হিল ভয়েস, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক: বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক সেনাসৃষ্ট কেএনএফ সন্ত্রাসীদের দমনের নামে বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় বি এ (অনার্স) পড়ুয়া নিরীহ এক বম ছাত্রকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। হত্যার পর সেনাবাহিনী ওই ছাত্র কেএনএফের সশস্ত্র সদস্য এবং কেএনএফের সাথে গোলাগুলিতে অর্থাৎ ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে বলেও অপপ্রচার চালিয়েছে।
এছাড়া সেনাবাহিনীর ড্রোন দিয়ে হামলা ও মর্টার শেল নিক্ষেপে বম সম্প্রদায়ের এক কলেজ ছাত্রী গুরুতর আহত হয়েছে।
অপরদিকে, বিগত তিন দিনে ২ মাসের শিশু ও নারীসহ বম ও মারমা সম্প্রদায়ের ১৪ জন গ্রামবাসীকে যৌথবাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া আরও তিনজন সাময়িক আটকের পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গতকাল (২২ এপ্রিল) সেনাবাহিনীর একটি দল লাল রেম রুয়াত বম (২১) নামে এক নিরীহ ছাত্রকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে কেএনএফের পোশাক পড়িয়ে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করে। একইদিন সন্ধ্যায় আন্তঃবাহিনী জন-সংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) সহকারী পরিচালক রাশেদুল আলম খান কর্তৃক প্রদত্ত বিবৃতিতে ভুক্তভোগী লাল রেম রুয়াত বমকে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে কেএনএফের সশস্ত্র সদস্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সেনাবাহিনীর ওই বিবৃতিতে মিথ্যাচার করে বলা হয়- ‘কেএনএফ’এর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীসহ যৌথ বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এই অভিযান চলাকালে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে কেএনএফের এক সশস্ত্র সদস্য নিহত হয়েছেন। উদ্ধার করা হয়েছে অস্ত্র-গোলাবারুদসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম।’
হত্যার শিকার লাল রেম রুয়াত বম ছিলেন বান্দরবান সরকারি কলেজের বি এ (অনার্স) পড়ুয়া ছাত্র। তার বাড়ি রুমার সুনসং পাড়া গ্রামে। তার পিতা লালথুয়াইতেলং বম স্থানীয় মৌজার হেডম্যান বলে জানা গেছে।
একইদিন (২২ এপ্রিল) সকাল ৬:৩০ টার দিকে সেনাবাহিনী রুমা সদর ইউনিয়ন এলাকার বম সম্প্রদায়ের গ্রাম মুনলাই পাড়া লক্ষ্য করে ড্রোন দিয়ে উপর্যুপরি মর্টারশেল (কামানের গোলা) নিক্ষেপ করে। এসময় বাড়িতে অবস্থানরত সেলি বম (১৯) নামে এক তরুণীর শরীরে একাধিক স্থানে মর্টার শেলের টুকরো এসে বিদ্ধ করে। গুরুতর আহত সেলি বম সাঙ্গু কলেজের ছাত্রী বলে জানা গেছে।
একইদিন সেনাবাহিনী রুমা থেকে আরও ৬ ব্যক্তিকে আটক করেছে বলে জানা গেছে। আটককৃতদের মধ্যে ভান মুন নোয়াম বম (৩৩), পীং-লিয়ান অং বম কেএনএফের অন্যতম সহযোগী এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রুমা উপজেলা শাখার সভাপতি বলে জানা গেছে। আটকের পর ভান মুন নোয়াম বমকে রুমার ছাত্রলীগের কমিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। অন্যান্য আটককৃত ব্যক্তিদের নাম পাওয়া যায়নি।
আজ (২৩ এপ্রিল) সকাল আনুমানিক ৬:৩০ টার দিকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) কর্তৃক ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এক নিরীহ মারমা কার্বারিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ভুক্তভোগী ব্যক্তির নাম উম্যামং মারমা (৫০), পীং-মৃত ক্যশৈ অং মারমা, গ্রাম-নতুন চড়ুই পাড়া, ২নং কুহালং ইউনিয়ন, বান্দরবান সদর উপজেলা। সাদা পোশাকে আগত র্যাবের একটি দল উম্যামং মারমার গোয়াল ঘরে আফিম রেখে দিয়ে সেই আফিম পেয়েছে বলে উম্যামং মারমাকে গ্রেপ্তার করে।
অপরদিকে, গত ২০ এপ্রিল, যৌথবাহিনী কর্তৃক কেএনএফের বিরুদ্ধে তথাকথিত অভিযানের নামে ৩ জন নিরীহ নারী ও তাদের সাথে ৪ জন অবোধ শিশু গ্রেপ্তার করা হয়। গত ২১ এপ্রিল, শিশুসহ উক্ত নারীদের বান্দরবানের আদালতে হাজির করা হয় এবং আদালত তাদের জন্য ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।
ভুক্তভোগী এসব নারী ও শিশুরা হল- (১) লাল এনকল বম, ২৪ বছর, পেশায় গৃহিনী ও জুমচাষী; (২) লাল রুয়াত ফেল বম, ২১ বছর, গৃহিনী; (৩) লাল নুন পুই বম, ১৮ বছর, ২য় বর্ষে ছাত্রী, সাঙ্গু সরকারি কলেজ; (৪) লাল থার সাং বম, ৪ বছর; (৫) লাল ফেলিনা বম, ২ বছর; (৬) রাম দুহ থাং বম, ২ মাস এবং (৭) ইউনিকি বম, ২ বছর।
আরো জানা গেছে, গতকাল (২২ এপ্রিল) দুপুরে মুননোয়াম পাড়া সেনা ক্যাম্প হতে সেনাবাহিনীর একটি টহল দল মুননোয়াম পাড়াতে গিয়ে ব্যাপক তল্লাসি অভিযান পরিচালনা করে এবং ঘরের ব্যবহার উপযোগী গ্রামবাসীদের সমস্ত জিনিস ও আসবাবপত্র ভেঙে তছনছ করে দেয়। একইসাথে বান্দরবান সদর ইউনিয়নের মেঘলা এলাকার কানান পাড়া এলাকায় সেনাবাহিনীর একটি দল অভিযানে যায়। সেখানে গিয়ে একটি টং ঘরকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি ব্রাশ ফায়ার করে সেনাবাহিনী। জানা গেছে, একটি ফলজ বাগান দেখাশোনার জন্য ওই টং ঘরে দুই বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা থাকতেন। সেনাবাহিনী আসতে দেখে তারা ভয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
জানা গেছে, নিরাপত্তা বাহিনীর চলমান কেএনএফ বিরোধী অভিযানে গত ৭ এপ্রিল থেকে গত ২২ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ১১১ জনকে গ্রেপ্তার ও আটক করা হয়েছে। তার মধ্যে ৪টি শিশু রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে কেএনএফের সাথে ৫ জন সম্পৃক্ত রয়েছে এবং বাকিরা সকলেই নিরীহ সাধারণ নাগরিক। এর মধ্যে ১৩ জন ত্রিপুরা এবং ৫ জন মারমা সহ মোট ২৩ জনকে আটকের পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ২ এপ্রিল ও ৩ এপ্রিল, পরপর কেএনএন সন্ত্রাসীরা রুমা ও থানচিতে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকে সশস্ত্র হামলা ও লুটপাট চালালে, সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই এর নেতৃত্বাধীন সরকারের যৌথবাহিনী ৭ এপ্রিল থেকে কেএনএফের বিরুদ্ধে বান্দরবান এলাকায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে।
উল্লেখ্য যে, সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআইয়ের সহায়তায় ২০০৮ সালে নাথান বম ও ভাংচুনলিয়াম বমের নেতৃত্বে কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলাপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) গঠন করা হয়। পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে এবং চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে ২০১৯ সালে সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআইয়ের ইন্ধনে কেএনডিও-এর নাম পরিবর্তন করে বম পার্টি খ্যাত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নাম রেখে সশস্ত্র কার্যক্রম শুরু করা হয়।