হিল ভয়েস, ২৩ মে ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক: গত ১৯ মে, রবিবার, বাংলাদেশের বান্দরবান জেলা থেকে সর্বশেষ আরও ৬৫ জন বম শরণার্থী ভারতের মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত মিজোরামে সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত বম শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ালো ১,৪৩৩ জন, অপরদিকে বেসরকারি হিসেব মতে এই সংখ্যা ২ হাজারের অধিক।
এপ্রিলের শুরুতে কেএনএফ সন্ত্রাসীদের কর্তৃক বান্দরবানে পরপর দুইদিন ব্যাংক ডাকাতি, অস্ত্র লুট ও ম্যানেজার অপহরণের পর সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই এর নেতৃত্বে যৌথ বাহিনীর কেএনএফ বিরোধী সামরিক অভিযান, নির্বিচারে নিরীহ বম জনগণকে ধরপাকড়, হত্যা এবং কেএনএফের নানামুখী চাপের মুখে সাধারণ বম গ্রামবাসীরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা অনেকেই গ্রাম ছেড়ে বিভিন্ন দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
তারই অংশ হিসেবে সম্প্রতি আবারও বান্দরবান থেকে নারী ও শিশু সহ বম সম্প্রদায়ের লোকজন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মিজোরাম রাজ্যে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হন।
গত ১৯ মে তারিখে আসা শরণার্থীরা বর্তমানে মিজোরাম রাজ্যের লংত্লাই জেলার ভাটুয়ামপুই গ্রামে রয়েছেন। শরণার্থীদের ৬৫ জনের মধ্যে ৩৮ জন পুরুষ ও ২৭ জন নারী রয়েছেন বলে জানা গেছে।
মাত্র আট দিন আগে, গত ১০ মে, শুক্রবার, রাত আনুমানিক ২টার দিকে প্রথম দফায় ১২৪ জনের বম জনগোষ্ঠীর একটি দল সীমান্তবর্তী বান্দরবান থেকে মিজোরামের লংত্লাই জেলায় প্রবেশ করেন। একইদিন বিকেলে ৩ জনের একটি দল অন্যদের সাথে যোগ দেন।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের নভেম্বর থেকেই বম জনগোষ্ঠীর মানুষ শরণার্থী হিসেবে ভারতে আসতে শুরু করে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এই শরণার্থী আসার তারিখ নির্ধারণ করা হয় ডিসেম্বরের ১২ তারিখ। প্রথমদিকে মিজোরামের কর্তৃপক্ষ শরণার্থীদের কয়েক দফা পুশব্যাক করে। পরে ওয়াইএমএ (মিজো যুবকদের সংগঠন) এর দাবির প্রেক্ষিতে শরণার্থীদের গ্রহণ করা হয়।
ইতিপূর্বে মিজোরামে আগত শরণার্থীদের মধ্যে শিশুসহ অন্তত ১৫/১৬ জন মারা গেছেন বলে খবর পাওয়া যায়। এছাড়া বৈধ দলিলপত্রের অভাবে শরণার্থীদের ছেলেমেয়েরা শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে এবং বম জনগোষ্ঠীর এই শরণার্থীরা অত্যন্ত অমানবিক ও মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, কেএনএফ সন্ত্রাসীরা গত ২ এপ্রিল, রুমায় সোনালী ব্যাংকে এবং ৩ এপ্রিল, থানচিতে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকে পরপর ডাকাতি করে ১৪টি সরকারি আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি সহ বিপুল পরিমাণ অর্থ লুট করে এবং ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণ করে। উক্ত ঘটনার পর ৭ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই এর নেতৃত্বে সরকারের যৌথ বাহিনী বান্দরবান এলাকায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে।
জানা গেছে, নিরাপত্তা বাহিনীর চলমান কেএনএফ বিরোধী অভিযানে গত ৭ এপ্রিল থেকে গত ২২ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ১১১ জনকে গ্রেপ্তার ও আটক করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে কেএনএফের সাথে ৬ জন সম্পৃক্ত থাকলেও বাকিরা সকলেই শিশু, নারী সহ নিরীহ সাধারণ নাগরিক। এছাড়া সেনাবাহিনী কর্তৃক একজন বম ছাত্রকে ক্রসফায়ারের নামে ঠান্ডা মাথায় গুলি হত্যা করা হয়েছে এবং একজন নারী মর্টারশেলের আঘাতে জখম হয়েছে।
উক্ত সামরিক অভিযান শুরুর পর আবারও বম জনগণ নিরুপায় হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে শুরু করে।
এদিকে শরণার্থীদের স্ব স্ব জায়গায় ফিরিয়ে আনা এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ এখনো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।
উল্লেখ্য যে, সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআইয়ের সহায়তায় ২০০৮ সালে নাথান বম ও ভাংচুনলিয়াম বমের নেতৃত্বে কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলাপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) গঠন করা হয়। পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে এবং চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে ২০১৯ সালে সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআইয়ের ইন্ধনে কেএনডিও-এর নাম পরিবর্তন করে বম পার্টি খ্যাত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নাম রেখে সশস্ত্র কার্যক্রম শুরু করা হয়।
পরে একটি ইসলামী জঙ্গী গোষ্ঠীকে অর্থের বিনিময়ে আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের খবর প্রচার হলে আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে সেনাবাহিনী কেএনএফের বিরুদ্ধে অপারেশন চালাতে বাধ্য হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই কৌশলে কেএনএফকে মদদ দিতে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।