সুমন মারমা, ঢাকা
এপ্রিল মাস মারমাদের নববর্ষ ‘সাংগ্রাই’ এর মাস। চারিদিকে আনন্দ ও উল্লাসে ভরে যায় গোটা পরিবেশ। তবে আগেকার উল্লাস আর বর্তমান সময়ে উল্লাস যেন আকাশ পাতাল তফাৎ। চেতনায় ভরা সাংগ্রাই বর্তমান সময়ে পানি খেলা দ্বারা নানাভাবে আলোচিত ও সমালোচিত। কেন আলোচিত ও সমালোচিত তা বলার প্রয়াস করেছি এই ক্ষুদ্র লেখনি দ্বারা। মারমা সমাজের সংস্কৃতির বিপরীত আলোচনা নয় এটি। বরং পানি খেলার নামে আমরা কী চর্চা করছি তা কিছুটা তুলে ধরা। সময় থাকতে বিষয়টা উপলব্ধি করতে অতীব জরুরী এই আলোচনা।
পূর্বে মারমা সমাজে পানি খেলার সংস্কৃতি ছিল না। ১৯৭৩ কী ’৭৪ সালের দিকে প্রথম বান্দরবানে এক ঝাঁক মারমা তরুণ পানি খেলার আয়োজন করে। আয়োজনটা প্রথমে খুব ক্ষুদ্র পরিসরে ছিল। পরবর্তীতে বৃহৎ পরিসরে পানি খেলার আয়োজন করা হয়। মূলত ঐ তরুণরা বার্মায় গিয়ে পানি খেলার এই সংস্কৃতি দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু বার্মা বা মিয়ানমারে পানি খেলার সংস্কৃতিটা বর্তমানে মারমারা যেটা আয়োজন করে তা থেকে ভিন্ন। তদ্রুপভাবে লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ইত্যাদি বহু বৌদ্ধ দেশে পানি বর্ষণের এই রীতি প্রচলিত আছে। তবে ভিন্ন আঙ্গিকে সেসব আয়োজন অনুষ্ঠিত হয় সেখানে। সামাজিক কিছু রীতি ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে বর্ষকে বরণ করা হয় সেসব দেশে। বাংলাদেশে মারমাদের পানি বর্ষণ, পানি খেলা, জলকেলি উৎসব, মৈত্রী পানি খেলা, পানি খেলা উৎসব যেই নামেই অভিহিত করি না কেন মূল কথা হলো পুরনো বছরকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো। পানি দ্বারা পুরনো গ্লানিকে ধুয়ে-মুছে নতুন বছরের আগমন ঘটানো। তবে এক্ষেত্রে পানি খেলার সাথে সাংগ্রাই এর কোনো সামঞ্জস্য সংস্কৃতি পরিলক্ষিত হয় না। এবং পানি খেলা, জল উৎসব, জলকেলি উৎসব, মৈত্রী পানি খেলা নামে উৎসবের কোনো অস্তিত্ব ও মাহাত্ম্য নেই। অতএব সাংগ্রাই মানে পানি খেলা এটি কোনো সময় মারমা সমাজের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ছিল না।
শুরুতেই বলেছি, বাংলাদেশে পানি খেলার রেওয়াজ শুরু হয় বান্দরবান অঞ্চল থেকে। এরপর রাঙ্গামাটি এবং শেষে খাগড়াছড়িতে। পানি খেলার মর্মার্থ বর্তমান প্রজন্মের কাছে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। পানি খেলার নামে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপসংস্কৃতির চর্চা শেখানো হচ্ছে। চেতনাবিহীন আনন্দকে প্রাধান্য দিয়ে বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে মূল সংস্কৃতি থেকে দূরে রাখা হচ্ছে। দেখা গেছে পানি খেলায় শুধুমাত্র যুবক-যুবতীরাই অংশগ্রহণ করে। গাড়ি ফ্রি করে দিয়ে হাজার হাজার তরুণ-তরুণীকে এনে নাচানাচি ও আমোদ-প্রমোদ করা হয়। মদ খেয়ে, নেশা করে ছেলে মেয়ে উভয়ই কোনো কোনো সময় নানা ধরনের শারীরিক শ্লীলতাহানির ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়ছে। অঞ্চলে অঞ্চলে মারামারির ঘটনা ঘটছে। বিজাতীয় কিছু উচ্ছৃঙ্খল যুবক সুযোগ বুঝে জুম্ম নারীর উপর যৌন নিপীড়ন করছে। বিজাতীয় ব্যক্তিরা তরুণীদের বুকে ও কোমড়ে পানি ঢেলে পানি খেলা উদ্বোধন করে থাকেন। অনেক সময় লক্ষ করা যায়, পানি খেলায় যাওয়া এবং ফেরার সময় বিজাতীয় মানুষেরা নোংরা ও কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি ছুঁড়ে মারে। এতে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। সব কিছুর জন্য আমরা দায়ী। পানি খেলা দায়ী। অথচ পানি বর্ষণ হতো গ্রামে ব্যক্তিভেদে। শিশু-কিশোর ও যুবক-যুবতীরা পরস্পর পরস্পরকে পানি বর্ষণ করতো। মোদ্দা কথা হলো, বর্তমানে পানি খেলার নামে যুব সমাজ কিছু অসুস্থ সংস্কৃতি চর্চায় লিপ্ত হচ্ছে।
সাংগ্রাই এর সাথে পানি খেলার সংস্কৃতি বর্তমান সময়ে ওতপ্রোতভাবে জড়ানো হয়েছে। সাংগ্রাই এর মাহাত্ম্য অপরিসীম। কিন্তু পানি খেলার কোনো মাহাত্ম্য নেই। একটি ব্যবসায়ী চক্র ব্যবসা করে এই পানি খেলাকে কেন্দ্র করে লাভবান হয়। কিন্তু আড়ালে থেকে যায় প্রকৃত সত্য বিষয়। রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে পানি খেলাকে কেন্দ্র করে বিশাল বিশাল কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও দেখা যায় মারমা জাতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কিত গান বাজনা করানো হয় না। অথচ কাপ্যা, জাইক, পাংখুং এর মতো বহু সাংস্কৃতিক উপাদান আছে মারমাদের যা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। সেগুলোর যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা না থাকার দরুণ এসব সংস্কৃতি হারাতে বসেছি আমরা। যদি পানি খেলার অনুষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী এসব সংস্কৃতির সাথে যুব সমাজকে পরিচয় করিয়ে দেয়া যায় তাহলে আমরাই উপকৃত হবো। কাজেই সেটাও হচ্ছে না।
সাংগ্রাই বললে ছোটোকাল থেকে আমরা যা বুঝি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে নদী বা ছড়ায় গিয়ে সাংগ্রাই বা বিঝুর গুলো বা ফল খাওয়া। অর্থাৎ পানিতে ডুব দিয়ে গোসলের মাধ্যমে সাংগ্রাই এর শুভ সূচনা করা। ঐদিনে ফুল তুলে ঘর সাজানো হয়। বেশির ভাগ আগের দিন রাত্রে ফুল সংগ্রহ বা চুরি করে তা দিয়ে সকালে ঘর সাজানো। এখানে চুরি করা যদিও খারাপ অর্থে বুঝায় না। সকালে উঠে গ্রামে ঘুরে ঘুরে প্রতিবেশির গৃহপালিত পশু-পক্ষীকে খাবার দেয়া। গ্রামে বয়স্কদের গোসল করিয়ে তাদের কাছ থেকে আশীর্বাদ নেয়া। বিহারে গিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করা। নতুন নতুন পোশাক পরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে আপ্যায়ন গ্রহণ করা। এসব সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে।
বর্তমান সময়ে শুধুমাত্র জেলা শহরগুলোতে পানি খেলা সীমাবদ্ধ নেই। গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে এই পানি খেলা। অধিকাংশ পানি খেলার অনুষ্ঠান রাজনৈতিক কর্মসূচীতে পরিণত হয়েছে। সরকার দলীয় ব্যক্তিরা সরকারের গুণগান গেয়ে বক্তব্য দেন। পোস্টার আর অনলাইনে প্রচার করা হচ্ছে স্বকীয় সংস্কৃতিকে ক্ষুণ্ন করে বিজাতীয় সংস্কৃতিকে জড়িয়ে। মারমাদের সংস্কৃতির কথা বলে স্বকীয় সংস্কৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন ব্যক্তিদের অতিথি করা হচ্ছে। মারমা জাতির পাশাপাশি অন্য সকল জাতিদের জনাব/জনাবা ইসলামী সংস্কৃতি ব্যবহার করে জুম্ম জাতীয় সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে এবং নতুন প্রজন্মকে ভুল পথে পরিচালিত করা হচ্ছে। একটা ছোট বাচ্চা যখন পানি খেলার এসব পোস্টার বা অনলাইন প্রচারণা দেখে তাহলে সে কেবল ছোটকাল থেকে নিজের সংস্কৃতিকে ভুলে বিজাতীয় সংস্কৃতি ব্যবহার করতে শিখবে।
আমরা এমনিতেই অস্তিত্ব সংকটের দিকে যাচ্ছি। তার মধ্যে যদি বিজাতীয় বা ইসলামী সংস্কৃতি ব্যবহারে সচেতন না হই তাহলে অতিশীঘ্রই আমরা অস্তিত্ব ধ্বংসের মুখোমুখি হবো। পানি খেলার নামে বিকৃত বা অপসংস্কৃতিকে বিরোধীতা করতে হবে। পানি বর্ষণকে সঠিক ও আদর্শের জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। লক্ষ লক্ষ টাকা অপচয় করে পানি খেলার আয়োজন না করে মারমা জাতীয় সংস্কৃতি রক্ষার্থে সরকারিভাবে বরাদ্দ বাড়াতে আহ্বান করি। পানি খেলায় গুটি কয়েক শ্রেণি লাভবান হয় মাত্র। সংস্কৃতি রক্ষায় পানি খেলা কোনো ভূমিকাই রাখছে না। মারমা তরুণ সমাজকে নেশামুক্ত ও সংস্কৃতিমনা করে গড়ে তুলতে সম্মিলিত উদ্যোগ কামনা করছি। আমার ভাষা আমার অস্তিত্ব। আমার সংস্কৃতি আমার পরিচয়। আসুন বৈচিত্র্যময় আপন সংস্কৃতি রক্ষায় সকলে এগিয়ে আসি।
+ There are no comments
Add yours