোষহীন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। পিসিপি প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে পাহাড়ের যে কোনো আন্দোলনে পিসিপি ছিলো সর্বদা অগ্রসর। পার্বত্য চুক্তির ২৬ বছরেও সরকার এ চুক্তি বাস্তবায়ন না করে উল্টো উন্নয়নের নামে পাহাড়িদের নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, লড়াই করে ছিনিয়ে আনতে হবে।
সমাবেশে মুক্তা বাড়ৈই বলেন, ২০২১ সালের শিক্ষা আইন একটি কারিগর মিস্ত্রী তৈরি করার কারখানা। অন্য ক্ষেত্রে বাজেট বাড়লেও শিক্ষার কোনো বাজেট বাড়ে না। প্রাথমিক শিক্ষা একটি মানুষের মৌলিক অধিকার কিন্তু ২২০০০ গ্রামে এখনো কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। এখনো অনেক এলাকায় মাতৃভাষায় শিক্ষা দান দিতে আজকের সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সরকার বার বার পাবর্ত্য চুক্তি বাস্তবায়নে টালবাহানা করছে। সেক্যুলার বিজ্ঞান সস্মত শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ণসহ পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নের জোর দাবি জানান তিনি।
শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, আমরা বঞ্চনার কথা শোনাতে চাই না আর, প্রতিবাদের কথা শোনাতে চাই। মরার পরেও বেঁচে থাকতে চাই নাকি বেঁচে থেকেও মরতে চাই তা আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে। আজ আমাদের পায়ের তলায় মাটি নেই, ১৯০০ সালের ঐতিহাসিক শাসনবিধি দলিলকে বাতিলের জন্য ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। জুম্ম জনগণের স্বপ্নের অধিকারের সনদ পার্বত্য চুক্তিকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে, নানা ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। শাসকগোষ্ঠীকে জানান দিতে চাই, জুম্ম জনগণ যুদ্ধ চাই না শান্তি চাই, সরকার যদি যুদ্ধের বায়না ধরে জুম্ম জনগণ বসে থাকবে না।
দীপক শীল বলেন, পাহাড় কি বাংলাদেশের মানচিত্রের বাইরে? স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হওয়ার পরও পাহাড় সেনাবাহিনীর দ্বারা শাসিত হবে। পার্বত্য চুক্তিকে বাস্তবায়নের নামে একটি নাটক সাজিয়ে রাখা হয়েছে না হলে ২৬ বছর পেরিয়ে যেতো না পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের। বর্তমান সরকার কথিত গণতন্ত্রের নামে একটি ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা কায়েম করে রেখেছে। সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে হবে যেখানে সকল জাতিসমূহের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
সভাপতির বক্তব্যে নিপন ত্রিপুরা বলেন, পিসিপি প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে যে আন্দোলন করছে তাতে এক বিন্দুও রণ-ক্লান্ত হয়নি। ৩৫ বছরের পথচলায় অনেক বীর শহীদ হয়েছেন তাদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। শাসকগোষ্ঠীর কেএনএফ সন্ত্রাসী দমনের নামে সাধারণ বম জনগোষ্ঠীর উপর দমন-পীড়ন বন্ধ করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানে পার্বত্য চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত পিসিপি’র আন্দোলন চলমান থাকবে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে বৃহত্তর আন্দোলনে ছাত্র-যুব সমাজকে অধিকতর সামিল হওয়ার আহ্বানও জানান তিনি।
সমাবেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ তার ৩৫ বছরের গৌরবময় পথচলায় জুম পাহাড়ের তরুণ ছাত্র-যুবাদের দৃপ্ত কন্ঠে নিম্নোক্ত আহ্বান জানিয়েছে:
১. জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী ও চুক্তি বিরোধী সকল কার্যক্রম প্রতিহতকরণে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের পতাকাতলে সামিল হোন।
২. মাদক, অপসংস্কৃতি চর্চা ও শাসকগোষ্ঠীর তৈয়ারকৃত নানা সংসদ, অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান বয়কট করে স্বকীয় সংস্কৃতি চর্চা, প্রচার ও প্রসারে মনোযোগী হোন।
৩. মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র শেখানো- ‘শিক্ষা গ্রহণ কর, গ্রামে ফিরে চল’ নীতির ভিত্তিতে শেকড়ের সন্ধান ও রক্ষায় মনোযোগী হোন।
৪. আত্মমুখিনতা, সুবিধাবাদ ও দোদুল্যমানতা পরিহার করে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলনে অধিকতর সামিল হোন।
এছাড়া সংগঠনটি সরকারের প্রতি নিম্নোক্ত দাবি জানিয়েছে:
১. জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থি, চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম ধ্বংসের সকল কার্যক্রম বন্ধ করে অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করুন।
২. ‘ভাগ-কর, শাসন কর’ নীতি পরিহার করে প্রকৃত অর্থে জুম পাহাড়ের মানুষের জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে এগিয়ে আসুন।
৩. সামরিক কর্মকর্তা ও গোয়েন্দাদের দিয়ে নানা নামে বেনামে চুক্তি বিরোধী ফোর্স গঠন, মদদ দেয়া বন্ধ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক সকল অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করুন।
৪. প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকুরীতে আদিবাসীদের জন্য ৫% কোটা পুনর্বহাল করুন।
৫. বান্দরবানে সাধারণ বম নাগরিকরাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।
৬. জুম্ম বিধ্বংসী পর্যটন প্রকল্প বন্ধ করে, পর্যটনের নামে ভূমি বেদখল বন্ধ ও অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন কার্যকর করে পাহাড়ের ভূমি সমস্যার সমাধান করুন।
৭. দেশের সকল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে আদিবাসীদের উৎসবের দিনে ছুটি নিশ্চিত করুন।